করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব শুধু আমাদের পোশাকশিল্পে নয় বরং পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে। উহান শহর নিষিদ্ধ থাকায় দেশের অভ্যন্তরেই ব্যাহত হচ্ছে জ্বালানি তেল সরবরাহ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে সূচকের দরপতন শুরু হয়েছে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে আসেন লাখ লাখ চীনা পর্যটক। চীনা পর্যটকরা অন্য যেসব দেশের পর্যটন খাতে অনন্য অবদান রাখেন, প্রায় সব দেশকেই এবার গুণতে হবে বড় ধরনের লোকসান। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে চীনেও আসতে পারছেন না পর্যটকরা। ফলে এর মধ্যে ধস নামতে শুরু করেছে দেশটির পর্যটন খাতে।
চীনের অন্যতম জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সরবরাহ ক্ষেত্র উহান শহর লকডাউন থাকায় জ্বালানী কেনা কমিয়ে দিয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রমাগত দর হারাচ্ছে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। সেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিশ্ব শেয়ারবাজারেও। ফার্মাসিউটিক্যালস, আর্থিক ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে দেশের বাইরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। কমছে শিল্পখাতের কার্যক্রম ও খুচরা বিক্রি। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক শিল্পেও। যা রীতিমত ভাবনার।
আমাদের দেশে তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা ষাটের দশক থেকে। এখন এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী শিল্পখাত। ষাটের দশকের শুরু পর্যন্ত ব্যক্তি উদ্যোগে ক্রেতাদের সরবরাহকৃত এবং তাদেরই নির্দেশিত নকশা অনুযায়ি স্থানীয় দর্জিরা পোশাক তৈরি করতো। শুধুমাত্র শিশুদের জামাকাপড় এবং পুরুষদের পরিধানযোগ্য গেঞ্জি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশক পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল না বললেই চলে। সত্তরের দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। তৈরি পোশাক শিল্পের অভ্যন্তরীণ বাজারও দ্রুত সম্প্রসারিত হয় এবং এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের আয় বৃদ্ধি পায় ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে। খাতটি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দ্রত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য মোট রপ্তানিতে ৫০% অবদান রেখে রপ্তানি আয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছিল। আশির দশকের শেষার্ধে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে অতিক্রম করে পোশাক শিল্প রফতানি আয়ে প্রথম স্থানে চলে আসে। ১৯৯৯ সালে এই শিল্পখাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১.৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের। যার মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই মহিলা। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সাথে সাথে বস্ত্র, সুতা, আনুসঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেটজাতকরণের উপকরণ ইত্যাদি শিল্পেরও সম্প্রসারণ হতে থাকে। এছাড়াও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্সুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ ধরনের নতুন পরোক্ষ-কর্মসংস্থান মূলত তৈরি পোশাক শিল্প কর্তৃক সৃষ্টি যার সুবিধাভোগী লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ।
আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের পথচলা কখনোই নির্বিঘ্ন ছিল না বরং অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েই এই শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই শিল্পকে নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। মূলত চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং ক্রমেই তা অন্য অনেক দেশেও ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে আপাতত অপাক্তেয় হয়ে পড়েছে গণচীন। ভয়ঙ্কর এ ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় চীনের সঙ্গে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলছে অন্যান্য দেশ। দেশগুলোর এমন সচেতনমূলক কার্যক্রমে সারাবিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সর্বাধিক জনবসতির এই দেশটি। ফলে দেশটির পর্যটন শিল্পে ধস নেমেছে; বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পণ্য লেনদেন তথা চীনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। চীনা নাগরিকদেরও অন্য দেশে প্রবেশে ভীষণ কড়াকড়ি চলছে।
মূলত বাংলাদেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। নানা রকম নিত্যপণ্যসহ তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য চীনের প্রতি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। দেশটির এই ‘একঘরে’ হয়ে পড়া মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে।
আমাদের দেশে তৈরি পোশাক খাতে যে কাঁচামাল আসে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করা হয়। নিটওয়্যার খাতেও প্রায় ১৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে গণচীন থেকে। কাপড়, পলি, জিপার, কার্টন, লেস, হ্যাঙ্গার, বোতাম; রঙ ও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং আরও অনেক এক্সেসরিজের ক্ষেত্রে আমরা দেশটির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে এসব কাঁচামাল আমদানীর ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থার অবসান না হলে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। চীন থেকে যে সব কাঁচামাল আমদানি হতো, সেগুলোর দাম দেশের বাজারে ইতোমধ্যেই ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে। ফলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন করে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি আমাদের দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের বড় ধরনের অশনিসংকেতই বলতে হবে।
মূলত, দেশের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোয় সর্বোচ্চ এক মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। আর বড় কারখানাগুলোয় বড়জোর দুই থেকে আড়াই মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে আমদানি বন্ধ থাকলেও এতদিন ধরে উৎপাদন চলায় অনেক কারখানারই মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, চীন থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের রপ্তানি খাতেও নেমে আসছে বিপর্যয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের পুরো রপ্তানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। পোশাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। দেশের বাজারে ডায়িং-প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার্য কাঁচামাল যেমন-রঙ, রাসায়নিক পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, অনেক বায়ার চীনের অর্ডার বাতিল করেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার কথা ভাবছেন; যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশে যদি উৎপাদনই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অর্ডার দিয়ে কী হবে ? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচামাল আনার এলসি দেওয়া
উদ্যোক্তারা বলছেন, অনেক বায়ার চীনের অর্ডার বাতিল করেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার কথা ভাবছেন; যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশে যদি উৎপাদনই বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অর্ডার দিয়ে কী হবে ? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচামাল আনার এলসি দেওয়া আছে, কিন্তু পণ্য আসছে না। কারখানার জন্য সময়মত পণ্য আসার কথা থাকলেও করোনা ভাইরাসের কারণে পণ্য আর আসেনি।
মূলত প্রতি মাসেই বিশেষ করে মাসের শেষ সপ্তাহে চীন থেকে পণ্য আসে। কিন্তু তা আসতে পানেনি। আর চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও আসার সম্ভাবনাও খুবই ক্ষীণ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বড় কারখারখানাগুলোও বেশি দিন টিকতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মূলত করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে দেশীয় বাজারে কাঁচামালের দাম ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে। ওভেন পোশাকের ২০-৩০ শতাংশ দেশীয় বাজারে উৎপাদন হয়, ৭০-৮০ শতাংশই চীন থেকে আসে। এ বিশাল পরিমাণ কাঁচামাল আপাতত বাংলাদেশে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া চীনের পণ্যের দাম দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দামের চেয়ে অনেক কম। আসলে চীনা নববর্ষের আগে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল দেশটি থেকে পণ্য আমদানির, সেগুলোর বিপরীতে অনেক পণ্য আসেনি। যেসব পণ্য এসেছে, সেসব বন্দর থেকে খালাস করা যাচ্ছে না। অফিস বন্ধ থাকায় চীনা কোম্পানীগুলো ডকুমেন্টস পাঠাতে পারছে না। ফলে বন্দরে ডকুমেন্স দেখাতে না পারায় পণ্য খালাস হচ্ছে না। পাশাপাশি এলসি খোলার আগে যে প্রাথমিক নথিপত্র দিতে হয়, তাও চীনে পাঠানো যাচ্ছে না। মোটকথা, পুরো চেইনটাই ভেঙে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর সর্বাধিক নির্ভরশীল বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে শুধু চীন থেকেই আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকার পণ্য। মূলত মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি হয়েছে চীন থেকে। দ্বিতীয় বৃহত্তর প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ এবং রপ্তানি কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। চীনের এ সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি আরও কমবে। এতে দেশের রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে। যা জাতীয় অর্থনীতি বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
চীন থেকে মূলত পোশাকশিল্পের কাঁচামাল, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, সরকারি প্রকল্পের সরঞ্জামাদি, আদা-রসুন, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য আসে চীন থেকে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল ফেব্রিকস, রাসায়নিক পদার্থ, কারখানার যন্ত্রপাতির প্রধান উৎস চীন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, চীনা নববর্ষ উপলক্ষে ছুটিশেষে ২ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে কল-কারখানা ফের চালুর কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ছুটি আরও ১০ দিন বাড়ানো হয়েছে। চীন সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কল-কারখানা ও অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। এ ছুটি আরও বাড়বে কিনা, তা নির্ভর করছে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, স্পর্শকাতর এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই বন্ধ থাকবে চীনের সব প্রতিষ্ঠান।
কার্টেসিঃtimenewsbd. com থেকে সংগ্রহিত