গবেষকদের নিত্য নতুন আবিষ্কারে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিশ্ব । সেই সঙ্গে পিছিয়ে নেই আমাদের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টর । একসময়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংকে কাপড় সেলাই এর মাঝে সীমাবদ্ধ মনে করা হলেও আজ এই সেক্টর নতুন নতুন টেকনোলজী গ্রহণ,টেকনিক্যাল টেক্সটাইল যেমনঃ মেডিক্যাল টেক্সটাইল ,স্মার্ট টেক্সটাইল ,জিও টেক্সটাইল সহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ।
পৃথিবীর যুগান্তকারী পরিবর্তন আনয়ন এর ক্ষেত্রে কিছু ম্যাটেরিয়াল আবিষ্কারের ভূমিকা সব যুগেই ছিল । তেমনি ২০০৪ সালের গ্রাফিন (GRAPHENE) ম্যাটেরিয়াল আবিষ্কার এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যার জন্য আন্দ্রেঁ গেইম এবং কনস্টানটিন নভোসেলভ ২০১০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আজ এই আর্টিকেলে আমরা টেক্সটাইলে গ্রাফিন কি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তা দেখব ও এপ্লিকেশনের কিছু ক্ষেত্রের দিকেও আলোকপাত করব।
চলো বন্ধুরা, জেনে আসি গ্রাফিন সর্ম্পকে খুঁটিনাটি কিছু তথ্য -গ্রাফিন (ইংরেজি: Graphene) এক ধরণের কার্বন, যা একটি সরু চাকতিরূপে বিরাজ করে, চাকতিটির ক্ষেত্রফল যত বড়ই হোক না কেন পুরুত্ব হয় মাত্র একটি পরমাণুর আকারের সমান। এক্ষেত্রে পরমাণুগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যে, একটি দ্বিমাত্রিক মৌচাকের মত আকৃতি গঠিত হয়। এটি কাচের মত স্বচ্ছ। ইস্পাতের তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী এবং এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব মৌল ও যৌগের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী। প্লাস্টিকের মধ্যে শতকরা মাত্র ১ ভাগ গ্রাফিন মেশালে তা তড়িৎ সুপরিবাহীতে পরিণত হতে পারে। অনেকগুলো ন্যানোটিউবকে না মুড়িয়ে একের উপর আরেকটি রেখে দিলে যে কাঠামোটি গঠিত হয় স্থূলভাবে তার সাথে গ্রাফিনের তুলনা করা যেতে পারে।
তাহলে সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুরা, তোমরা কিছুটা আঁচ করতে পারছ যে কেন সবাই গ্রাফিনকে বিস্ময়কর ম্যাটেরিয়াল বলছে।
গ্রাফিনের বৈশিষ্টঃ
কিছুটা সাধারণ আলোচনা তো তোমরা পড়লে। এবার কিছু গ্রাফিনের বৈশিষ্ট আলোচনা করা যাক ।
১) ইহা ডায়মন্ডের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ।
২) এই ম্যাটেরিয়ালটির ঘনত্ব কম ।
৩) উচ্চ মাত্রার আলোকভেদ্যতা বৈশিষ্ট প্রদর্শন করে ।
৪) উচ্চ তাপীয় পরিবাহিতা রয়েছে।
৫) মডুলাস অব ইলাস্টিসিটির মান অনেক উন্নত।
৬) যেকোনো ডিফরমেশনে ইহা ভাল রেজিস্টেন্সি দেখায় ।
৭) ইহার পরমাণুর বিস্তার দ্বিমাত্রিক বিস্তার এর মত ।
৮) পানির রিপ্লেন্সি গুনাবলি বিদ্যমান ।
৯) ইহা বৈদ্যুতিক সেন্সর হিসেবে ব্যবহারের অনেক সুযোগ আছে ।
টেক্সটাইল ও ফ্যশন ইন্ডাস্টিতে গ্রাফিনের ব্যবহারঃ
এখন আমরা আলোচনা করব গ্রাফিন কিভাবে টেক্সটাইল সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে।
১) ই-টেক্সটাইল এবং স্মার্ট টেক্সটাইলে গ্রাফিনের ব্যবহারঃ
ই-টেক্সটাইল এমন কাপড় যা কম্পিউটারিং, ডিজিটাল উপাদান এবং ইলেকট্রনিক্সগুলিকে এমবেড/খচিত করতে সক্ষম করে। টেক্সটাইল মেনুফেকচারিং এর উইভিং এ গ্রাফিন টেক্সটাইল ফাইবার ব্যবহার করে ইলেক্ট্রোকন্ডাকটিভ টেক্সটাইল তৈরি করা যেতে পারে। স্মার্ট টেক্সটাইলগুলি টেক্সটাইল পণ্য হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যেমন তন্তু এবং তন্তুগুলি, ওভেন, নিটেড এবং নন ওভেন কাঠামোর সাথে একত্রে সুতা, যা ব্যবহারকারীর সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
বিশেষত পোশাকের জন্য স্পর্শ, পুনরুদ্ধার, ড্র্যাপ, শিয়ার এবং হ্যান্ডেলের মতো স্পর্শকাতর বৈশিষ্ট্যগুলি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে যে ফাইবারগুলি ব্যবহার করা হয় তা সূক্ষ্ম হওয়া উচিত এবং কাপড়ের ইউনিট ক্ষেত্রের ক্ষেত্রে কম ওজন হওয়া উচিত। গ্রাফিন ফাইবারগুলির এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গ্রাফিন ই-টেক্সটাইলগুলির জন্য আরও উপযুক্ত কারণ এটি বৈদ্যুতিনভাবে পরিচালিত টেক্সটাইলগুলি তৈরি করার জন্য পরিবাহী এবং অর্ধপরিবাহী হতে পারে এবং ডাই হিসাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
২) ওয়াটারপ্রুফ ফেব্রিক উৎপাদনেঃ
বিজ্ঞানী জেমস ডিকারসন এবং ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি দল পাতলা গ্রাফিন শিটগুলি প্রয়োগ করার জন্য দুটি উপায় তৈরি করেছে যা তাদের সুপার-হাইড্রোফোবিক বা সুপার-হাইড্রোফিলিক করে তোলে। “গালিচা” এবং “ইট” নামে অভিহিত এই বিকল্প ব্যবস্থা পানিকে জপমালা করে তোলে এবং প্রবাহিত হয় বা ছড়িয়ে পড়ে এবং অবিশ্বাস্যভাবে পাতলা শীট তৈরি করে। যা অসাধারন গুনাগুন সম্পন্ন ওয়াটারপ্রুফ ফেব্রিক উৎপাদন যা ব্যবহার হচ্ছে ।
৩) স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেঃ
গ্রাফিন দিয়ে যে ফাইবার তৈরী করা হয় তা দিয়ে রোগীর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন পোশাক বানানো হচ্ছে । এই পোশাকের অনন্য সেন্সরগুলি স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, প্রতিরোধমূলক যত্ন, অনুশীলন ফিজিওলজি এবং ওজন হ্রাসে ব্যবহারের জন্য শরীর থেকে চিকিৎসার মানের ডেটা ক্যাপচার করতে সক্ষম।
৪) মিলিটারি টেক্সটাইলঃ
সাধারন পোশাকের চেয়ে আরও অনেক বেশী ফাংশনাল গুণাবলী দরকার এমন পোশাকেও গ্রাফিন ভূমিকা রাখতে পারে ।
৫) স্পোর্টস এর পোশাকেঃ
খেলোয়াড়দের দেহের বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত সার্বক্ষনিক পর্যবেক্ষন সে অনুযায়ী এই পোশাক আচরণ করে । খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়ানই সহজ ভাবে বললে এই পোশাকের কাজ । NuMetrex কোম্পানি সফলতার সাথে এই পোশাক বানিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করে যাচ্ছে।
৬) সোনালি আশ খ্যাত পাটে গ্রাফিনের ব্যবহারঃ
গ্রাফিন ব্যবহার করে জুটের যে সীমাবদ্ধতা তা দূর করার চেস্টা করেছেন । তারা জুটের কম্পোজিটগুলির শিয়ার শক্তি ২৩৬% এবং টেনজাইল শক্তি ৯৬% বৃদ্ধি করেছেন । যা করেছেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ফোরকান সরকার ও তার গবেষক দল ।
৭) পানির বিশুদ্ধকরনেঃ
প্রচলিত পানি বিশুদ্ধকরন পদ্ধতিগুলো হলো সোডা লাইম,জিওলাইট,রিভার্স অসমোসিস ইত্যাদি ।কিন্তু এর থেকে ভাল ফলাফল দেয় গ্রাফিন বেসড মেমব্রেন পদ্ধতি ।
এই পদ্ধতিতে পানি এই মেমব্রেন এর মধ্যে পাস করতে পারে কিন্তু মেটালিক আয়নগুলো পাস করতে পারে না, এই মেমব্রেন ন্যানোমিটারের চেয়ে কম পুরু ঝিল্লি তৈরি করে; একটি মানুষের চুলের চেয়ে 100,000 গুণ বেশি পাতলা হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলব,গ্রাফিন বলা হয় ক্রেজি ম্যাটেরিয়াল এবং সারা বিশ্বে এই ম্যাটেরিয়াল বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে নতুন নতুন গবেষণা করা হচ্ছে । আমরা যদি টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে টেকসই করাতে চাই তবে অবশ্যই বেসিক প্রডাক্ট হতে ভ্যলু অ্যাডেট প্রডাক্ট এর দিকে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই । এক্ষেত্রে গ্রাফিন আমাদের একটি জন্য চমৎকার একটি অভিমত হতে পারে ।
লেখকঃ
মোঃ তানভীর হোসেন , বি.এস.সি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনারিং,৩য় বর্ষ।
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(ডুয়েট),গাজীপুর ।
রেফারেন্সঃ
১/ J. Molina, M.F. Esteves, J. Fernández, J. Bonastre and F. Cases, Eur. Polym. J., 2011, 47,
2003–2015
২/ Weng, W. et al. Smart electronic textiles. Angew. Chem. Int. Ed. 55, 6140–6169
(2016).