তাজরীন ও রানা প্লাজা ধ্বসের পর দেশের তৈরি পোশাক খাতের কারখানা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল, তা পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পে উন্নতমানের সবুজ কারখানা (গ্রিন ফ্যাক্টরি) নির্মাণে সারাবিশ্বে এখন শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) হিসেবে, বিশ্বের প্রথম দশটি উন্নতমানের কারখানার সাতটিরই অবস্থান বাংলাদেশে।
গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে ব্যাপকভাবে চালু হওয়ায় গোটা অর্থনীতিতে এর চমৎকার অনুকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমাদের গার্মেন্টস খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়নে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার দ্রুত বিকাশ সবাইকে আস্থাশীল করে তুলেছে। সাভারে রানা প্লাজা ধস কিংবা তাজরিন গার্মেন্টস এ ভয়াবহ অগি্নকা-ের ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল, এর ফলে ভাটা পড়েছিল এ খাতে। বিদেশি ক্রেতারাও আস্থার সংকটে পড়েছিল। বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প। পরিবেশবান্ধব টেকসই কারখানা বা ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠায় রীতিমতো তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর মাধ্যমে সারা দেশে একে একে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণাটি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। আগামীতে আরো অনেকগুলো গার্মেন্টস কারখানাকে সবুজায়নের আওতায় আনার প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে।
বর্তমান পৃথিবীর মানুষ বৈশ্বিক পরিবেশ, বিশেষ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে পূর্বের যেকোনো সময়ের থেকে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। এই উদ্বিগ্নতার কারণও অনেক স্পষ্ট। দিন দিন পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর যে দ্রুত পরিবর্তন ও তার বিরূপ ফলাফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদিও বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে অবস্থান করছে, তারপরও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখানেও যে পড়বে না এমন নয়। বিগত কয়েক বছরে দেশের উষ্ণতার পরিমাণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। তাছাড়া অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যাও দেখা দিয়েছে। যেমন শীতের প্রচণ্ড প্রকোপ, শীতকাল ক্ষণস্থায়ী হওয়া, বর্ষার পরিমাণে হেরফের, বন্যা হওয়া সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে (কিংবা অনেকাংশেই) এসবের জন্য আমরাই দায়ী।
তো আমরাই যখন পরিবেশের এই পরিবর্তনের জন্য দায়ী, আবার এই পরিবর্তনে আমাদেরই ক্ষতি হবে, কাজেই পরিবেশের এই পরিবর্তনকে আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের একান্ত দায়িত্ব। মূলত পরিবেশগত উন্নয়নের এই বিপ্লবের একটি অংশ হিসেবেই সাস্টেইন্যাবল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট-এর প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। কেননা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিল্প-কারখানা ভিত্তিক অর্থনীতি বেশ চোখে পড়ার মতো। যেমন- দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে দেশের পোশাক রপ্তানি থেকে। কাজেই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি এক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
তবে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেমন দেশের পোশাকশিল্পের অবদান আছে, তেমনি আছে এর পরিবেশগত কুপ্রভাব। আর তাই যদি দেশের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, বিশেষ করে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মানোন্নয়ন করা যায়, তবে সেটি হবে সবুজ আন্দোলনের একটি অন্যতম চালিকাশক্তি। আশার কথা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির এই সবুজ উন্নয়নে অগ্রসর হয়েছে। আর এই পরিবেশ উন্নয়ন আন্দোলনের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি। আমরা সেসব সম্পর্কে জানবো।
গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি বলতে কী বোঝায়ঃ
প্রথমেই আসা যাক গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি বলতে আমরা আসলে কী বুঝি এবং আসলে এর প্রকৃত অর্থ কী। এটা কি কোনো ইন্ডাস্ট্রি যেখানে সবুজ গাছপালা লাগিয়ে রাখা হবে? নাকি অন্য কিছু।
‘Green Industry’ পদসমূহের উৎপত্তি হয়েছে মূলত ‘Green Economy’ এর চিন্তা-ভাবনা থেকে। এখন তাহলে গ্রিন ইকোনমি কী? গ্রিন ইকোনমি হচ্ছে টেকসই অর্থনীতির দিকে আমাদের যাত্রাপথ যা বিশ্ব ব্যাংক এবং ইউনাইটেড ন্যাশন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) এর মতো কিছু সংস্থা অনুসরণ করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের স্ট্রাটেজি, পলিসি এবং প্রোগ্রামের সমন্বয়ে জন্মলাভ করা এসব গ্রিন ইন্ডাস্ট্রির মূলমন্ত্রই থাকে একটি সুষ্ঠু উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। ইউনাইটেড ন্যাশন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (UNIDO)-এর বর্ণনা অনুসারে, গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি বলতে বোঝায় একটি টেকসই মানোন্নয়ন ব্যবস্থার রূপরেখা বা যাত্রাপথ, যা কিনা অর্জন করা যেতে পারে সুষ্ঠু ও সঠিক পাব্লিক ইনভেস্টমেন্ট এবং পাব্লিক পলিসি গ্রহণ করার মাধ্যমেই।
একটি গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি হবে সকল দিক দিয়েই পরিবেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। অর্থাৎ, অন্যান্য যেসব ইন্ডাস্ট্রি পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ, গ্রিন ইন্ডাস্ট্রির ধারণাটি ঠিক তার উলটো, এই ইন্ডাস্ট্রিসমূহ প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না। পরিবেশ, জীব ও মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এমন ধরনের উৎপাদন না করাই এই ইন্ডাস্ট্রিসমূহের মূল লক্ষ্য। মূলত একটি গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, অন্যদিকে পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থার অবনতি না ঘটিয়ে কিভাবে উৎপাদন ও এর বৃদ্ধি ঘটানো যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কাজ করে।
আরো সহজ করে যদি বোঝানো যায় তাহলে বলা যায় যে, গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা উৎপাদনের জন্য যেসব প্রাকৃতিক প্রভাবক ও যোগান সরবরাহ করে থাকি, যেমন- পানি, প্রাকৃতিক শক্তি ( হতে পারে গ্যাস) কিংবা কাঁচামাল- এসবের ব্যবহার কমিয়ে আনা হবে। কঠিন ও তরল বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার চেষ্টা করা হবে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনো রকম বিষাক্ত পদার্থের ব্যবহার করা হবে না এবং উৎপাদনের ফলে পরিবেশের ক্ষতি করে এরকম কোনো প্রকার গ্যাস যেন নির্গত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে উৎপাদন করাই গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিসমূহের মূল লক্ষ্য।
পরিবেশবান্ধব স্থাপনার শর্ত পরিপালন বিবেচনায় মোট চারটি ক্যাটাগরিতে সনদ প্রদান করে USGBC আর তা হলোঃ
ক। সার্টিফাইডঃ ৪০-৪৯ পয়েন্ট
খ। সিলভারঃ ৫০-৫৯ পয়েন্ট
গ। গোল্ডঃ ৬০-৬৯ পয়েন্ট
ঘ। প্লাটিনামঃ ৮০+ পয়েন্ট
মোট ১১০ পয়েন্টকে সাতটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে এই সার্টিফিকেশন দেওয়া হয়। এবার জেনে নেওয়া যাক ক্যাটাগরিগুলো কী কীঃ
১। জমির ভৌগোলিক অবস্থানেঃ ২৬ পয়েন্ট
২। পানি সাশ্রয়ঃ ১০ পয়েন্ট
৩। প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহারঃ ৩৫ পয়েন্ট
৪। পরিবেশ বান্ধব নির্মাণসামগ্রীঃ ১৪ পয়েন্ট
৫। অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত অবস্থাঃ ১৫ পয়েন্ট
৬। অতি সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত যন্ত্রের ব্যবহারঃ ৬ পয়েন্ট
৭। এলাকাভিত্তিক প্রাধ্যান্যতাঃ ৪ পয়েন্ট
নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরন করে ক্যাটাগরি ভিত্তিক সুনির্দিস্ট পয়েন্ট অর্জন সাপেক্ষে ইউএসজিবিসি থেকে পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়, যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তা হলোঃ
১. কারখানা নির্মাণে কী ধরনের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে; ২. কারখানায় সূর্যের আলোর কী পরিমাণ ব্যবহার হয়;
৩. সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার করা হয় কিনা;
৪. কারখানার নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান আছে কিনা; ৫. স্কুল, বাজার করার ব্যবস্থা বা বাসস্ট্যান্ড রয়েছে কিনা;
৬. সূর্যের আলো ব্যবহার করার পাশাপাশি সৌরবিদ্যুত ব্যবহার এবং বিদ্যুতসাশ্রয়ী বাতি ব্যবহার করা হয় কিনা;
৭. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা ব্যবহার করা হয় কিনা;
৮. কারখানা নির্মাণে নির্দিষ্ট পরিমাণ খোলা জায়গা রাখা হয়েছে কিনা;
৯. অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কিনা;
১০. বৈদ্যুতিক ফিটিংস স্থাপন ছাড়াও অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা ইত্যাদি।
এবার আমরা দেখে নেই লীড সার্টিফিকেশন পাওয়ার ক্ষেত্রে কী কী প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়। LEED Certification-এর জন্য পাচটি ধাপ রয়েছেঃ
১। নির্ধারন করাঃ প্রথমে আপনাকে নির্ধারন করতে হবে আসলে কোন ধরনের সার্টিফিকেশনের জন্য আপনি আবেদন করতে যাচ্ছেন। LEED Certification এর অনেকগুলো ভাগ আছে আবেদন করার জন্য। আপনি সেখান থেকে আপনার যেই ভাগটিতে আবেদন করতে সুবিধা হয় সেই ভাগটিতেই আবেদন করবেন বা করার প্রস্তুতি নিবেন।
২। রেজিস্ট্রেশনঃ LEED Certification টির প্রক্রিয়া রেজিস্ট্রেশানের মাধ্যমে শুরু হয়। যখন আপনি আপনার প্রকল্পটির জন্য রেজিস্ট্রেশান করে প্রয়োজনীয় ফী প্রদান করবেন, তখনি আপনার প্রকল্পটি LEED Online-এ দেখা যাবে। এখান থেকেই আপনি আপনার প্রকল্পের দল তৈরি করে আপনার আবেদন প্রক্রিয়াটি চালু করতে পারেন।
৩। আবেদনপত্র জমা দেওয়াঃ LEED অনলাইনের মাধ্যমে আপনার আবেদনটি জমা দেয়ার দায়িত্ব আপনার LEED প্রকল্পের প্রশাসকের এবং যদিও প্রয়োজন ভিন্ন হতে পারে তবুও তারা সার্টিফিকেশনের জন্য পর্যালোচনা ফী অন্তর্ভুক্ত করবে। সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য প্রকল্পের দলটিকে প্রত্যয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পূর্বশর্তাদি, ক্রেডিট এবং সম্পূর্ণ প্রকল্পের সাধারণ তথ্যাদিসমৃদ্ধ ফর্ম পুরন করে জমা দিতে হবে।
৪। পর্যালোচনা প্রক্রিয়াঃ আবেদন পর্যালোচনার বিষয়টি ভিন্ন ভিন্ন স্থাপনার জন্য ভিন্ন হয়। একটি পূর্ণাঙ্গ আবেদন জমা দেবার পরই আবেদন পর্যালোচনার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পর্যালোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে চূড়ান্ত নির্মাণ ও চূড়ান্ত নকশা পর্যালোচনার পূর্বে ক্রেডিট সংক্রান্ত পুনঃমূল্যায়নের জন্য প্রকল্পের দলটি আবেদন করতে পারবে।
৫। সার্টিফিকেশনঃ সার্টিফাই হবার মাধ্যমেই LEED Certificationএর সকল কাজ শেষ হয়। চূড়ান্ত পর্যালোচনা শেষে প্রকল্পর দলটিকে সিদ্ধান্ত জানান হয়।
সার্টিফিকেশন অর্জনই আসলে শেষ কথা নয়। অর্জিত সার্টিফিকেটের নির্ধারিত মানদণ্ড ধরে রাখাটাই মূখ্য। আশা করি আমাদের সার্টিফাইড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো তাঁদের মানদণ্ড ধরে রাখবে, নতুন নতুন গ্রীন ফ্যাক্টরী গড়ে উঠবে, সবুজে ভরপুর হবে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রিন ইন্ডাস্ট্রির ধারণা কতটা ফলপ্রসূঃ
বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোর দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় যে, রেডিমেড গার্মেন্টস তৈরি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে এ দেশ একটি স্বনামধন্য স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু রপ্তানিযোগ্য এসব গার্মেন্টস তৈরির ক্ষেত্রে ঠিক কোন ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে তা কি আমরা জানি? এসব গার্মেন্টস তৈরির পেছনের গল্পগুলো কতটুকু পরিবেশবান্ধব সেটিও আমাদের অনেকের অজানা।
রেডিমেড গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিসমূহে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে পানি, প্রাকৃতিক শক্তি, যেমন- গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার হয়ে থাকে।
❝এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর রেডিমেন্ট গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে সুতায় রঙ করা বা গার্মেন্টস ওয়াশিংয়ের জন্য প্রায় ১,৫০০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে। এই একই পরিমাণ পানি দিয়ে প্রতিবছর দেশের ৮ লক্ষ মানুষের পানির প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। এই একই পরিমাণ পানি দিয়ে অলিম্পিকের ৬০ লক্ষ সুইমিং পুল পূর্ণ করা যাবে। ওয়াসার রিপোর্ট অনুযায়ী এই পরিমাণ পানির মূল্য হবে প্রায় ৪,৮৮৮ কোটি টাকা।❞
কাজেই খুব সহজে কল্পনা করা যাচ্ছে যে, কী পরিমাণ পানি আমরা ব্যবহার করছি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই ব্যবহারকৃত পানির প্রায় বেশিরভাগই নোংরা পানি হিসেবে পরিবেশে বিমুক্ত করা হয়। কেবল বিপুল পরিমাণ পানির এই ব্যবহারেই যদি সব কিছু সীমিত থাকতো তাহলেও মানা যেত। কিন্তু এই নোংরা পানি এরপর একসময় নদীতে-খালে গিয়ে পড়ে। ইন্ডাস্ট্রির নানারকম কেমিক্যাল মিশ্রিত এই বিষাক্ত পানি নদীর পানির জলজ পরিবেশ ও প্রাণীর জন্য হয়ে দাঁড়ায় হুমকিস্বরূপ।
আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে প্রতিবছর সুতা ও কাপড় ডাইং ও ওয়াশিংয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি লিটার পানি খরচ হয়। বিষ্ময়কর হলেও সত্যি যে, এতো বিপুল পরিমাণ পানি দিয়ে ৬ লাখ অলিম্পিক সুইমিং পুল পূর্ণ রাখা সম্ভব। সমপরিমাণ পানি এক বছরে ৮ হাজার লোকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। প্রতিটি জিন্স প্যান্ট যার ওজন প্রায় ১ কিলোগ্রাম, এমন একটি প্যান্ট ওয়াশিংয়ে আড়াইশ লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। এই পানি কোনো কেমিক্যাল নয়, স্রেফ সাধারণ পানি, যা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভয়াবহমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এভাবেই বাড়ছে দিনে দিনে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। সাধারণত ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে যখন এতো বিশাল পরিমাণের পানি তোলা হয়, তখন সেখানে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এভাবে যতো শূন্যতার সৃষ্টি হবে ততো ভূমি নিচের দিকে দেবে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বেশিরভাগ এলাকার পানির স্তর সুবিধাজনক এবং নিরাপদ অবস্থানে নেই। ফলে যে কোনো ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়াও আছে প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার, যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস। একদিকে দেশে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান এখনো সেভাবে সম্ভব হয়নি। কোনো কারণে লোডশেডিং হলেও ইন্ডাস্ট্রি কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ করে বসে থাকার তো উপায় নেই। সেকারণে প্রাকৃতিক গ্যাস জরুরি। এছাড়া বয়লারে পানি গরম করতেও প্রাকৃতিক গ্যাস প্রধান চাহিদা। এরপরও আছে উৎপাদনের ফলে উৎপন্ন হওয়া বিষাক্ত গ্যাস সহ অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ, যা পরিবেশের সংস্পর্শে আসলে আমাদের ক্ষতিরই কারণ হবে।
কাজেই পরিবেশের সর্বনাশটুকু হওয়ার আগেই আমাদের সাবধান হওয়া জরুরি। পানির এই বিপুল ব্যবহার কমিয়ে আনা যায় কিভাবে, প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবর্তে আমরা অন্য কোনো শক্তির উৎসের ব্যবস্থা করতে পারি কি না, সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা কতটা সুফল পেতে পারি, বর্জ্য পানি কিংবা কঠিন পদার্থকে পুনরায় ব্যবহার করা যায় কি না- এসব বিষয় বিবেচনা করাই এখন শিল্পপতিদের লক্ষ্য। মূলত এটিই হয়ে যাচ্ছে আমাদের আলোচ্য গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি ধারণার মূল প্রতিপাদ্য।
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই এই গ্রিন ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও লাভ করেছে উচ্চপর্যায়ের খ্যাতির। ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী অ্যাপারেল বা গার্মেন্টস সেক্টরে বিশ্বের প্রথম তিনটি গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিই বাংলাদেশের। টেক্সটাইল টুডে এর ৪ মার্চ, ২০১৮ এর প্রতিবেদন বলা হয় যে, ইউনাইটেড স্টেট গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (USGBC) অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৭টি গ্রিন ফ্যাক্টরি আছে যেগুলো লিডারশিপ ইন এনার্জি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (LEED) এর অনুমোদনপ্রাপ্ত, যাদের মধ্যে ১৩টি এলইইডি প্লাটিনাম, ২০টি এলইইডি গোল্ড এবং ৫টি এলইইডি সিলভার সনদ লাভ করেছে। এছাড়া প্রায় ২৮০টির মতো ফ্যাক্টরি এই অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বর্তমানে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ইউরোপীয় বাংলাদেশে উৎপাদিত টি-শার্ট পরিধান করে এবং প্রতি ৫ জন আমেরিকানের মধ্যে ১ জন বাংলাদেশে উৎপাদিত জিন্স পরিধান করে। কিন্তু এগুলো উৎপাদনের নেপথ্যের কাহিনী তাদের অজানা, আমাদের অজানা নয়। আর এর ক্ষতিকর প্রভাবও পড়ছে আমাদের উপরই। সেজন্যেই এখন ইন্ডাস্ট্রির মালিকগণ এই সবুজ আন্দোলনের পথে নেমেছেন। দেশে এখন আস্তে আস্তে গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যা বাড়ছে। আর সেই সাথে বাড়ছে পরিবেশবান্ধব বস্ত্র উৎপাদন শিল্পের। কারণ আমাদের পরিবেশবান্ধব পোশাক ইন্ডাস্ট্রির সুনাম সম্পর্কে বিদেশী ক্রেতাগণ অবহিত হচ্ছে এবং তাদের দৃষ্টি আমাদের উপর পড়ছে। কারণ তুলনামূলকভাবে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে পোশাকশিল্পে আমাদের থেকে বেশি গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি আর কোথাও নেই। ইন্দোনেশিয়ায় আছে ৪০টি, আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে আছে ৩০টি এবং শ্রীলংকায় আছে ১০টি। কাজেই আমাদের সম্ভাবনা আছে প্রচুর।
সর্বোপরি বলা যায়, সাস্টেইন্যাবিলিটি এখন আর আমাদের বিকল্প বা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নেই। এটি আমাদের জন্য একমাত্র চাওয়া হয়ে উঠেছে। কারণ যেভাবে বৈশ্বিক পরিবেশের অবনতি হচ্ছে তাতে ক্ষতিটা আমাদেরই তো হবে। কাজেই এই ক্ষতি থেকে বাঁচতে আবার নিজের খেয়ে-পরে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবুজ বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। আর পরিবেশকে টিকিয়ে রেখে উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে অনেক। আরো এগিয়ে যাক এটাই আমাদের কাম্য।
বাংলদেশে গার্মেন্টস খাতে গ্রিন ফ্যাক্টরির প্রচলন বাড়লে বিদেশি ক্রেতারা আগের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকবেন এদেশে প্রস্তুত গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রয়ের প্রতি। এদেশের লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের জীবন পাল্টে যাবে। বর্তমানে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের যে সব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা গ্রিন ফ্যাক্টরির মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব।
source: roar.media, rmg bangladesh
Writer:Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador – TES
National Institute of Textile Engineering & Research (NITER)