প্রিন্টিং হলো নির্দিষ্ট নকশা বা ডিজাইনে ফেব্রিক গুলোতে একটি নির্দিষ্ট অংশে রঙ প্রয়োগের একটি শিল্প-কর্ম। বর্তমানে টেক্সটাইল শিল্পে প্রিন্টিং একটি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে যা সবারই জানা। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে টেক্সটাইল শিল্পে উদ্ভাবনী প্রিন্টিং প্রযুক্তির জন্য একদিন এমন হবে যে, আমাদের আর ডাইং শিল্পের প্রয়োজন হবে না।
বিশ্বের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য নিশ্চিত করার জন্য, টেক্সটাইল শিল্পে ইকো প্রিন্টিং একটি উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা। ইকো প্রিন্টিং এ বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক উপাদান যেমন; উদ্ভিদ উপাদান থেকে প্রিন্টীং পেস্ট তৈরি করে তা নির্দিষ্ট ডিজাইনের মাধ্যমে কাগজ বা ফেব্রিকে স্থানান্তরিত করা হয়।
ফেব্রিকে ইকো প্রিন্টিংয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ:
★ ফেব্রিক পরিষ্কার করা।
★ ইকো প্রিন্টিং এ প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ উপকরণ (পাতা ও ফুল) ভিজিয়ে নেওয়া।
★ উদ্ভিদ উপকরন অর্থাৎ পাতা এবং ফুলগুলোকে ফেব্রিকে রেখে রোল আকারে ভাঁজ করা।
★ রোল করা ফেব্রিকটি ভারী রোলারের মধ্যে দিয়ে চালনা করতে হবে।
★ ফেব্রিকের রোল গুলোকে উচ্চ তাপমাত্রার বাষ্প দিয়ে ভাপ দেওয়া।
ইকো প্রিন্টিং এর জন্য বহুল ব্যবহ্রত একটি সুলভ উপাদান হলো গাঁদা ফুল। আজকে আমরা কটন ফেব্রিকের সাথে গাঁদা ফুলের প্রিন্টীং নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রিন্টিং পেস্ট তৈরিতে গাঁদা ফুল:
আমাদের ভারতীয় সভ্যতায় প্রিন্টীং এর কারুকার্য একটি অনন্য স্থান দখল করে আছে। প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে প্রিন্টিং প্রক্রিয়া, সেই ১০ম শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। সিন্থেটিক রঙ থেকে কারসাইনোজেনিক ইফেক্ট অর্থাৎ ক্যান্সারের সম্ভাবনার কারণে, গ্রাহকরা প্রাকৃতিক রঙের দিকে আকৃষ্ট হন। এছাড়াও এগুলি সিন্থেটিক ডাই এর মত বিষাক্ত নয়, মাটিতে পচনশীল এবং পরিবেশের ক্ষতি করে না।
প্রাকৃতিক রঞ্জক (ডাই) গুলো মূলত প্রাণিজ বা উদ্ভিজ্জ উপাদান থেকে নিষ্কাশন করা হয় যেখানে কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয় না। আর প্রাকৃতিক রঞ্জকগুলির (ডাই) এর সাধারনত ফেব্রিকের সাথে যুক্ত হওয়ার কোনো আগ্রহ থাকে না। তাই এইখেত্রে এক বিশেষ ধরনের ক্যামিকেল ইউজ করতে হয় যার নাম মরডেন্ট। মরডেন্ট হিসেবে এইক্ষেত্রে মূলত ধাতব লবণ ব্যবহার করা হয়। যা ফেব্রিকের সাথে, ন্যাচারাল ডাই এর বিশেষ ধরনের বন্ড (মেটাল কমপ্লেক্স বন্ড) তৈরি করতে সাহায্য করে।
এখানে গাঁদা ফুলের “Tagetes Erecta” নামের একটি প্রজাতি নির্বাচন করা হয়েছে। কটনের জন্য মানসম্পন্ন প্রিন্টিং পেস্ট তৈরি করতে ফুলের পাপড়ি ব্যবহৃত হয়।
উপাদান নির্বাচন:
গাঁদা ফুলের পাপড়িগুলো ছায়ায় শুকানো হয় এবং গুঁড়া করা হয় যা প্রিন্টিং পেস্টের ডাই সোর্স হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ফেব্রিক নির্বাচন:
যেহেতু এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, তাই এখানে যেকোনো ধরনের সেলুলোজিক ফেব্রিক ব্যবহার করা যেতে পারে। গাঁদা ফুল হতে প্রাপ্ত রঞ্জক কে স্ট্যান্ডার্ড প্রিন্টিং রেসিপির মাধ্যমে ফেব্রিকের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
প্রিন্টিং পেস্ট প্রস্তুতকরণ:
ফুলের পাপড়িগুলোতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে জল মিশ্রিত করা হয়। এইখেত্রে পি.এইচ. ৭ বা সল্যুশন কে নিউট্রাল করে রাখতে হবে। পানি অপসারণের জন্য, মিশ্রণটিকে নাইলন কাপড় দিয়ে ছাঁকা হয়। নিষ্কাশিত দ্রবণটি উত্তপ্ত করা হয় এবং প্রিন্টিং পেস্ট তৈরির জন্য হাইগ্রোস্কোপিক এজেন্ট, প্রিজারভেটিভ, থিকেনার এর মত ইত্যাদি কেমিক্যালের সাথে মিশ্রিত করা হয়। বলে রাখা ভালো যে, এই প্রিন্টিংয়ের রেসিপিটি ভিন্ন ভিন্ন ফাইনাল প্রোডাক্টের জন্য ভিন্ন হতে পারে।
প্রিন্টীং পেস্টে উপাদানগুলির অনুপাত এবং পরিমাণ, ফাইনাল প্রোডাক্টের মানের সাথেও পরিবর্তিত হয়। এরপর পেস্টটিকে খুব সাবধানে নাড়াতে হয় যেন সমান ঘনত্বের পেস্ট তৈরি করা যায়। ফেব্রিকে প্রিন্টিং পেস্ট ফিক্স করতে সাত ধরনের মর্ডান্ট ব্যবহার করা হয়। এগুলো হলো অ্যালুমিনিয়াম সালফেট, ফেরাস সালফেট, লেড অ্যাসিটেট, পটাশিয়াম ডাইক্রোমেট, স্ট্যানাস ক্লোরাইড, জিঙ্ক ক্লোরাইড এবং কপার সালফেট। প্রিন্টিং পেস্টের ওজনের উপর ভিত্তি করে মর্ডান্টস গুলো নির্বাচন করা হয়।
স্কাওয়ারিং-কৃত ফেব্রিকে স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে প্রিন্টিং করা হয়। অবশেষে, ফেব্রিকটি শুকানো হয় এবং এটি ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় শুকানো হয়। এরপর প্রিন্টিং পেস্ট গুলোকে ফেব্রিক থেকে সরানোর জন্য স্যাম্পল গুলোকে ঠান্ডা পানি দিয়ে ধোয়া হয় (কোল্ড ওয়াশ)।
ইকো প্রিন্টিং একটি টেকসই টেক্সটাইল অ্যাপ্লিকেশন প্রসেস হিসাবে স্বীকৃত:
ইকো প্রিন্টিং একটি টেকসই টেক্সটাইল অ্যাপ্লিকেশন কারণ এখানে প্রাকৃতিক রঙ এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। ইকো প্রিন্টিং এর মাধ্যমে পরিবেশ-বান্ধব এবং স্বল্প ব্যয় ভিত্তিক নান্দনিক পণ্য উৎপাদন করা যায় যার বাজার প্রতিযোগিতার বিপরীতে বিশাল সামাজিক মূল্যও রয়েছে।
এই অ্যাপ্লিকেশন ব্যবসার স্থায়িত্বকে নিশ্চিত করতে পারে। ইকো-প্রিন্টিং পদ্ধতিতে আমরা প্রিন্টিং পেস্ট ধোয়া পানি কে পুনরায় ব্যবহার করতে পারি। এখানে ইকো প্রিন্টিং এর কাঁচামাল প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই অ্যাপ্লিকেশন থেকে, আমরা আমাদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে পারি কারণ এইখানের প্রত্যেকটি কাঁচামাল সহজলভ্য এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য।
উপসংহার:
অবশেষে এটি বলা যেতে পারে যে ইকো-প্রিন্টেড টেক্সটাইলগুলো ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটিকে নান্দনিক বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে ও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটির ভাল স্থায়িত্ব এবং UV প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা রয়েছে যা ক্রেতাকে পণ্যটি কিনতে উৎসাহিত করতে পারে।
Writer Information:
Name: Mehbuba Afrose Moon
Institute: Primeasia University
Department: Textile Engineering
Batch: 201
Email: [email protected]