কেনাফ(Kenaf) একটি আঁশজাতীয় ফসল। যার বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus cannabinus. এটি মালভাসি পরিবারের একটি উদ্ভিদ যা ডেকান হেম্প, গিনি হেম্প বা মেস্তা এবং জাভা পাট নামে পরিচিত।
ইতিহাসঃ
বহুবিধ গুণসম্পন্ন এই উদ্ভিদটির আদি বাসস্থান নিয়ে রয়েছে দ্বিমত। কিন্তু অনেকের মতে এটি আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত ৪০০০ বছরের পুরোনো ফসল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরে যখন পাটের যোগান কমে যায়, তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কিউবা, মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশে কেনাফ চাষ শুরু হয়। প্রধানত ভারত, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডে এটি জন্মালেও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং আফ্রিকা ও দক্ষিণ ইউরোপের কিছু অঞ্চলে কেনাফের আবাদ হয়ে থাকে। তবে কেনাফ উৎপাদনে ভারত ও চীনের স্থান শীর্ষে।
বাংলাদেশে উৎপত্তিস্থলঃ
বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান জেলা।
কেনাফ গাছের গঠনঃ
পাটের মতো লম্বা, ঢেঁড়সের পাতার মতো পাতাবিশিষ্ট কেনাফ গাছ প্রায় ৩ফুট লম্বা এবং আধা ইঞ্চির মতো মোটা হয়। উচ্চতা সাধারণ পাট গাছের মতো হলেও এর কান্ডগুলো পাটের তুলনায় মোটা। এই গাছের মূল মাটির ১০-১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে।
- কেনাফ গাছের কান্ড ১-২ সেন্টিমিটার ব্যাসের শাখাবিহীন কিংবা শাখাযুক্ত।
- পাতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা, লোবযুক্ত।
- ফুল সাদা, হলুদ বা পার্পেল বর্ণের। ফুলের ব্যাস ৮-১৫ সেন্টিমিটার।
- ফল একধরনের ক্যাপসুল যাতে কয়েকটি বীজ থাকে। ফলের ব্যাস ২ সেন্টিমিটার।
আঁশ বা ফাইবার সংগ্রহঃ
কেনাফ থেকে দুই ধরনের আঁশ পাওয়া যায়। যার মধ্যে;
- বাকল থেকে ৪০% স্থূল আঁশ বা বাস্ট ফাইবার পাওয়া যায়।
- কাস্টল অংশ বা জাইলেম থেকে ৬০% সূক্ষ্ম আঁশ বা কোর ফাইবার পাওয়া যায়।
কেনাফ বছরে একবারই চাষ করা যায়। সাধারণত যে সমস্ত অঞ্চলের জলবায়ু উষ্ণ এবং আদ্র সে সমস্ত অঞ্চলে কেনাফ ভালো জন্মে। কেনাফ গাছ জন্মানোর চার মাস পর থেকে সুবিধাজনক সময়ে ফসল কাটা যায়। তবে কেনাফ গাছে ফুল আসলেও গাছের বৃদ্ধি থেমে যায়না। তাই আঁশ বা ফাইবার উৎপাদনের জন্য সম্ভব হলে পাঁচ মাস বয়সে ফসল কাটা হলে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
আঁশ ফসলের জন্য পাটের ন্যায় সরু ও মোটা গাছ পৃথক করে, আঁটি বেঁধে পাতা ঝরিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে বা জাগ দিয়ে রাখতে হয়। জাঁক কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া ভালো। আঁশ ছাড়ানোর সঠিক সময় নির্বাচনের জন্য কেনাফ পঁচার সময় হয়ে আসলে জাগ থেকে কেনাফ নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। উপযুক্ত পরিমাণ পঁচলে কেনাফ আঁশ ছাড়ানোর জন্য নির্বাচন করা হয়। কেনাফ গাছ থেকে কেনাফের আঁশ বা ফাইবারকে নিম্নেবর্ণিত দুইভাবে নিষ্কাশন করা যায়ঃ
০১) আলাদা আলাদাভাবে আঁশ ছাড়ানোঃ এ পদ্ধতিতে জাগ থেকে কেনাফ ডাঙ্গায় তোলা হয় এবং পানি ঝরার পর, হাত দ্বারা একটি একটি করে আঁশ কেনাফ গাছ থেকে ছাড়ানো হয়। হাত আঁশে পূর্ণ হয়ে গেলে আঁশগুলো গুচ্ছাকারে আলাদা করে রাখা হয়।
০২) গুচ্ছাকারে আঁশ ছাড়ানোঃ এক্ষেত্রে আঁশ ছাড়ানোর জন্য কৃষক কোমড় পানিতে নেমে অনেকগুলো কেনাফ গাছ একত্রে ধরে, কাঠের মুগুড় দিয়ে গোঁড়ার অংশ থেঁতলে ফেলে। অতঃপর হাত দ্বারা টেনে কেনাফ গাছ থেকে আঁশগুলো আলাদা করা হয়।
আঁশ ছাড়ানোর পর আঁশগুলো পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে বাঁশের আড়ায় শুকিয়ে সংগ্রহ করা হয়।
কেনাফ আঁশ বা ফাইবারের বৈশিষ্ট্যঃ
- কেনাফ গাছের ডাঁটে ৩০% এরও কম লিগিনিন(এক ধরনের আঠালো পদার্থ যা উদ্ভিদ তন্ত্রে শূন্যস্থান পূরণ করে) থাকায় কেনাফের আঁশ বা ফাইবার উত্তোলন সহজ হয়।
- আঁশগুলো অত্যন্ত দীর্ঘ।
- কেনাফ আঁশের রং ফ্যাকাশে।
- আঁশে পাটের চেয়ে কম পরিমাণ সেলুলোজ বিদ্যমান।
- আঁশের উজ্জ্বলতা উন্নতমানের কেনাফের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল এবং চাকচিক্যপূর্ণ। দাগযুক্ত কিংবা অনুজ্জ্বল কেনাফের ক্ষেত্রে দুর্বল এবং নিম্নমানের হয়ে থাকে।
- আঁশের শক্তি নিম্নমানের পাটের সমতুল্য এবং ভিজা অবস্থায় সামান্য পরিমাণ শক্তি হারায়।
- অগ্নিপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো।
- এন্টিমাইক্রোবায়াল বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।
কেনাফ ফাইবার থেকে উৎপন্ন সামগ্রীঃ
কেনাফ থেকে পাওয়া যায় আঁশ ও আঁশজাতীয় সামগ্রী। টেক্সটাইল ক্ষেত্রে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে কেনাফ ফাইবার ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেনাফ আঁশ- দড়ি, কাছি এবং মোটা কাপড় যেমন; ক্যানভাস, বস্তার কাপড় ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে ভালো মানের আঁশ কার্পেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও কেনাফ ফাইবার দ্বারা আরও অনেক ব্যবহার্য উপাদান প্রস্তুত সম্ভব। যেমন;
- স্টোরেজ ব্যাগ
- কুটির শিল্পজাত দ্রব্য শিকা
- মাদুর, স্যান্ডেল
- জায়নামাজ, টুপি
- সোফা ও কুশনের কভার
- পর্দার কাপড়
- বেডশিট
- পাঞ্জাবি, সোয়েটার
- প্লেন, মোটর, কম্পিউটার ইত্যাদির পার্টস।
কেনাফ থেকে উৎপন্ন নানাবিধ পন্যের চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাছাড়া কেনাফ ফাইবার থেকে উৎপন্ন পণ্য রিসাইকেল করা যায়। কাগজশিল্প, নির্মাণশিল্প, পার্টেক্স এবং প্রসাধনী তৈরির কাঁচামালের যোগানও কেনাফ দিয়ে থাকে। প্রাইভেট কার তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে ইন্টেরিয়র ইন্সুলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
শেষ কথাঃ
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে পাটের আবাদ হয়ে আসছে। কিন্তু চর এলাকায় পাট চাষ করলে প্রতিবছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতিই মোকাবিলা করে কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে কেনাফকে পাটের বিকল্প হিসেবে নয় বরং পরিবেশবান্ধব এই অর্থকরী ফসলটিকে, পাটের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করে যে সকল প্রান্তিক ভূমি পাট চাষের উপযোগী নয়, তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ কেনাফ চাষের আওতায় আনা সম্ভব। এর মাধ্যমে দেশে অধিক আঁশ উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।
তথ্যসূত্রঃ
Wikipedia
bdsuccess.com
krishibarta.com
dailyjanakantha.com
fibre2fashion.com
বই- টেক্সটাইল ‘র’ ম্যাটেরিয়ালস্-১(রনজিত কুমার নাগ, ইন্জিঃ মোঃ আঃ খালেক)
লেখিকাঃ
আছিয়া আক্তার
১ম বর্ষ, ব্যাচ-২৪
সেশনঃ ২০১৯-২০২০
বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।
আমি এই গুরুপে অনেক তথ্য পাইছি আর এই তথ্য গুলো বাস্তব জীবনে আমারে অনেক কিছু শিখিয়েছে এধরনের তথ্য বেশি করে দেবেন আর প্রকতিক ফাইবারের নিয়ে কিছু তথ্য দেবেন ধন্যবাদ