বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যান কর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর ।
তেমনি পোষাক শিল্প কিংবা সুতা আবিষ্কারের শুরুটাও নারীদের হাত ধরে। সে সময় ফ্যাশন নয় বরং লজ্জা নিবারনটাই ছিল মুখ্য। তারাই প্রথম প্রকৃতি থেকে লজ্জানিবারন করে একটি সভ্য সমাজের সূচনা করেছিল। তারা পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে গাছের ছাল,পাতা থেকে পোষাক তৈরী করে যা আজকের টেক্সটাইল শিল্পের একটি অন্যতম অংশ।
সুতা হলো টেক্সটাইল শিল্পের প্রধান কাঁচামাল । আবার সুতা তৈরীর কাঁচামাল ‘আঁশ বা তন্তু’ যা টেক্সটাইল শিল্পে ফাইবার নামে পরিচিত । কিছু আঁশ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় আবার কিছু আঁশ মানব সৃষ্ট। প্রাকৃতিক ফাইবারগুলি বহু শতাব্দী ধরে ফ্যাশন দুনিয়ার প্রতিটি প্রগতিশীল পদক্ষেপে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে,যার ফলে এদের চাহিদা বাড়ছে।প্রাকৃতিক ফাইবার পাওয়া যায় এমন কিছু উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – কলা বা পাটের ছাল থেকে , খেজুর বা স্ক্রু পাইনের পাতা থেকে, তুলার বীজ থেকে, সিকি বা মধুরকাটি ঘাস থেকে,আখ বা বাঁশ গাছ থেকে, মাকড়সার লালা , রেশমের গুটি প্রভৃতি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন “ আম হইতে আঁটি পর্যন্ত কোন অংশই ফেলনা নয়‘’ অর্থাৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি কোন কিছুই ফেলনা নয়,আগাগোড়াই ব্যবহার যোগ্য। আখের ক্ষেত্রেও ঠিক সেরকমই। আখ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে “ ইক্ষু” থেকে। একে বাঁশ বা ঘাসের জাতভাই বলা চলে। আখের বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum Officinarum ।
আখ সংগ্রহের পর আখ থেকে রস আলাদা করা হয় । এরপর বাকী থাকে আখের ছোবড়া, যাকে আজ থেকে ১০ বছর আগেও বর্জ্য পণ্য হিসাবে ফেলে দেওয়া হতো। এখন প্রাকৃতিক বর্জ্য ফেলানোর বা পুড়িয়ে দেওয়ার দিন শেষ। কারন বর্তমানে অভিনব তন্তুগুলির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে টেক্সটাইল শিল্পে উদ্ভাবনী ধারণা বাড়ছে। যার ফলে আখ এখন পোশাক শিল্পেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
আখের ছোবড়া বিভিন্ন ধরণের বিল্ডিং বোর্ড, ইথানল এবং পলিপ্রোপিলিন কম্পোজিটগুলির উৎপাদনে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বার্ষিক বিশ্বব্যাপী আখের উৎপাদন ৮০০ মিলিয়ন টন, যার ফলস্বরূপ ২৪০ মিলিয়ন টন-ই হচ্ছে ছোবড়া । আখের ছোবড়া একটি জটিল উপাদান যার প্রায় ৫০% সেলুলোজ, ২৫% হেমিসেলুলোজ এবং ২৫% লিগিনিন।
আখের ছোবড়া টেক্সটাইল রেইন ফাইবার যেমন ভিসকোস মডেল এবং লায়োসেল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ছোবড়া গুলো যখন ছেঁটে ফেলা হয় তখন পরিবেশবান্ধব রাসায়নিক বা অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সাথে মিশে ভেঙ্গে যায় এবং পরে এটি যখন তরল আকারে থাকে তখন ছোট গর্তের মাধ্যমে এটি খুব উচ্চ চাপে গুলি করা হয়। ফাইবারের এই দীর্ঘ স্ট্র্যান্ডটি তখন শক্ত করে সুতোগুলি কাটা হয়। রেয়ন তন্তু এইভাবে উৎপাদিত হয়। যেহেতু রেয়নটি জৈবিকভাবে তৈরি পলিমারগুলো থেকে উৎপাদিত হয়, তাই এটি একটি আধা-সিন্থেটিক ফাইবার হিসাবে বিবেচিত হয়। আখের রেয়ন কাঠের সজ্জা রেয়নের চেয়ে চকচকে।
আখের ছোবড়ায় মনোযোগ বাড়ানোর অন্যতম কারণ হল কৃষি অবশিষ্টাংশ নিষ্পত্তি করা এবং আখ শিল্প থেকে লাভ বৃদ্ধি। টেক্সটাইল শিল্পগুলি আখের ফাইবারের ব্যবহার অতিমাত্রায় গ্রহণ করা শুরু করছে। কিছু গুণ রয়েছে যা টেক্সটাইলের উদ্দেশ্যে একটি ফাইবারকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। কিছু প্রাথমিক গুনাবলীর মধ্যেমে ফাইবারের দৈর্ঘ্য তার প্রস্থ্য অপেক্ষা কয়েকশত গুণ হওয়া উচিত কারণ এটি নিশ্চিত করে যে সুতাগুলি তৈরি করতে যেনো ফাইবারগুলি একসাথে পাকানো যায়। ফাইবারের আসল দৈর্ঘ্যও তাৎপর্যপূর্ণ। আখের ফাইবার লক্ষণীয়ভাবে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের হতে পারে,তবে এটি ৬ মি:মি: হতে ১২ মি:মি: এর মাঝে হওয়া উচিত।
নিষ্কাশিত ফাইবার বান্ডিলগুলো দৈর্ঘ্য নিষ্কাশন শর্ত এবং নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। ফাইবার বান্ডিল প্রস্থ দ্বারা নির্ধারিত হয় সূক্ষ্মতা। ঘুরানো এবং বয়ন প্রক্রিয়া সহ্য করার জন্য আখের মন্ড থেকে প্রাপ্ত ফাইবারগুলিকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে। ফাইবার শক্তি সাধারণত টেনসিল শক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয় যা ‘পজেটিভিটি বা ধনাত্মকতা’ হিসাবে পরিচিত। আখের তন্তুগুলির সংরক্ষন নিষ্কাশন শর্ত অনুযায়ী পৃথক করা হয়।
আখের ছোবড়া প্রাকৃতিক ফ্যাব্রিক তন্তুগুলির সংমিশ্রণ উৎপাদন করতেও ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক ফাইবারের কয়েকটি সংমিশ্রণ অটোমোবাইল শিল্প, টেক্সটাইল, নির্মাণ সামগ্রীর জন্য অজৈব এবং জৈব ম্যাট্রিক্স সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয় এবং খুব সম্প্রতি প্রাকৃতিক তন্তুগুলির দ্বারা তৈরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য সংমিশ্রণগুলি থার্মোপ্লাস্টিক পলিমারের সাথে জড়িত।
পোশাকের কাজে আখের আঁশ উৎপাদন করার জন্য জাপানিদের প্রাধান্য ছিল । জাপানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সেরা মানের জিন্স তৈরীর লক্ষ্যে আখ এবং সেলভেজ ডেনিম (এক প্রকার মোটা সুতা কাপড়) এর মিশ্রণ ব্যবহার করে। এটি একটি খুব সাধারণ ঘাস, যা সারা পৃথিবীতে উৎপাদন করা হয়। জাপানি সংস্থাগুলির আখের আঁশগুলিতে মিষ্টি সরগাম মিশ্রিত যার ফলস্বরূপ এটি ফ্যাব্রিককে একটি মিষ্টি গন্ধ দেয় যার ফলে পরবর্তী সময় থেকে আখের ফ্যাব্রিক
বিশ্বব্যাপী সফলতা লাভ করেছে।
আখের আঁশ থেকে তৈরি ফ্যাব্রিকগুলো পোষাক তৈরিতে বেশ সুবিধাজনক। ফলে আজ বিশ্বব্যাপি আখের ফাইবার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।অন্যান্য বস্তু থেকে প্রাপ্ত সিন্থেটিক ফাইবারের চেয়ে আখের ফাইবার বেছে নেওয়াটা বেশ ফলপ্রসূ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, টেক্সটাইল ব্লগ ইত্যাদি।
Writer Information:
Sadia Naznin Ria
Dept of Yarn Engineering
Arpita Saha
Dept of Apparel Engineering