খবরের কাগজের দিকে চোখ তো আমরা কম বেশি প্রায় সবাই রাখি। তাহলে একটি বিষয় বা শিরোনাম প্রায় প্রতিনিয়তই আমাদের চোখে পড়ে। তা হলো শ্রমিক অসন্তোষ। আজকে সাভার-আশুলিয়া-ইপিজেড তো কাল গাজীপুর আবার নারায়ণগঞ্জ।
চোখে পড়েনি!! কি বলেন!! দাঁড়ান। এখানেই থামুন। একটু কষ্ট করে গুগলে যান। পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন লিখে একটু সার্চ দিন। দেখবেন আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে শত শত নিউজ। কেন দেখতে বললাম এবার একটু বলি। এত এত খবর না দেখলে আপনারা আসলে আমার লিখার গুরুত্ব বুঝতে পারবেন না।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সফল শ্রমিক আন্দলোন হয় ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের। হে মার্কেটের শ্রমিকরা নেমেছিলেন তুমুল আন্দোলনে৷ তাঁদের দাবি ছিল, উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়৷ মে মাসের প্রথম দিনেই শ্রমিকরা ধর্মঘটের আহ্বান জানায়৷ প্রায় তিন লাখ শ্রমিক যোগ দেয় সেই সমাবেশে৷ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের রুখতে মিছিলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়৷ বহু শ্রমিক হতাহত হন৷
১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে শ্রমিক ভাইয়েরা শুরু করে “অসহযোগ আন্দলোন”। জানা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নিরলস কাজ করে গিয়েছেন। স্বাধীনতার পর দেশের শ্রম আন্দোলনে তৈরি হয় নানা বিভাজন৷ ১৯৭৩ সালে কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়৷ এই শ্রমিক অসন্তোষে বহু শ্রমিক আহত হয়৷
বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের কথা উঠলেই আগে সবার মনে ভেসে আসে পাটকল শ্রমিকদের কথা। একসময় নারায়ণগঞ্জে আদমজী পাটকলের শ্রমিকদের যে প্রভাব ছিল সেটি এখন অনেকটা রূপকথার মতো। ১৯৭০ -৮০’র দশকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক ধর্মঘটে জনজীবন স্থবির হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে তেমনটি নেই। বাংলাদেশ গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার কিংবা আন্দোলনের বিষয়টি সবার সামনে আসে। শ্রমিক আন্দোলন বলতে গামের্ন্টেস শ্রমিকদের বিষয়টিই সবচেয়ে আলোচিত। বিভিন্ন সময় বেতন-ভাতার দাবিতে বিচ্ছিন্নভাবে শ্রমিকরা রাস্তায় নামে।
তবে ২০০৬ সালের জুন মাসে পোশাক শ্রমিকরা বড় ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম তাঁদের অধিকার নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়৷ মাসিক মাত্র ১,৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা মজুরি নির্ধারণের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷ কোনো শ্রমিক সংগঠন ওই মজুরি মানেনি৷ তখন তাঁরা তিন হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন৷
২০১৮ সালে সংশোধিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী প্রথম গ্রেডের একজন কর্মী সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা বেতন পাবেন। দ্বিতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার ৪১৬ টাকা। তৃতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা। চতুর্থ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয় ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা। পঞ্চম গ্রেডে সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছিল ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা,ষষ্ঠ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ৮ হাজার ৪২০ টাকা এবং সপ্তম গ্রেডের মজুরি সব মিলিয়ে আট হাজার টাকাই রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে সেখানকার পোশাক শ্রমিকদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। তাছাড়া মালিকপক্ষের নানা ধরনের টাল-বাহানার কথা না বললেই নয়। বেতন নয় আজ নয় কাল দিব।পরশু পার হয়ে তরশু হয়ে যাবে মাস পেরিয়ে যাবে। তখন বলা হবে ২ মাসের বেতন একসাথে দেওয়া হবে সাথে দেওয়া হবে বোনাস এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে অমুক দিন দেওয়া হবে বেতন। শ্রমিকরা খুশি মনে যাবেন বেতন নিতে। গিয়ে দেখবেন হয় তালা দেওয়া না তাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। বাহ!! মগেরমুল্লুক।
খুব বেশি দূরে তাকাতে হবে না। একটি মজার তথ্য দেওয়া যাক, বাংলাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছর তৈরি পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার শ্রমিক৷ নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাহিদা কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে৷ এমনকি অনেক কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে৷
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশর (এমআইবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশের বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা অনেক বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে৷ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৩ কর্মীর মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ জনের মতো চাকরি হারিয়েছেন, যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ৷
সিপিডি জানিয়েছে, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি৷ মাত্র তিন দশমিক ছয় শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনে বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে৷ সিপিডি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যেসব কারখানায় নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই আগে ছাঁটাইকৃত কর্মী৷ নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার সময় তাদের আরো কম বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে৷ শ্রমিকরা চাকরি পেলেও আগের চাকরি চলে যাওয়ার কারণে তারা উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে।
এখান থেকে একটি খুবই স্পষ্ট যে কিভাবে শ্রমিকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। একে তো দেয়া হচ্ছে না ঠিক মতো বেতন, অন্যদিকে তথাকথিত নতুনভাবে নিয়োগের মজার একটি খেলা। বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে নির্ভর একটি দেশ। কিন্তু যাদের হাতে ধরে এই খাতটি চলছে বা এক কথায় বলতে গেলে দেশ চলছে আজ তারা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।
মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস শ্রমিকদের এই ক্রমাগত লড়াই-সংগ্রামকেই বলেছিলেন – ‘পৃথিবীর ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস’।
তাই শ্রমিকরা বুঝে গিয়েছে যে আন্দলোন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই তারা একবুক ভরা কষ্ট নিয়ে নামছে রাজপথে। করছে আন্দলোন দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক স্লোগান। কিন্তু সেখানেও তাদের শান্তি নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় যে গরীব হয়ে জন্ম নেওয়াটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। কেন? আন্দলোনের সময় তাদের উপর করা হচ্ছে লাঠিচার্জ, করা হচ্ছে গুলি। মারা যাচ্ছেন নাকি মরে গিয়ে বেঁচে যাচ্ছেন তা বলা মুশকিল।
শিল্প শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে যা করণীয়:
১. ত্রিপক্ষীয় আলোচনাকে অধিক প্রাধান্য দেয়া এবং চর্চাটি অব্যাহত রাখা;
২. শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরি পরিশোধের বিষয়টি শিল্পাঞ্চল পুলিশের পর্যবেক্ষণ করা;
৩. মাসে একদিন কারখানায় মালিকপক্ষের শ্রমিকদের নিয়ে মতবিনিময় করা;
৪. সরকারের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কারখানাগুলোর পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া;
৫. দুর্ঘটনা এড়াতে নিয়মিত সব বিপজ্জনক যন্ত্রপাতির বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা পরীক্ষা করা;
৬. শিল্প বিরোধ নিরসনে মালিকপক্ষ বা শিল্পাঞ্চল পুলিশের দমন নীতি গ্রহণ না করা;
৭. কারখানা লে-অফ বা স্থানান্তরে বাধ্য হলে শ্রমিকদের যথাসম্ভব আগে জানানো ও কাউন্সেলিং করা এবং সম্ভাব্য বিকল্প চাকরির জন্য যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়া;
৮. শ্রমিক ফেডারেশন কে প্রতিপক্ষ না ভেবে শিল্প অংশীদার মনে করা;
৯. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান এবং ‘শ্রমিক অধিকার’ আইন মেনে চলা।
আশার বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৮৪ সালে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৫৭০ টাকা। ১৯৯৪ সালে তা বৃদ্ধি করা হয় ৯৩০ টাকায়। ২০০৬ সালে তা করা হয় ১৬৬২ টাকা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে চার বছর পর ২০১০ সালে তা বৃদ্ধি করে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করেন। পরবর্তী তিন বছর পর ২০১৩ সালে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকার স্থলে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা এবং পাঁচ শতাংশ হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দেওয়া হয়। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকার স্থলে আট হাজার টাকায় উন্নীত করেন। তিনি শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেওয়ার জন্য মালিকদের নির্দেশ দেন। তাছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়ন এবং তাদের মজুরি বিষয়ে সৃষ্ট শ্রম অসন্তোষ নিরসনে ২০১৯ সালে শ্রম পরিস্থিতি মনিটরিং এর জন্য দেশের শ্রমঘন এলাকায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২৯টি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং শ্রমিকদের বিভিন্ন অভিযোগ গ্রহণের জন্য যে পাঁচ ডিজিটের হট লাইন চালু করা হয়। তাছাড়া প্রতি ৫ বছর পর পর শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর বিষয়টি তো আছেই। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে বিজিএমইএ ও প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। যে যে ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পরে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে সহায়তা করে থাকে।
Source:
bonikbarta.net
bbc.com
prothomalo.com
bssnews.net
m.dw.com
dailynayadiganta.com
Writer Information:
Omar Saif
Department of Textile Engineering
Jashore University of Science and Technology
[email protected]