বিষণ্ণ এক রাত! হাজারো স্বপ্ন বুনতে থাকা একজন ভর্তিযোদ্ধা তিনশো একাত্তর কি:মি রাস্তা পাড়ি দিয়েছিলো নতুন এক ক্যাম্পাস, এক নতুন জগতের হাতছানিতে। হেমন্তের রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল! দূরপাল্লার বাস হতে নামলো সে। বোধহয়, এতোদিন কল্পনায় হাতড়াতে থাকা হাজারো সংশয়ের অবসান ঘটলো।
সুদীর্ঘ প্রবেশদ্বার, মাথা উঁচিয়ে দেখতে পেলো, “National Institute of Textile Engineering & Research” লেখাটি অভ্যর্থনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, সাথে তার বাবা ; যিনি সর্বদা বটবৃক্ষের মতো ছায়া হিসেবে থাকেন।
প্রধান ফটক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই হাতের বামে “কাজী নজরুল ইসলাম থিয়েটার” নামের কারুকার্যময় একটি নেমপ্লেটে চোখ আটকে যায় এবং লাল ইটের ইমারতগুলোর দিকে সে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে। সরু এই রাস্তা ধরে হাঁটছে আর দেখছে, আট-নয় ফুটের দেয়ালগুলো যেন এক একটি শিল্পীর জানান দিচ্ছে। রাস্তার এক পাশের দেয়ালে দেয়ালে মুগ্ধতা ছড়ানো আর অন্যপাশ স্মরণ করিয়ে দিলো জীবনানন্দের “ “যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস – আকাশ তোমার। জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে পারো তুমি।”
নিটারের ছোট্ট ক্যাফেটেরিয়া দেখে ভবিষ্যতের তাড়াহুড়োর সকালের নাস্তা করার কিছু মুহূর্ত কল্পনায় ব্যস্ত ছিলো সে। একটু সামনে যেতেই দেখতে পেলো, দেয়ালে দেয়ালে কাব্য লিখছিলো ঘাসফুলেরা, আর হরেক রকমের গোলাপ জানান দিচ্ছিলো তাদের বিমোহিত অস্তিত্বের কথা। আরেকটু সামনেই চোখে পড়লো ছোট্ট একটি শহীদ মিনার! বাংলা ভাষার জন্য লড়াইয়ের প্রতিটি ঘটনা তার নিউরনে অনুরণন সৃষ্টি করছিলো।
আরেকটু এগোতেই “National Institute of Textile Engineering & Research” লেখাটি দ্বিতীয়বারের মতো স্বাগত জানালো তাকে। প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন-১, দ্বিতীয় তলার লাইব্রেরি, ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং শেড, এক মস্ত জেনারেটর রুম, একাডেমিক ভবন-০২, ছাত্র হোস্টেল, ছাত্রী হোস্টেল; সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ, একইসাথে অ্যাড্রিনোকর্টিকোট্রফিক হরমোন এবং অক্সিটোসিন হরমোনের নি:সরণ খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলো সে।
নিটারের প্রতি তার অন্যরকম মুগ্ধতার কেন্দ্রে ছিলো চোখ শীতল করা কাঠগোলাপের অনিন্দ্য সৌন্দর্য! আর কোনো পিছুটান ছিলো না তার। সৌভাগ্যক্রমে এই ব্যক্তিটি আমি, আমার অনন্য সত্তা।
হেমন্তের হালকা কুয়াশায় অনিন্য সুন্দর কাঠগোলাপ, শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে লুকোনো নিটার, হরেক রকমের গোলাপ এবং মিষ্টি সুগন্ধ, কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি শিক্ষকের সাথে জ্ঞানার্জনের এই যাত্রা চলছেই। হিসেব ছাড়া কতো সকাল, দুপুর কাটিয়েছি লাইব্রেরিতে, হাজারো বইয়ের সংগ্রহ জানার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয়।
ফিজিক্স ল্যাবের ফ্লাই হুইল, টিউনিং ফর্ক, মিটার স্কেল এবং প্রিজমের সাথে কতো উপোস সকাল কাটিয়েছি হিসেব নেই। হিসেব নেই কতো দুপুর না খেয়ে কাটিয়েছি ড্রয়িং ল্যাবের টি-স্কেল, সেট স্কয়ারের সাথে; ইনঅর্গানিক ল্যাবের ক্যাটায়ন, অ্যানায়ন,স্প্যাচুলা, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, অ্যামোনিয়ার সাথে, মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ ল্যাবের হ্যান্ড টুলস, ড্রিলিং মেশিন, গ্যাস ওয়েল্ডিং এর সাথে।
বসন্তের নতুনত্ব, নবীনবরণ এবং পিঠা উৎসব, নিটারডস আয়োজিত নিটার ইন্টার ভার্সিটি ডিবেট প্রোগ্রাম থেকে শুরু করে প্রতিটি আয়োজন বোধকরি ছিলো আমার জন্য, আমাদের জন্য। এই এতোদিন কাটিয়ে ফেলেছি , আমি আজ নিজের মধ্যেই নতুনত্ব খুঁজে পাই। এই ১৩.০৬ একর পরিধি আমায় সমুন্নত করেছে!
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যাচমেটদের কালচার জানছি, কালচারাল ক্লাবের সাথে আবৃত্তির এক অদম্য যাত্রা, মাস্তুলের সাথে থেকে সিনিয়রদের জীবনযাত্রা নিয়ে নানান অভিজ্ঞতা সংগ্রহ, নিসাসের সাথে রিপোর্ট লেখালেখির যাত্রা শুরু; এ সবই নিটারের অবদান। নিটার আমায় সমৃদ্ধ করেছে, বাস্তবতা শিখিয়েছে, জানিয়েছে জ্ঞান অর্জনের সঠিক পন্থা এবং এর সঠিক ব্যবহার, আমায় শিখিয়েছে স্বীয়শক্তি ধারণ করতে, স্বকীয়তা বজায় রাখতে, উপলব্ধি করিয়েছে কিভাবে নিজেকে আরো বিনয়ী হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়, কিভাবে নিজের দূর্বলতাকে শক্তিতে রূপান্তর করতে হয়।
আমি সুনিশ্চিত, আমি আত্মবিশ্বাসী, আমি গর্বিত – আমি নিটারিয়ান।
লাবিবা সালওয়া ইসলাম
ডিপার্টমেন্ট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং,
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ।