ফ্যাশন:
ফ্যাশন হচ্ছে নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে ও ইতিহাসের নির্দিষ্ট কোনো পর্বে সেখানকার জনসাধারণের মধ্যে বিরাজমান সৌন্দর্য ও শৈলীর বহুল গৃহীত ও বহুল প্রচলিত অভিব্যক্তি।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত স্টাইল ও ফ্যাশনের বিবর্তন ও ক্রমবিকাশের মাঝে লুকিয়ে আছে মানবসভ্যতার ইতিহাস। স্টাইল একজন ব্যক্তির মধ্যে শ্রেণিভুক্ত থাকে কিন্তু যখন ঐ স্টাইল কে সবাই গ্ৰহণ করে তখন তা হয় ফ্যাশন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে আমাদের ফ্যাশন ভাবনায়। পুরোনো ক্যালেন্ডারের মতোই আগের জনপ্রিয় অনেক ফ্যাশনও বিদায় নেয়। সেখানে নতুন বছরের সাথে যুক্ত হয় ফ্যাশনের নতুন ট্রেন্ড।তবে অতীতের সাথে যদি বর্তমান ফ্যাশন ট্রেন্ডের তুলনা করতে যাই, তাহলে এ যুগের ফ্যাশন ইতিহাসে দাগ কেটে যাওয়া ফ্যাশন ট্রেন্ড অতি সহজ মনে হবে।এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে আমাদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের আলাদা, সুন্দর আর আর্কষনীয় করতে কি এমন করেছেন?
চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক ইতিহাস ঘেরা পূর্বপুরুষদের সেই ফ্যাশন সম্পর্কে-
হাবল স্কার্ট:
ইতিহাস ঘাঁটলে যদি উদ্ভট ফ্যাশন ট্রেন্ড বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে হাবল স্কার্ট।এই স্কার্ট এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে,কে কিভাবে কখন এই স্কার্ট আবিষ্কার করেছিল,এ সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় সবাই এর কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত।
১৯১০ সনের দিকের কথা, যখন নারীরা নিজেদের পোশাকে রুচিশীলতা ফুটিয়ে তুলতে অতীতের অতিরিক্ত কাপড়, পোশাকের স্তর এবং বিশালাকার কোমরে জড়িয়ে থাকা কাপড়ের শৃঙ্খল পায়ে মাড়িয়ে তার পরিবর্তে তাদের গোড়ালি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে এক করে ফেলতে শুরু করে।এটিই সেই বিখ্যাত হাবল স্কার্ট। হাবল স্কার্ট হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত এতটাই টাইট ছিল যে, এটি পরার কারণে আপনি কেবলমাত্র অতি সামান্য ধাপে পা ফেলে হাঁটতে পারবেন। অতিসত্বর হাবল স্কার্ট প্যারিস থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে জমাতে ফ্যাশন স্ক্যান্ডালে পরিণত হয়। কার্টুনিস্টরা হাবল স্কার্ট পরিহিত নারীদের হাঁটার ছবি আঁকতে শুরু করেন এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসে বিশাল প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয় পোশাক শিল্পে এই হাবল স্কার্টের প্রভাব নিয়ে, যার শিরোনাম দেওয়া হয় “An ungraceful and immodest freak of fashion.”কিন্তু এই ট্রেন্ড সহজেই হারিয়ে যায়নি, উল্টো এই স্কার্টের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে অতিসত্বর ট্রেন ও স্ট্রিটকারে পা দিয়ে ওঠার সিঁড়ি আরও কমিয়ে আনা হয়,যাতে করে হাবল স্কার্ট পরিহিত নারীরা গুটি গুটি পায়ে বাইরে যাত্রার জন্য নিশ্চিন্তে যানবাহনে উঠতে পারে।
দ্য আর্সেনিক ড্রেস:
আঠারো শতকে আর্সেনিক ভিত্তিক সবুজ রঙের পোশাক দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, আক্ষরিক অর্থে যা অনেকটা মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানোর সমান ছিল।এই অত্যন্ত বিষাক্ত পান্না সবুজ ক্রিস্টাল পাউডার ‘প্যারিস গ্ৰিন ‘ নামে পরিচিত ছিল,যা ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে পোশাকে ব্যবহার করা হতো।এই পোশাক এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে পরিধানকৃত ব্যাক্তিকে ডাক্তার এসে মৃত ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পোশাক ঐ ব্যাক্তির শরীরেরই থাকতো।
আঠারো শতকের এই আর্সেনিক-ভিত্তিক সবুজ রঙের পোশাক থেকে বিষ ধীরে ধীরে শরীরে মিশে চর্মরোগ, শরীরে ঘা-পাঁচড়া, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা এবং ক্যান্সারের মতো রোগের সৃষ্টি করে। প্রায় একশ বছর ধরে মানুষ এই সবুজ রঙের রঙিন পোশাক ব্যবহার করে আসছিল, পরবর্তীতে একজন রসায়নবিদ আর্সেনিক-ভিত্তিক এই সবুজ রং ‘প্যারিস গ্রিন’ ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন বলে মনে করেন এবং তখনই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা সামনে আসে। ফ্যাশন ট্রেন্ডের নামে যে মানুষ এতটা বছর নিজের শরীরে এবং ঘরে বিষ বহন করে আসছিল, তা সে সময় জনসম্মুখে প্রকাশ পায়।
ডিটাচেবল হাই-কলার:
‘ফাদার কিলার’ নামে খ্যাত ডিটাচেবল হাই-কলার উনিশ শতকে পুরুষের অত্যন্ত জনপ্রিয় ফ্যাশন ট্রেন্ড ছিল, যা স্টাড দ্বারা শার্টের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতো। এই হাই-কলারের প্রতি পুরুষের অতি আগ্রহ এটা প্রমাণ করেছিল যে, ফ্যাশন ট্রেন্ড অনুসরণ করতে কেবল নারীরা নয়, বরং পুরুষেরাও জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পিছপা ছিল না। দেখতে সাধারণ হলেও এই হাই-কলার এতো শক্ত এবং টাইট ছিল যে একজন মানুষের মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বন্ধ করে দিয়ে স্নায়বিক অস্থিরতা সৃষ্টি ও মস্তিষ্ক অকেজো করে ফেলতে সক্ষম।
১৮৮৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমের একটি প্রতিবেদনে বলা হয় যে, John Cruetzi নামক একজন ব্যক্তিকে পার্কে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত ব্যক্তির মাথা নুয়ে তার বুকের উপর ছিল এবং তার পরিহিত ভীষণ শক্ত ও টাইট হাই-কলার মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়েই ব্যক্তিটি মারা যান।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এসব কিছু জানার পরেও মানুষ শুধুমাত্র তাদের প্রাচুর্য ও সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই মারাত্মক ফ্যাশন ট্রেন্ড বহু বছর ধরে অনুসরণ করে আসছিল।
উৎস: গুগল, উইকিপিডিয়া, দৈনিক বাংলাদেশ।