কাপড় তৈরির জন্য সুতা প্রয়োজন। আর সুতা তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে যে সব তন্তু বা আঁশ ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে টেক্সটাইল ফাইবার বলে। বর্তমানে বস্ত্র শিল্পে অনেক ধরনের ফাইবার ব্যাবহার করা হচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু ফাইবার প্রকৃতিগত ভাবে পাওয়া যায় এবং কাপড় আবিষ্কারের প্রথম থেকেই সেগুলো ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাকৃতিক ফাইবার গুলোর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত ফাইবার হচ্ছে কটন বা তুলা।এটিকে প্রাকৃতিক সেলুলোজ ফাইবারও বলা হয়।কটন ফাইবার হলো ফাইবারের রাজা। প্রকৃতি থেকে সবচাইতে বেশি উৎপন্ন হয় এই কটন ফাইবার, এবং কটন ফাইবার হতে উৎপন্ন কটন ফেব্রিক দ্বারা তৈরি পোশাক মানুষের সবচাইতে বেশি কমফোর্ট প্রদান করে।
১৯৮০ সাল থেকে আফ্রিকা তুলা বাণিজ্যে দ্বিগুণ অংশগ্রহণ করে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫টি তুলা রপ্তানীকারক দেশগুলো হচ্ছে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং উজবেকিস্তান। তুলা উৎপাদনবিহীন আমদানকারীকারক দেশগুলো হচ্ছে – কোরিয়া, তাইওয়ান, রাশিয়া, হংকং এবং জাপান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কটনঃ
তুলা এবং বস্ত্র উৎপাদনে বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। মধ্যযুগে বাংলা সূক্ষ্ম সুতার মসলিনের জন্য বিখ্যাত ছিল। মসলিন শাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা চাষ করা হতো ঢাকার আশপাশের উঁচু জমিতে যেখানে বেশির ভাগ তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। বস্তুত ব্রিটিশ শাসনামলে মসলিনের উৎপাদন এবং ব্যবসা ক্রমান্বয়ে কমে যায়। ফলস্বরূপ উনিশশতকের শুরুর দিকে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তান শাসনামলে এদেশে তুলা উৎপাদনের প্রচেষ্টা খুব সীমিত ছিল। স্বাধীনতার আগে স্থানীয় বস্ত্রকলের জন্য কাঁচামালের জোগান দেওয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ করে করে দিলে স্থানীয়ভাবে তুলার উৎপাদনের গুরুত্ব অনুভূত হয়। সে সময় আমাদের বস্ত্র শিল্পগুলো কাঁচামালের অভাবে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই অবস্থায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর দূরদর্শী চিন্তার ফসল হিসেবে তাঁর একান্ত ইচ্ছায় বাংলাদেশে তুলা চাষের গুরুত্ব বিবেচনা করে স্বাধীনতার পর Resolution No. III Cotton-8/72-393 dt. 14th December ১৯৭২ মোতাবেক কৃষি মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি দেশে তুলার গবেষণা এবং তুলা চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে এবং বতর্মানে তৈরি পোশাকশিল্প ও জাতীয় অথর্নীতির অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তুলা একটি আঁশজাতীয় ফসল এবং এর বীজ হতে উপজাত হিসেবে ভোজ্যতেল ও খৈল পাওয়া যায়। তুলা বীজ হতে ১৫-১৭% ভোজ্যতেল ও ৮০% উন্নতমানের খৈল পাওয়া যায়। দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ১৮টি জিনিং শিল্পে প্রায় ১০০টি জিনিং মেশিন ও তুলার বীজ হতে তৈল আহরণের জন্য ১৫-২০টি ঊীঢ়বষষবৎ মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। অপরিশোধিত তেলকে পরিশোধনের মাধ্যমে ভোজ্যতেলে পরিণত করার জন্য ইতোমধ্যেই কুষ্টিয়ায় একটি রিফাইনারি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তুলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিগত কয়েক বছর যাবৎ দেশে তুলার উৎপাদন ক্রমবর্ধনশীল। তুলা চাষকে চাষিদের নিকট অধিকতর লাভজনক করার লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গবেষণা, সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও তুলার বাজারজাতকরণে চাষিদের সহায়তা প্রদানের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে ২০১৮-১৯ মৌসুমে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৪টি অঞ্চল, ১৩টি জোন ও ১৯৫টি ইউনিটের মাধ্যমে ৪০ জেলায় ৪৪১৮৫ হেক্টর জমিতে তুলা আবাদ করে ১,৭১,৪৭০ বেল আঁশ তুলার উৎপাদন করা হয়েছে। অর্থকরী ফসল হিসেবে তুলার আবাদ বস্ত্র শিল্পের প্রধান কাঁচামাল জোগানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের খাদ্য নিরাপত্তায় কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। তুলার বীজবপন থেকে শুরু করে বীজ তুলা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জিনিং পর্যন্ত মহিলা শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক দেশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের দেশে প্রায় ৮১ লাখ বেল তুলা আমদানি করা হয়েছে যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০,০০০ কোটি টাকা। তুলা চাষ বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ তৈরি পোশক রপ্তানিতে ২য় অবস্থানে রয়েছে। এই সেক্টরে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লক্ষ। দেশের প্রধান রপ্তানিশিল্পের সংকট মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ তুলা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সারা বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও তুলা ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। প্রথম তিন শীর্ষ অবস্থানে আছে—চীন, ভারত ও পাকিস্তান।
ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাডভাইজরি কমিটির তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীনের পোশাক ও বস্ত্রসহ অন্যান্য খাত ৮৫ লাখ টন তুলা ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া ভারত ৫৪ লাখ ২৩ হাজার ও পাকিস্তান ২৩ লাখ ৪৬ হাজার টন তুলা ব্যবহার করেছে। আর বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ বাংলাদেশ ব্যবহার করেছে ১৬ লাখ ৬২ হাজার টন তুলা।
তুলা ব্যবহারে শীর্ষ ১০ দেশের অন্যগুলো হচ্ছে—ভিয়েতনাম ১৫ লাখ ৩০ হাজার, তুরস্ক ১৪ লাখ ৮১ হাজার, ইন্দোনেশিয়া ৭ লাখ ৭৮ হাজার, যুক্তরাষ্ট্র ৭ লাখ ৬৮ হাজার, ব্রাজিল ৬ লাখ ৮০ হাজার এবং উজবেকিস্তান ৪ লাখ ৬৪ হাজার টন।
ব্যবহারের দিকে চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশ তুলা আমদানিতে দ্বিতীয়। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে পোশাক রপ্তানির পাশাপাশি তুলা উৎপাদনেও শীর্ষস্থানে আছে চীন। সেই চীনের কাছেই গত অর্থবছর তুলা আমদানির শীর্ষস্থানটি হারায় বাংলাদেশ। অথচ ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত তিনটি অর্থবছর তুলা আমদানিতে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। গত অর্থবছর চীন সর্বোচ্চ ২ কোটি ৭৭ লাখ বেল (৪৮০ পাউন্ড = ১ বেল) উৎপাদনের পাশাপাশি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার বেল তুলা আমদানি করে। তারপরই বাংলাদেশ ৭২ লাখ, ভিয়েতনাম ৭০ লাখ, তুরস্ক ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার, ইন্দোনেশিয়া ৩০ লাখ ৫০ হাজার, পাকিস্তান ২৫ লাখ ৫০ হাজার এবং ভারত ১৮ লাখ বেল তুলা আমদানি করেছে।
Watch Related Video Here https://www.youtube.com/watch?v=CYkDEJTeepQ https://www.youtube.com/watch?v=gYpJRAXeC0s
বর্ষন সাহা
আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি।
৩৯ তম ব্যাচ।