কার্বন নাম টা শুনলেই মাথায় প্রথমেই যা আসে তা হলো পর্যায়সারণীর সেই বিখ্যাত পরমাণুর কথা,যার সর্বশেষ শক্তিস্তরে ৪ টি ইলেকট্রন থাকে।আবার কার্বনের রুপভেদ এর কথা উঠলেই গ্রাফাইট নাম টা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।হ্যাঁ,সেই গ্রাফাইট যা অধাতু হওয়া সত্ত্বেও তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। আজ কার্বনের এমন আরেকটি রুপভেদের কথা বলব যা টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। এর নাম হল গ্রাফিন।
গ্রাফিন একটি সরু চাকতিরূপে বিরাজ করে। চাকতিটির ক্ষেত্রফল যত বড়ই হোক না কেন এর পুরুত্ব হয় মাত্র একটি পরমাণুর আকারের সমান। এক্ষেত্রে পরমাণুগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত হয় যে,একটি দ্বিমাত্রিক মৌচাকের মত আকৃতি গঠিত হয়। এটি কাঁচের মত স্বচ্ছ এবং এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব মৌল ও যৌগের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী। প্লাস্টিকের মধ্যে শতকরা মাত্র ১ ভাগ গ্রাফিন মেশালে তা তড়িৎ সুপরিবাহীতে পরিণত হতে পারে। অনেকগুলো ন্যানোটিউবকে না মুড়িয়ে একের উপর আরেকটি রেখে দিলে স্থুলভাবে যে কাঠামোটি গঠিত হয় তার সাথে গ্রাফিনের তুলনা করা যেতে পারে। এই গ্রাফিন টেক্সটাইল শিল্পের সবচেয়ে নমনীয় উপকরণগুলির মধ্যে একটি। এই উপাদানটি পরবর্তী প্রজন্মের স্পোর্টওয়্যার তৈরি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গ্রাফিন ট্র্যাঞ্চে কাটা হয়। এই ট্র্যাঞ্চগুলি মানুষের চুলের চেয়ে পাতলা এবং খালি চোখে দেখা যায় না। কার্বন পরমাণুর এক স্তর নিয়ে গঠিত গ্রাফিন অ-বিষাক্ত, নন-সাইটোটক্সিক এবং হাইপোলোর্জিকের চেয়ে 200 গুণ বেশি শক্তিশালী। গ্রাফিনের তাপীয় বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য এটি অ্যাথলেটিক টেক্সটাইল শিল্পে আজ বিপ্লব এনেছে।এই উপাদানগুলি আমাদের ত্বক এবং পরিবেশের মধ্যে একটি ফিল্টার হিসাবে কাজ করে। এটি গরমের সময় আমাদের দেহ থেকে তাপ বের করে দেয় এবং শীতকালে শরীরের মধ্যে তাপ সরবরাহ করে থাকে। যার ফলে এর দ্বারা তৈরিকৃত পোশাক খুব আরামদায়ক হয়ে থাকে। তাছাড়া,গ্রাফিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলো এক ধরণের গ্রাফিন কালি তৈরি করেছেন যা পরিধেয় পোশাকে যুক্ত হতে পারে। এই উদ্ভাবনী গ্রাফিন কালি স্মার্ট অ্যাথলেটিক পোশাক তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যা ব্যবহারকারীদের হার্টরেট এবং গতিবিধি সহ তাদের কর্মক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ করে থাকে। এই গ্রাফিনযুক্ত কার্বন ফাইবার সংমিশ্রণ দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে যা স্কি-জ্যাকেট এবং ট্রাউজারের মতো ক্রীড়া সরঞ্জাম তৈরিতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
গ্রাফিন নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলছে।উন্নত গ্রাফিন যুক্ত পোশাক গুলো অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-স্ট্যাটিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত এবং এটি তাপ সংরক্ষণ করতে পারে। গ্রাফিন কালির পোশাক সচারাচর ব্যবহৃত ধাতব সেন্সরগুলির একটি দুর্দান্ত বিকল্প হিসেবে কাজ করে থাকে । এই কালিটির হাইপোলোর্জিক বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য এটি মানব দেহে অ্যালার্জির কারণ হবে না। অর্থাৎ এই ধরনের পোশাক খুব স্বাস্থ্যসম্মত হয়ে থাকে যা ব্যাবহারকারি নির্দ্বিধায় ব্যাবহার করতে পারেন।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, কিছু নতুন প্রযুক্তির উন্নতির ফলে প্রতি মিনিটে ১৫০ মিটার গ্রাফিন ই- টেক্সটাইল তৈরি করা সম্ভব বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে অনেক বেশি পরিমান কাপড় প্রস্তুত করা যাবে।যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার এর নাজমুল করিম বলেছেন, “খুব দ্রুত গতিতে স্কেলযোগ্য পরিমাণে গ্রাফিন ভিত্তিক পরিধেয় ই-টেক্সটাইল উৎপাদন করতে সক্ষম হওয়ায় দ্রুত বর্ধনশীল বাজারের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।”
বর্তমান চারিদিকে যখন COVID-19 ভাইরাস এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পরেছে তখন বিজ্ঞানীরা এই গ্রাফিন কালি ব্যাবহার করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম অর্থাৎ পিপিই (PPE), N95 মাস্ক এর উন্নতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ZEN এর সিইও ফ্রান্সিস দুবে জানিয়েছেন,”আমরা জিসির (GC- Graphene Composites) এর সহযোগিতায় মারাত্মক COVID-19 ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবদান রাখতে পারে এমন একটি নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তির শীর্ষে রয়েছি। এই সম্ভাব্য COVID-19 ভাইরাসাল গ্রাফিন কালিটির বিকাশ ফ্রন্টলাইন কর্মী এবং হাসপাতালের কর্মীদের সুরক্ষার জন্য কার্যকর পিপিই সরবরাহ করবে”। ডাঃ দুবে জানিয়েছেন, “বর্তমান N95 এর মাস্কগুলি ভাইরাসটিকে ফাঁদে ফেলবে তবে এটি আপাতত ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে সক্ষম নয়।তবে আমাদের পরীক্ষায় যদি প্রমাণিত হয় যে এই গ্রাফিন কালি একটি কার্যকর ভাইরাসাইড, যা ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে সক্ষম তাহলে এটি মানুষের সুরক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। আমরা গ্রাফিন কম্পোজিট এর দলটির সাথে কাজ করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত এবং আমরা তাদের সাথে কাজ করে যাব।”
তাহলে আর বলার অপেক্ষা রাখে না, যে গ্রাফিন নামক কার্বন পরিবারের এই সদস্য টি পোশাক শিল্পে কতটুকু আধিপত্য বিস্তার করে আছে। আর অদুর ভবিষ্যতে এটি পোশাক শিল্পের বাজার কতভাবে দখল করতে যাচ্ছে।বিজ্ঞানীরা একে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পন্যে পরিনত করতে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।ফলে বর্তমান প্রজন্ম এক নতুন পোশাকের বাজার এর সাথে খুব শীঘ্রই পরিচিত হতে যাচ্ছে।
Source: www.acsmaterial.comwww.graphene-info.comwww.textiletoday.com.bd
Writer:Omar SaifDepartment of Textile Engineerng (3rd Batch)Jashore University of Science and Technology