Tuesday, December 24, 2024
Magazine
More
    HomeMotivationalগ্রামীন তাঁত শিল্প ও তার ইতিহাস

    গ্রামীন তাঁত শিল্প ও তার ইতিহাস

    “বাংলার মুসলিম বাগদাদ রোমচিন কাঞ্চন তৈলেই কিনতেন একদিন”, বাংলার তাঁতের সুখ্যাতির জন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখে গিয়েছিলেন বহু আগেই। বাংলার তাঁত শিল্পের ইতিহাসও বহু পুরনো। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার তাঁত এর সুনাম ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ধনেখালি ও শান্তিপুরীসহ  বিভিন্ন জায়গার তাঁত শিল্প বিখ্যাত। এমনকি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বহির্বাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিল তাঁত শিল্প। তবে পুরনো হলেও বাংলার বনেদি ও প্রাচীন এই শিল্পের কদর রয়েছে আজও। বাংলার তাঁত নিজের জায়গা ধরে রেখেছে নিজের গরিমায়। কারণ কিছু জিনিস কোনদিন হারিয়ে যায় না।

    বলা হয়ে থাকে, আদি বসাক তাঁত সম্প্রদায় তাঁত শিল্পের আদিম কারিগর তাঁত বোনার শব্দটি এসেছে “তন্তু বয়ন” থেকে। তাঁত হচ্ছে এক ধরনের যন্ত্র যা দিয়ে সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হয়। রেশম পোকার লালা থেকে উৎপন্ন হয় সুতা। এক্ষেত্রে প্রথমে রেশম গুটি জলের মধ্যে দিয়ে সেদ্ধ করা হয়। সেই রেশম পোকার গুটি থেকে সুতা বের করা হয়। এই সুতা বের করা হয় অভিনব কায়দায়। একসাথে ছয় থেকে সাতটি রেশম গুটি থেকে সুতো বের করে তা একসাথে লাটাই এর মাধ্যমে জড়িয়ে নেওয়া হয়।
     
    সুতা বের করার পর টুইস্টার মেশিনের সাহায্যে সুতাটিকে পাকানো হয়। তারপর “তাসুন” পদ্ধতির মাধ্যমে সুতা গুলিকে লম্বালম্বি রাখা হয় এবং পেটানো হয় “তাসুনের” পর সুতা টিকে তাঁত যন্ত্রে ঢুকানো হয়। অত্যন্ত সুক্ষভাবে প্রত্যেকটি ছিদ্রের মধ্যে সুতা ঢুকানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় “শানা”। তারপর সেই সুতা টিকে পুনরায় বোনা হয় পরবর্তীতে সুতাকে কুন্ডলী আকারে টান টান করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতো টেনে নেওয়া হয় এবং তাঁত যন্ত্রে ঝুলানো হাতল টেনে  সুতা জরানো মাকু আড়াআড়ি টানা হয়। এক্ষেত্রে লম্বালম্বি সুতা গুলোকে “টানা” বলা হয় এবং আড়াআড়ি সুতা গুলোকে “পোড়েন” বলা হয়। শানার প্রথম কাজ হলো টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর সামনা সামনি নিজস্ব স্থানে রেখে লম্বালম্বি সুতাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ঝুলিয়ে রাখা। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য নালা-কাটা কাঠ বসানো হয়,যার নাম মুঠ-কাঠ। শানায় গাঁথা আবশ্যকমত প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠেত উপর জড়িয়ে রাখা হয়, যাকে বলা হয় টানার নরাজ এবং তাঁতী যেখানে বসে তাঁত বোনে তাকে বলে কোল- নরাজ।এভাবে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার  করে তাঁতীরা পরিশ্রম করে তাঁত বুনে।

    বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে এদেশের মসলিন ও জামদানির রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এই মসলিন এবং জামদানি সারাবিশ্বে উঁচুমানের বস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত হস্তচালিত তাঁত শিল্পের ফসল ঢাকাই মসলিন। আর সূক্ষ্ম জমিনের ওপর দুটি তোলা বিচিত্র সব নকশা মণ্ডিত মসলিনের নাম হচ্ছে জামদানি। জামদানি মূলত মসলিনের অংশ। প্রাচীন আমলে উন্নত মানের জামদানি তৈরি হতো। ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি স্থানে। বর্তমানে ঢাকা, সোনারগাঁও, আড়াইহাজার, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, মনোহরদী প্রভৃতি স্থানে তৈরি হয়।আর ডেমরার হাট হচ্ছে জামদানীর প্রধান বিক্রয় কেন্দ্র। জামদানি নকশা এখন শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নেই এমব্রয়ডারী পোশাক, শুভেচ্ছা কার্ড, বিয়ের আলপনা, চিঠির প্যাড ইত্যাদিতে বিস্তৃতি লাভ করেছে।  প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত অক্ষুন্ন রয়েছে জামদানির কদর। সময়ের প্রয়োজনে মসলিন জামদানি কালের আবর্তে  বিলীন হলেও আজও অক্ষুণ্ণ  রয়েছে ঢাকাই শাড়ীর গৌরবময় জনপ্রিয়তা। 

    তাঁত শিল্পের ইতিহাস:

    তাঁতের ইতিহাস বাংলাদেশের শিল্প জগতে সবচেয়ে গৌরবউজ্জ্বল ইতিহাসের একটা। প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ যে কারণে পৃথিবীতে বিখ্যাত সেটা হল তাঁতশিল্প। বাংলা ভূখণ্ড-মূলত ঢাকা পরিচিতই হয়েছে তাঁতের কারণে। সুলতানি মুঘল আমলেই  তাঁতের কাজ দারুন উৎকর্ষে পৌঁছেছিল। প্রচলিত অর্থে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এবং বৃহত্তম শিল্প হল তাঁত শিল্প। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে মূলত তাঁত শিল্পের রটনা ঘটে। মনিপুরী তাঁত শিল্পে অনেক আদিকাল থেকে তৈরি করে আসছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য অনেকটা প্রসিদ্ধ। ইতিহাসের পাতায়, ১৯৯০ সালে নরসিংদী জেলায় সবচেয়ে বেশি ২০ হাজারের মতো তাঁতী ছিল কিন্তু ক্রমশ তা কমতে কমতে বর্তমানে টিকে রয়েছে হাতেগোনা এক হাজার। ১৯১৮  সালে পাবনা শহরের আশেপাশে তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটে। তাঁত শিল্পের প্রয়োজনে সুতা, রং ও রাসায়নিক দ্রব্যের বাজার পাবনায় গড়ে ওঠে। ১৯২২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু পাবনায় আসে এবং  তাঁত শিল্পকে পরখ করে তাঁত শিল্পের উপর মুগ্ধ হয়ে এই তাঁত শিল্পকে বস্ত্রশিল্পের “মা” বলে আখ্যায়িত করেন। জানলে অবাক হবেন, সেই পাবনার তৈরি গেঞ্জি বর্তমানে নেপাল, ভারত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হয়।

    তাঁত শিল্পের উদ্ভব সঠিক কবে থেকে এসেছে তার খোঁজ এখনো আলো-আঁধারের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে, আদি বসাক সম্প্রদায় এর তাঁতীরাই হলেন আদি তাঁতী। এরা আদিকাল থেকে প্রধানত তাঁত বুনে আসছে। এই পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত মানুষরা ‘তন্তুবায় বা তাঁতী নামে পরিচিত। এরা প্রধানত যাযাবর শ্রেণির অন্তর্গত ছিলো। প্রথমে এরা সিন্ধু উপত্যকায় অববাহিকায় বসবাস করতো কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা সেই স্থান পরিত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করে। আবহাওয়া প্রতিকূলতার কারণে পরে তারা রাজশাহী অঞ্চলে চলে আসে। তাঁত শিল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মনিপুরে অনেক আগে থেকেই তাঁত শিল্পের কাজ আসছে। মনিপুরীরা মূলত নিজেদের পোশাকের প্রয়োজনে তাঁতের কাপড় তৈরি করতো। তাদের তৈরি তাঁতের সামগ্রী পরবর্তীকালে বাঙালি সমাজে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

    কুটির শিল্প হিসেবে হস্ত চালিত তাঁত শিল্প ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের  পূর্বকালে কেবল দেশেই নয় বর্হিবাণিজ্যেও বিশেষ স্থান দখল করেছিলো। বংশ পরম্পরায় দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বয়ন উৎকর্ষতায় তাঁতিরা সৃষ্টি করেছিলো এক অনন্য স্থান।

    দেশের সর্ব বৃহৎ কাপড়ের হাট নরসিংদীর শেখের মাঠ ও গ্রামে গড়ে ওঠেছিলো যা, তা বাবুর হাট নামে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে হস্ত চালিত তাঁতে কাপড় বোনা হলেও বাণিজ্যিকভাবে শেখের চড়ের কাপড়ের সমকক্ষ কেউ নেই। সুলতানি ও মোগল যুগের উত্তরাধিকারী হিসাবে এখনকার তাঁতিদের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁতের রং নকশা, বুনন পদ্ধতি অন্যান্য সমস্ত এলাকা থেকে আলাদা।

    এক সময় তাদের পূর্ব পুুুরুষরাই জগদ্ব মসলিন, জামদানি ও মিহি সুতি বস্ত্র তৈরি করে সারা বিশ্বে বাংলা তথা ভারত বর্ষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিলো। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে অসম কর গ্রহণ তাঁতের ওপর আরোপিত নানা বিধি-নিষেধ এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের জন্য ভারতীয় তাঁত শিল্পের সর্বনাশ ঘটে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফলে নানা ডিজাইনের নানা রং এর নানা ধরণের কাপড়ের ভারতীয় বাজারে অবাধ প্রবেশের ফলে তাঁত শিল্পীরা আরো সমস্যায় আক্রান্ত হন।

    ধনেখালী তাঁত বালুচুরি আর তসরের হাজারো বৈশিষ্ট্যে প্রসিদ্ধ যেমন তেমনি তার রং ও বাহার। হুগলি জেলার এই অঞ্চলের কারিগররা নানা সুতোর নিপুন বুননে তাদের শাড়িকে যেভাবে তৈরি করেন তা এক কথায় অনবদ্য। ধনেখালী ও মামুদপুর পাশাপাশি এই দুই এলাকাকে নিয়ে মোট চারটি তাঁত সমবায় রয়েছে তাঁতীদের। এই সমবায়গুলি তাঁতীদের সব রকম সহায়তা করতো কিন্তু বর্তমানে এখানে তাঁতীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কেননা তাদের দাবী যে, একটা শাড়ী বুনে তারা ১০০ টাকা পান কিন্তু তা দিয়ে সংসার খরচ চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই কোনো তাঁতীই চাচ্ছেন না তাদের সন্তানেরা এই শিল্পে আসুক। তাঁতীরা সমবায়গুলি থেকে এখন আর তেমন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। ধনেখালীর তাঁত ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারিভাবে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তাঁতীদের জন্য।

    বাংলার আরেক তাঁত শিল্প পীঠস্থান শান্তিপুর সারা ভারত বর্ষের জন্য বিখ্যাত। মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায় ও এই শিল্পের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। শান্তিপুরের তাঁত শিল্প সম্পর্কে দীন বন্ধু মিত্র লিখেছিলেন ‘শান্তিপুরের ডুরে শাড়ী শরমের অরি/ নীলাম্বর উলাঙ্গিনী সর্বাঙ্গ সুন্দরী।

    এখন, শেষ বিচারে কথা উঠেও, বস্ত্র খাতে তাঁত শিল্পের ভূমিকা কি আগের মত থাকবে? হস্তচালিত তাঁতের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইলের মতো জেলাগুলো। শিল্পায়নের ধাক্কায় এসব জেলায় তাঁত টিকতে পারছে না। ফলে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আর সমতল ছেড়ে তাঁত জায়গা নিয়েছে পাহাড়ে। তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে দেশের এখন ৫৫ শতাংশ তাঁত আছে। এসব জেলায় দেশের এক-তৃতীয়াংশ বা ৯৪ হাজার ১৯৭ জন হস্তচালিত তাঁতি আছেন। দেশের ৯২ শতাংশ বা ১ লাখ ৭ হাজারের মতো তাঁত আছে মাত্র ১৫টি জেলায়।

    তবে এত দুঃসংবাদের মধ্যে ভালো খবরও আছে। তাঁতশিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। এই শিল্পের ৫৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৮ হাজার শ্রমিকই নারী। ১৫ বছর আগেও এই শিল্পে ৪৬ শতাংশ নারী ছিলেন।

    অতএব, এ প্রকল্প কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের প্রয়োজন নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে তাঁতীরা  তাদের সঠিক শ্রমমূল্য পান এবং তাঁত শিল্পে আরো অগ্রসর হয়ে ওঠে। এতে আশা করা যায়,গ্রামীণ তাঁতশিল্প তার  হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।

    তথ্যসূত্রঃ বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ওয়েবসাইট, গুগল সার্চ

    Writer information:

    Riyad Haque Akash and Abida Ferdousi
    Textile Engineering, Batch -201
    BGMEA University Of Fashion And Technology      

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Related News

    - Advertisment -

    Most Viewed