▪মানব সভ্যতার ইতিহাসে পোশাকের আবিষ্কার নিঃসন্দেহে এক অনন্য কৃতিত্ব। আদিম গুহাবাসী মানুষ যখন আসলে বুঝতে শিখলো নিজেদের লজ্জা নিবারণের প্রয়োজনীয়তা, আমরা ধরে নিতে পারি ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিলো সেই প্রয়োজনীয়তার বাস্তবায়ন। আজকের সভ্য মানুষ আর সেই আদিম মানুষের মধ্যে এই আকাশ-পাতাল পার্থক্য তৈরী করেছে আধুনিক পোশাক। আমাদের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার ২য় চাহিদাই বস্ত্র অর্থাৎ পোশাক। বুঝতেই পারছেন, পোশাক পরিচ্ছদ মানব সভ্যতার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এই পোশাক তৈরির পিছনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রকৃতি থেকে নিমিষেই পাওয়া যাচ্ছে। বাদ পড়েনি কলাগাছের বাকল।
▪পাট থেকে, রেশম থেকে সুতা তৈরি আমরা কমবেশি সবাই দেখেছি। কিন্তু কলাগাছের বাকল থেকেও নাকি তৈরি হচ্ছে সুতা! বছরজুড়ে পাহাড়ে কলার ব্যাপক ফলন হয়ে থাকে। এখানকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর অনেকটা কলা চাষের ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে পাহাড়ের কলা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন সমতল জেলায়। কলা বিক্রির করে এখানকার অনেকেরই ভাগ্য বদলে গেছে। সময়ের ব্যবধানে পাহাড়ে এখন বাণিজ্যিকভাবেও কলার উৎপাদন বেড়েছে। সমতল ও পাহাড়ী অঞ্চলে সময়ের সাথে সাথে বাণিজ্যিকভাবেও বর্তমানে কলার উৎপাদন বেড়েছে। কলা গাছের বিকল্প কোন ব্যবহার না থাকার কারণে কলার ছড়া কাটার পর কলা গাছও কেটে ফেলা হতো। তবে বর্তমান সময়ে পরিত্যাক্ত কলার বাকল থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ভালোমানের ফাইবার বা সুতা। একটি কলা গাছের বাকল থেকে কম করে হলেও ২০০ গ্রাম সুতা উৎপাদন করা যায়।
▪বিশেষ প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে বাকল থেকে আঁশ বের করে আনা হয়। সেই আঁশ পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় তুলার রোল। এরপর স্পিনিং মেশিনে দিয়ে তৈরি করা হয় সুতা। সেই সুতাতেই তাঁতের সাহায্যে কাপড় তৈরি করা হয়। কয়েকটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে এই সুতায় তৈরি পোশাক কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। কাপড়ের গুণগত মান উন্নয়নের জন্য মধুপুরে অত্যাধুনিক স্পিনিং মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। মান সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকলে কানাডাসহ আরও বেশকিছু দেশে এই কাপড় রপ্তানি শুরু করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। কলা গাছের বাকল থেকে তৈরিকৃত সুতা টেকসই ও মানসম্পন্ন। জুট বা কটনের সঙ্গে মিশ্রণের পরে এটি আরও টেকসই হয়। কলার বাকল থেকে প্রাপ্ত সুতা জুট বা কটনের সঙ্গে মিশ্রণে পেপার, হ্যান্ডি ক্রাফট, হ্যান্ড ব্যাগসহ নানা পণ্য তৈরি করা যায়। এছাড়াও কলার বাকল থেকে ফাইবার অংশ সংরক্ষণের পর অবশিষ্ট অংশ থেকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদন করা যায়। প্রতি কেজি ভার্মি কম্পোস্ট সারের মূল্য প্রায় ২০ টাকা।
▪একটি কলা গাছের বাকল থেকে কম করে হলেও ২০০ গ্রাম সুতা পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাঁচটি কলা গাছের বাকল থেকে অন্তত এক কেজি সুতা পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ফাইবাব বা সুতা উৎপাদনে একজন শ্রমিক ১৩ টাকা পেয়ে থাকেন। একজন শ্রমিক দৈনিক সর্বোচ্চ ৫০ কেজি পর্যন্ত সুতা উৎপাদন করতে পারেন।
▪যেভাবে তৈরী হয়ঃ
এটি তৈরী করার জন্য কলাগাছের ছাল (খোল) নরম হতে হয়। এ জন্য কয়েকবার ফসল দেওয়া বা গাছে মোচা আসার আগে কাটলে নরম খোল পাওয়া যায় বা পাতা নিয়মিত কাটলেও খোল নরম পাওয়া যেতে পারে । তখন ভালো খোল নির্ধারণ করতে হয়। খোল গুলোকে সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড বা কষ্টিক সোডা এর দ্রবনে সেদ্ধ করলে উপরিভাগে আশ আলাদা আশ পাওয়া যায়। অবশ্য পাটের মত শুধু পানিতে দু এক মাস ভিজিয়ে রাখলেও কাজ হয়। তাতেও আশ আলাদা হয়ে যায়। তবে কোয়ালিটি অত সুবিধার হয় না ও এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে এই এগুলো দিয়ে মোটা আশ পাওয়া যায়। যেগুলো টেবিলক্লথ সহ নানা ধরনের গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি করা যায়।
চাইনিজরা, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালিরা ও ভারতের কোরেলা রাজ্যের লোকেরা অনেক চিকন ফাইবার ও তৈরী করে মেশিনের মাধ্যমে। কান্ডের ছোট ছোট টুকরোকে মেশিনের সাহায্যে পিষে নরম করে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়া হয়। (মেশিনটি হুবুহু আমাদের দেশের গেন্ডারীর রস বানানোর মেশিনের মত)
এরপরে ব্লিচ করে রোদে শুকিয়ে নিলে আঁশগুলোকে অনেকটা রেশম সুতার মত দেখায়।
▪কলা গাছ থেকে সুতা তৈরি করার কারণঃ
নিম্নে উল্লিখিত কারণে কলা গাছ থেকে সূতা তৈরি করা হচ্ছে-
১. কলা গাছের কাঁচামাল সহজ লভ্য।
২. অল্প খরচে কলা কাছের বাকল থেকে সুতা তৈরি করা সম্ভব।
৩. শ্রমিক মুল্য তুলনামূলকভাবে কম।
৪. কম দামে উৎকৃষ্ট মানের পণ্য সরবরাহ করা যায়।
৫. কলাগাছের ছাল থেকে কাপড় বানানোর তন্তু, দড়ি, শৌখিন জিনিসপত্র এবং তাঁবু বানানোর জন্য উৎকৃষ্ট মানের সুতা বানানো যায়।
৬. প্রাকৃতিক তন্তুর মধ্যে কলা গাছ থেকে প্রাপ্ত তন্তু সবচেয়ে শক্ত।
৭. কলা গাছের আর্দ্রতা ধরে রাখা এবং ত্যাগ করার ক্ষমতা অনেক বেশি।
৮. কৃত্রিম তন্তুর বিকল্প হিসেবে এর ব্যবহার করা যায়।
পাহাড়ি এলাকায় কলাগাছ সহজলভ্য। ফলে এটি সুতা উৎপাদনের বড় সম্ভাবনাময় এলাকা। কলা গাছের বাকল থেকে তৈরি সুতা টেকসই ও মানসম্পন্ন। জুট বা কটনের সঙ্গে মিশ্রণে এটি আরো টেকসই হয়। কলার বাকল থেকে প্রাপ্ত সুতা জুট বা কটনের সঙ্গে মিশ্রণে পেপার, হ্যান্ডি ক্রাফট, হ্যান্ড ব্যাগসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরি করা যায়।
Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador – TES
NITER (10th Batch)