আমরা মানুষেরা তো ত্রিমাত্রিক প্রানী, তাই না? তার মানে আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখি সবকিছুই থ্রি ডায়মেনশনাল? আচ্ছা কিভাবে বুঝলাম আমরা তৃমাত্রিক? যদিও আজকের টপিকের মূল বিষয়বস্তু এটা না,তবে কনসেপ্ট ক্লিয়ারর জন্য ছোট করে একটু আলোচনা সেরে নেয়া যাক…. একটা পিপড়াকে ধরে সাদা কাগজের উপর ছেড়ে দিলেন,সে কাগজের এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে। যেদিকেই যাক,পিপড়াটা মূলত দিমাত্রিক কিংবা (X,Y) অক্ষ বরাবর ছুটছে। কিন্তু একটা মানুষ কিংবা ঘোড়াকে কোনো একটা সমতল পৃষ্ঠের উপর ছেড়ে দেন। দেখবেন সে X,Y অক্ষ ছাড়াও উপরের দিকে লাফাবে….. ।
তার মানে মানুষ কিংবা ঘোড়ার মুভমেন্ট পিপড়ার চেয়ে একটা অক্ষ বেশি? ধরে নিলাম মানুষ ৩ অক্ষ বরাবর চলাচল করতে সক্ষম। এই যে ৩টা অক্ষ এটাকে আমরা কল্পনা করি X,Y,Z হিসাবে। তার মানে আমরা তো ত্রিমাত্রিক? অবশ্য অনেক বিজ্ঞানীরা এই X,Y,Z কে স্থান,কাল, সময়সহ আরো কি সব হাবিজাবি দিয়ে বর্ননা করেন। এবার চোঁখ দুটো বন্ধ করে ভাবুন, আমরা ত্রিমাত্রিক থেকে কোনো এক কারনে কোনো এক ভোর বেলায় চতুর্থমাত্রিকে পরিণত হলাম। তখন কি ঘটবে? তখন নিশ্চয় আপনার জন্য আরো একটা অক্ষ উন্মুক্ত হবে? তার মানে আরো একটি নতুন রাস্তায় আপনার লাফালাফির সুযোগ হবে? প্রাথমিক দিকে নতুন অক্ষের কারনে বেশ গোলযোগ সৃষ্টি হবে? সবাইকে অতিরিক্ত আরো একটি অক্ষের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে আরো সময় লাগবে?
সাময়িকভাবে একটা বিরূপ ঘটনা ঘটলেও হয়ত আস্তে আস্তে পরিবেশ একটা শিথীলতার পর্যায়ে আসবে? যাক এবার মূল আলোচনায় আসা যাক।আসলে শিল্পবিপ্লবের সাথে মানুষ কত মাত্রিক সেটার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত নয়,তবে ছোট একটা উউদাহরনের সাহায্যে নিলাম আরকি। একটা সময় আমরা প্রথম শিল্প বিপ্লবের যুগে ছিলাম, তখন আমাদের জীবনযাত্রার মান ছিলো একরকম,এরপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লব দ্বারা পৃথিবী আরো অগ্রসর হলো। তবে প্রতিটা বিপ্লবের পরপর কিংবা সমসাময়িক সময় পৃথিবী খেত ছোট-খাটো একটা ধাক্কা। হয়ত একটু চেষ্টা করে পরিস্থিতি মোটামুটি একটা অনূকূল পরিবেশে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে সামনে আগত চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের আর্থ ও সামাজিকভাবে কি কি প্রভাব পড়বে তারই ধারাবাহিক একটি পর্ব সাজিয়েছি। তাহলে মূল আলোচনায় আসা যাক? আমরা নতুন একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি যা আমাদের জীবনযাত্রা, কাজ করা এবং একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার বিষয়বস্তুকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করবে। এর স্কেল, স্কোপ এবং জটিলতার রূপান্তরটি মানবজাতির আগে যা কিছু করেছিল তার থেকে অনেকটা বিপরীতে হবে। এটি কীভাবে উদ্ঘাটিত হবে তা আমরা এখনও জানি না, তবে একটি বিষয় স্পষ্ট: এর প্রতিক্রিয়া অবশ্যই একীভূত এবং ব্যাপক হতে হবে।
সরকারী ও বেসরকারী খাত থেকে শুরু করে একাডেমিয়া এবং নাগরিক সমাজের সবাই এমনকি বিশ্বব্যাপী সমস্ত অংশীদাররাই এর সাথে জড়িত। প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছিলো উত্পাদনের যান্ত্রিকীকরণে জল এবং বাষ্প শক্তি ব্যবহার করে। দ্বিতীয় বৃহত্তর শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিলো উত্পাদন তৈরি করতে বিদ্যুৎ শক্তি ব্যাবহার করে। তৃতীয শিল্পবিপ্লবটি হয়েছে উত্পাদন স্বয়ংক্রিয় করতে ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে।তৃতীয়টির উপরে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব তৈরি হচ্ছে, যাকে আমরা ডিজিটাল বিপ্লব হিসাবে কল্পনা করতে পারি, যা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি এমন প্রযুক্তির সংশ্লেষন দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা শারীরিক, ডিজিটাল এবং জৈবিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যকার সম্পর্কগুলোকে ঝাপসা করে তুলে। আজকের রূপান্তরগুলো তৃতীয় শিল্প বিপ্লবকে দীর্ঘায়িত করার পরিবর্তে চতুর্থ এবং স্বতন্ত্র একের আগমনকে প্রতিনিধিত্ব করারও অবশ্য তিনটি কারণ রয়েছে, যার মূল উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো বেগ, সুযোগ এবং সিস্টেমের প্রভাব। বর্তমান ব্রেকথ্রুগুলোর গতির কোনও ঐতিহাসিক নজির নেই। পূর্ববর্তী শিল্প বিপ্লবগুলোর সাথে তুলনা করা হলে , চতুর্থটি একটি রৈখিক গতির চেয়ে ক্ষণস্থায়ী হিসাবে বিকশিত হচ্ছে। তদুপরি, এটি প্রতিটি দেশের প্রায় প্রতিটি শিল্পকে ব্যহত করছে। এবং এই পরিবর্তনগুলির প্রস্থ এবং গভীরতা উত্পাদন, পরিচালনা ও প্রশাসনের পুরো ব্যবস্থার রূপান্তরকে সূচিত করবে। অভূতপূর্ব প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা, স্টোরেজ ক্ষমতা এবং জ্ঞানের অ্যাক্সেস সহ মোবাইল ডিভাইসগুলির মাধ্যমে সংযুক্ত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সম্ভাবনা সীমাহীন। আর এই সম্ভাবনাগুলিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস, স্বায়ত্তশাসিত যানবাহন, 3-ডি প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজিস, উপকরণ বিজ্ঞান, জ্বালানী সঞ্চয়স্থান এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলিতে উদীয়মান প্রযুক্তির অগ্রগতি দ্বারা গুণিত করা হবে।
ইতিমধ্যে, অহরহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা সম্পন্ন একাধিক যন্ত্র আমাদের চারপাশে রয়েছে।হাত বাড়ালেই স্ব-ড্রাইভিং গাড়ি এবং ড্রোন থেকে ভার্চুয়াল সহায়ক এবং সফ্টওয়্যার যা অনুবাদ বা বিনিয়োগ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এআইতে চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি হয়েছে, যা আমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রহের পূর্বাভাসের জন্য ব্যবহৃত নতুন ড্রাগগুলি অ্যালগরিদমগুলিতে আবিষ্কার করতে ব্যবহৃত সফ্টওয়্যার থেকে শুরু করে কম্পিউটিং পাওয়ারে তাত্পর্যপূর্ণ বৃদ্ধি এবং বিপুল পরিমাণে ডেটা প্রাপ্যতার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ডিজিটাল বানোয়াট প্রযুক্তিগুলি, ইতিমধ্যে, দৈনিক ভিত্তিতে জৈব জগতের সাথে যোগাযোগ করছে। প্রকৌশলী, ডিজাইনার এবং স্থপতিরা গণ্য নকশা, সংযোজনীয় উত্পাদন, উপকরণ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সিন্থেটিক বায়োলজির সংমিশ্রণ করে অণুজীব, আমাদের দেহ, আমরা যে পণ্যগুলি গ্রহণ করি এবং এমনকি আমাদের বাসস্থানের মধ্যে একটি সিম্বিওসিসের পথিকৃত হয়। (আগামী পর্বে আলোচনা করবো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে কি কি চ্যালেন্জের সম্মুখীন হতে হবে এবং আমাদের জন্য কি কি সুযোগ ও সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে)
বি.দ্র.- এই কনসেপ্টটি Foreign Affairs পত্রিকার মূলভাব থেকে নেয়া হয়েছে।
খালেদুর রহমান সিয়াম
টেক্সটাইল ডিপার্টমেন্ট, ৯ম ব্যাচ, জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষনা ইন্সটিটিউট