আমাদের জীবন স্বল্প সময়ের। এই স্বল্প সময়ের জীবনকে আরো গতিশীল করে তুলতে আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় মেনে চলুন। এতে আপনার জীবনযাত্রার মান উন্নত ও সুন্দর হয়ে উঠবে। সাবলীল দক্ষতা এবং চরিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাগুলো সবসময়েই অসীম। আপনি যদি নিজের মধ্যকার গুণগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে যেমন নতুন কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন, সাথে শিখতেও পারবেন অনেক কিছু। ব্যক্তিত্বের বিকাশ আপনার ব্যক্তিজীবন এবং কর্মজীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সাহায্য করবে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অনেকে বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি মানুষের স্বভাব-চরিত্র স্থায়ী এবং সেটা কোনোভাবেই বদলানো সম্ভব না। তবে এই কথাটি পুরোপুরি সত্য না। ব্যক্তিত্ব হচ্ছে আচার-আচরণ ও চিন্তাভাবনার একটি অনন্য মিশ্রণ। দৃঢ়ভাবে চেষ্টা করলে নিজের স্বভাব এবং চিন্তাভাবনার উন্নতি সাধন করা সম্ভব। নিচের বিষয়গুলো মেনে চলতে পারলে আপনার জীবনযাত্রা আরও গতিশীল ও ফলপ্রসু হয়ে উঠবে।
১. প্রার্থনা করা
প্রতিদিন কিছুক্ষণ একমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা আমাদের মনে শান্তি এনে দেয়। উপরে কেউ আছেন যিনি সব দেখছেন এবং তিনি চাইলেই আমাদের সব কষ্ট এবং যন্ত্রণা দূর করে দিতে পারেন – এটা জানা এবং মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা শুধু আমাদেরকে শান্তিই না; বরং শক্তিও দেয়। তাই, প্রতিদিন নামাজ-পূজা-অর্চনা যেই উপায়ই হোক না কেন, সৃষ্টিকর্তার সাথে কথা বলা এবং তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা খুব ভাল একটি প্র্যাকটিস।
২. লক্ষ্যের তালিকা নির্দিষ্ট করে ফেলুন
আমাদের যখন প্রশ্ন করা হয়, আমরা জীবনে উল্লেখযোগ্য কী করতে চাই, তাহলে অনেকগুলো চিন্তা আমাদের মাথায় একসাথে কাজ করে। ছবি তোলা, বিতর্ক শেখা, লেখালেখি করা, শরীরের ওজন কমানো- এমন অনেক চিন্তা একসাথে মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু দিনশেষে এগুলোর কোনোটাই ঠিকমতো শুরু করা হয় না। শুরু করা গেলেও দেখা যায় একটি লক্ষ্যের কাজ আরেকটিকে বাঁধা দিচ্ছে। তাই শেষপর্যন্ত কোনোকিছুই ভালো মতো করা হয় না।
এজন্য আমাদের লক্ষ্যের তালিকা ছোট করে আনতে হবে। একসাথে ২-৩টির বেশি বড় লক্ষ্য রাখা উচিৎ না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করে তারপর বাকি লক্ষ্যগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
৩. বড় লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য ছোট ছোট কয়েকটি লক্ষ্য ঠিক করুন
বড় একটি লক্ষ্য নিয়ে এগোতে গেলে কাজের মাঝে অনেক ভুল ধরা পড়ে। এই ভুলগুলোর কারণে পুরো লক্ষ্যটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এজন্য সবসময় বড় কোনো কাজকে ছোট ছোট কাজে ভাগ করে নিতে হয়। ছোট কাজগুলোর মাঝে ভুলগুলো সহজেই শুধরে নেয়া যায়। এতে ভবিষ্যতে কাজের মাঝে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সহজেই ঠিক করে নেয়া যায়।
৪. জানার পরিধি বাড়িয়ে তুলুন
ব্যক্তিত্বের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আগ্রহের দিকগুলো বিস্তৃত করুন। এটি আপনার মনকে সতেজ রাখবে এবং নতুন নতুন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি বাড়াবে। এছাড়াও অন্যদের কাছে আপনি আরো আকর্ষনীয় হয়ে উঠবেন কারণ তারা তখন আপনার কাছ থেকে নতুন কিছু জানার সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে যেমন আপনার আত্মবিশ্বাস কয়েকগুণে বেড়ে যাবে, তেমনি নিজের আগ্রহের বিষয়ে অন্যদের সাথে কথা বলার সুযোগটাও পেয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারেন এবং নিজের চিন্তাভাবনাকে চার দেয়ালের মাঝে আটকে না রেখে আরো বৈচিত্রময় করে তুলতে পারেন। অভিজ্ঞতা বাড়াতে বিভিন্ন সৃষ্টিশীল সংগঠন অথবা প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হতে পারলেই জানার পরিধি আস্তে আস্তে বাড়বে।
৫. সময়ের সঠিক ব্যবহার করুন
গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী কাজগুলো আপনার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। সেজন্য সময় ব্যবস্থাপনার সময় জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সবার আগে অগ্রাধিকার দেবেন। আর যে কাজগুলো জরুরিও নয়, আবার গুরুত্বপূর্ণও নয়, এবং যে কাজগুলো না করলে আপনার লক্ষ্য পূরণে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, সেই কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকবেন। সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে আপনার কাজগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২০ ভাগ কাজকে আলাদা করুন। এই কাজগুলোই আপনার বাকি ৮০ ভাগ কাজের সমান ফলাফল বয়ে আনবে।
৬. বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হোন
একটি প্রচলিত কথা আছে, “বিপদে পড়লে প্রকৃত বন্ধুকে চেনা যায়”। বিপদে পড়লে আপনার প্রকৃত বন্ধুই আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। সুসময়ের বন্ধু দূরে পালাবে। ছোট-বড় যেকোনো সমস্যায় পাশে থেকে প্রকৃত বন্ধু আপনাকে সমর্থন দিয়ে যাবে। শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন, “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ”। মানুষ তার বন্ধুদের দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আপনার সময় উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় হতে পারে, আবার মূল্যবান সময়গুলো নষ্টও হতে পারে। তাই বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকতে হবে।
৭. প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করুন
প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন আপনার জীবনকে সুন্দর করে তুলবে, তেমনি বিষিয়েও তুলতে পারে। প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন কাজকে সহজ করে তুলেছে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার করতে করতে মানুষ এখন প্রযুক্তির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যেমন- সকালে ঘুম থেকে উঠতে এলার্মের ব্যবহার করছেন যা আপনাকে কখন ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে তা কোনো প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে। কোনো কল বা মেসেজ আসলে তখন আপনাকে স্মার্টফোনটি ব্যবহার করতে বাধ্য করছে। এককথায়, অবচেতন মনে আপনি প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন। সচেতনভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করুন, নিয়ন্ত্রিত হতে যাবেন না। রুটিন কাজগুলোও এলেমেলো করে দিতে পারে যদি আপনি প্রযুক্তিতে আসক্ত বা নিয়ন্ত্রিত হন।
৮. সুযোগ পেলেই যেকোনো বিষয়ে দক্ষতা গড়ে তুলুন
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হরেক রকমের সমস্যা সৃষ্টি হয়। সেগুলো যদি আপনি নিজেই সমাধান করতে পারেন তাহলে সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে। দক্ষতা মানুষকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলে। আপনার মোবাইল বা ল্যাপটপ বা বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের কোনো ত্রুটি দেখা দিলো। ত্রুটি মেরামতের মতো টুকটাক দক্ষতা যদি আপনার মাঝে থাকে তাহলে কিছু হলেই আর মেকানিকের দ্বারস্থ হতে হবে না।
৯. নিজের সমালোচনা করুন
প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে কয়েক মিনিট নিজেকে নিয়ে ভাবুন। নিজের সমালোচনা করুন। সারাদিন যেসব কার্য সম্পাদন করলেন তার মাঝে কী কী ভুল ত্রুটি রয়েছে বা আরো ভালো কীভাবে করা যেত, কেন কার্য সম্পন্ন হলো না, আরো ভালোভাবে কাজগুলো কীভাবে সম্পন্ন করা যেত, আগামীকাল কোন বিষয়গুলোতে বেশি জোর দেয়া লাগবে, আজকের দিনের সময়টুকু কতটা ফলপ্রসুভাবে কাটিয়েছেন, নতুন কী কী শিখলেন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে নিজের সমালোচনা করুন। এভাবে সমালোচনা করলে আপনি আজকের দিনের চেয়ে আগামীকাল আরো বেশি ভালোভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারবেন। এভাবে নিজেই হয়ে উঠুন নিজের সমালোচনাকারী। কেউ ভুল ধরিয়ে দেবার আগে নিজের ভুল নিজে খুঁজে বের করুন এবং তা শুধরে নিন।
১০. নিজের অর্জনগুলোর একটি লিস্ট তৈরি করুন
ড্যান বেকারের মতো একজন হ্যাপিনেস এক্সপার্ট বলেছেন, নিজের ছোট থেকে বড় সব অর্জন বা সফলতার লিস্ট তৈরি করতে। এবং সেখান থেকে নিজের শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস খুঁজে নিতে।
সেই লিস্টে থাকতে পারে কোন পথশিশুকে খাবার কিনে দেয়ার কথা, কোন বন্ধুকে পড়া বুঝতে সাহায্য করা, কোন কুইজে ভাল গ্রেড পাওয়া, বাসার বাজারটা নিজ হাতে করা, মাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়ানোর মতো সাধারণ অর্জনগুলো।
এই লিস্টই আমাদের নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পজিটিভিটি নতুন করে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
১১. ছুটির দিনটি থাকুক স্কিল শেখার জন্য
অনেকেরই নানারকম শখ রয়েছে- কেউ গিটার বাজানো শিখতে চায়, কেউ ইউটিউবার হতে চায়, কেউ প্রোগ্রামিং শিখতে চায় ইত্যাদি। কিন্তু কেন যেন আমাদের অনেকেরই সেই শখের বিষয়গুলো শেখা হয়ে উঠে না।
সবচেয়ে কমন অজুহাত- “সময় পাই না!” অথচ কেবল শুক্র-শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো ধরলেও আমরা বছরে ১০৪ দিন ছুটি পাই! একটু প্ল্যান করে আগালেই কিন্তু এই সময়টুকু চমৎকার কাজে লাগানো যায় বিভিন্ন স্কিল শেখার মাধ্যমে।
সেটি হতে পারে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় স্কিল- গাড়ি চালানো, সাঁতার কাটা, ফার্স্ট এইড ট্রেইনিং থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত স্কিল- মাইক্রোসফট এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট, ভিডিও এডিটিং ইত্যাদি। ১০৪টি ছুটির দিন ঠিকভাবে কাজে লাগালে বছরশেষে আপনি আর দশজনের চেয়ে একদম ১০৪ ধাপ এগিয়ে থাকবেন!
১২. ভ্রমণ
ভ্রমণ বলতেই আমাদের মাথায় চলে আসে পাহাড়ে বা সাগরের তীরে একদল মানুষ সানগ্লাস, থ্রি কোয়ার্টার আর হাওয়াই শার্ট পরে ঘুরতে এসেছে এবং প্রতি মিনিটে মুহুর্মুহু সেলফি তুলে চলেছে! ভ্রমণে কিন্তু দেখার চেয়ে অনুভবের ব্যাপকতা অনেক বেশি।
পৃথিবীতে ১৯৫টি দেশ রয়েছে এবং এই ১৯৫টি দেশে প্রায় ৭০০০টি ভাষা রয়েছে, প্রত্যেকটি ভাষার সাথে রয়েছে অনেক অনেক চমকপ্রদ গল্প – একজীবন শুধু ভ্রমণ করে কাটিয়ে দিলেও সবগুলো গল্প শুনে শেষ করা সম্ভব নয়!
ভ্রমণের সবচেয়ে চমৎকার দিকটি হচ্ছে নতুন নতুন মানুষের সাথে মেশার সুযোগ। তাদের গল্পগুলো জানা, তাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, জীবনযাত্রার ধরণ ইত্যাদির সাথে পরিচয়ে যেই অভিজ্ঞতা জমা হয় ঝুলিতে সেটি যে কখনো সত্যিকারের ভ্রমণ করেনি তাকে বলে বুঝানো সম্ভব নয়!
পৃথিবীর বিশালতার কাছে গেলেই একমাত্র উপলব্ধি করা যায় আমরা আসলে কতো ক্ষুদ্র, কতো তুচ্ছ। ভ্রমণ আমাদের মনের সংকীর্ণতা দূর করে দেয়, আত্মাকে করে তোলে প্রশস্ত, জীবনটাকে সত্যিকারের উপভোগ করতে শেখায় প্রতিটি পদক্ষেপে।
তাই বছরে অন্তত তিনবার নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণ করা আমাদের সবার জন্যই প্রয়োজন।
Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador-TES
Dept. of Textile Engineering
NITER (10th batch)