“টাইপোগ্রাফি বা মুদ্রণশৈলী”- সহজ করে বললে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘বর্ণের অলংকরণ’।এটি এমন এক আর্ট, যার মাধ্যমে বর্ণ অলংকৃত করা হয়। যেমন, একটি পোশাকের নাম লিখা হলো। কিন্তু সোজা ভাবে না লিখে, প্রথম অক্ষরটা একটু বড় করে লিখে কিংবা প্রথম অক্ষরটার রঙ অন্যদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো। কিংবা নামের প্রথম অক্ষর ঠিক রেখে বাকী গুলো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটা কলমের আকৃতিতে লিখা হলো। লিখার এই কৌশল গুলোকেই একত্রে “টাইপোগ্রাফি” বলে। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের অক্ষরকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাজানোকে বলে “টাইপোগ্রাফি”।
ইতিহাসঃ “টাইপোগ্রাফি” ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। বহু যুগের পুরোনোই বলা চলে। আরবি ভাষায় টাইপোগ্রাফিকে আমরা বেশ ভালোই চিনি ‘ক্যালিগ্রাফি’ নামে। অনেক আগে থেকেই মুসলমান শিল্পীরা কোরআন ও হাদিসের বাণীকে শৈল্পিকভাবে লিখে রাখতেন। এজন্য আরবি ‘ক্যালিগ্রাফি’ বা “টাইপোগ্রাফি” অনেক সমৃদ্ধ। ‘ক্যালিগ্রাফি’ ও টাইপোগ্রাফির অর্থ এক হলেও ‘ক্যালিগ্রাফি(চারুলিপি/লিপিকলা)’ বলতে একচ্ছত্রভাবে আরবি টাইপোগ্রাফিকেই বোঝানো হয়। যেহেতু আগে কম্পিউটার ছিল না, তাই তখন হাতেই ‘ক্যালিগ্রাফি’ করা হতো। আর সেসব ক্যালিগ্রাফির উদ্দেশ্যে ছিল উপহার দেওয়া, ঘরের দেয়ালে বাঁধাই করে ঝুলিয়ে রাখা অথবা কোনো ধর্মীয় বাণীকে, সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
মূলত বাংলাদেশে পোশাকে টাইপোগ্রাফির শুরুটা ষাটের দশকে, শিল্পী কামরুল হাসানের হাত ধরে। নিউ মার্কেটে রূপায়ণ নামে পোশাকের দোকান ছিল তার। তিনি একুশের শাড়ীতে প্রথম “টাইপোগ্রাফি” ফুটিয়ে তোলেন। আশির দশকের শেষভাগে “টাইপোগ্রাফি” নিয়ে কিছু কাজ করেছিল ‘ফ্যাশন হাউস আড়ং’। তবে টাইপোগ্রাফির পোশাক সহজলভ্য ও জনপ্রিয় করার কাজটি করেছে ‘ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহার’। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো টি-শার্টে টাইপোগ্রাফির নকশা করেছে তারা। শিল্পী সব্যসাচী হাজরা রবি ঠাকুরের ‘নব আনন্দে জাগো’ আর শিল্পী ধ্রুব এষ জীবনানন্দের ‘আকাশলীনা’ কবিতা দিয়ে টি-শার্টের নকশা করেছিলেন।
বুননে বর্ণমালাঃ পোশাকের ডিজাইনে শৈল্পিক উপস্থাপনা হিসেবে “টাইপোগ্রাফি” একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইদানিং তাই ফ্যাশন ডিজাইনাররা নানাভাবে নানা উপলক্ষে পোশাকের নকশা হিসেবে “টাইপোগ্রাফি” ব্যবহার করছেন।
শুরুটা হয়েছিল শাড়ি দিয়েই। শাড়ির জমিন, আঁচল আর পাড়কেই ক্যানভাস হিসেবে ব্যবহার করতেন ডিজাইনাররা। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঞ্জাবি। এখন শাড়ি – পাঞ্জাবি তো বটেই ওড়না, কামিজ, টপস, ফতুয়া, কুর্তা, শার্ট, টি-শার্ট, কটি, শাল, রুমাল, ব্যান্ডেনা, উত্তরীয় থেকে শুরু করে পরিধেয় প্রায় সব ধরনের পোশাকেই ছাপ ফেলছে “টাইপোগ্রাফি” বা ‘বর্ণের অলংকরণ’।
টাইপোগ্রাফির মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা হচ্ছে পোশাকের নকশায়ও। খনার বচন, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের বিভিন্ন পদ, জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ কিংবা আবুল হাসানের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের চিঠি, গান, স্বাক্ষর, গল্পের লাইন ইত্যাদি নকশা হিসেবে মূর্ত হয়ে ওঠে পোশাকে।
একেকটা বর্ণ যেন একেকটা আবেগ। বাংলা বর্ণমালার গোটা ইতিহাসটাই আবেগময়। সেই আবেগের প্রকাশ ঘটে পোশাকেও। মমতায় মাখা এসব বর্ণমালা কেবল নকশা হিসেবেই নয়, অনেক সময় মোটিফ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। যেমন- বসন্তে পলাশের মোটিফ নিয়ে এর সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের কবিতার দুটি লাইন জুড়ে দিয়ে পুরো মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়। কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারির পোশাকে আবু জাফর ওবায়দুল্লার ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতার কয়েকছত্র কিংবা অ আ ক খ ইত্যাদি বর্ণমালাকে পাঞ্জাবি বা শাড়ির ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা হয়।
অর্থনীতিতে প্রভাবঃ ফেব্রুয়ারি- অর্জন, শোক, আনন্দ ও উৎসবের মাস। এই মাসের চেতনা যেমন বাঙালির মনকে নানাভাবে ছুঁয়ে যায়, তেমনি সেই ছোঁয়া লাগে পোশাকেও। মাতৃভাষা দিবস ও বসন্ত উৎসবকে ঘিরে দেশীয় পোশাকের চাহিদা থাকে পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে।
যেকোনো উৎসব – পার্বণই হোক কিংবা জাতীয় কোনো গৌরবময় উপলক্ষ্য। বসন আর ভূষণে বাঙালি সাজ আর বাঙালি পোশাক যেন বহুদিন থেকেই স্বতন্ত্র এক গল্প।
শুধু একুশের পোশাকই নয়, বর্তমানে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী, স্বাধীনতা দিবস, মা-দিবস সহ বিশেষ দিবসের পোশাকে টাইপোগ্রাফির নকশা করছে। বর্ণ ও শব্দের বিন্যাসে আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিল্প-সংস্কৃতির অনেক বিষয়ও ফুটিয়ে তোলেন ডিজাইনাররা। শৈল্পিক এই ডিজাইনগুলোতেও থাকে নিজস্বতার ছাপ। তাছাড়া দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে দেশীয় পোশাকের অবদান প্রশংসনীয়।
আর এভাবেই বিভিন্ন উৎসব ও দিবসগুলোকে ঘিরে দেশীয় পোশাকের চাহিদা দেশের অর্থনীতিতে বিস্তর প্রভাব ফেলে।
জনপ্রিয়তাঃ গোটা বিশ্ব জুড়ে হাতে লেখার ফ্যাশন চলছে রমরমিয়ে। হাতে লিখা চিঠি তো হারিয়ে গেছে সেই কবেই! কিন্তু ইদানিং মনে হচ্ছে, ফ্যাশন ডিজাইনাররা এই হারিয়ে যাওয়া লেখাকে তাদের সৃষ্টিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে ভালোই চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্ক্রিপ্টেড পোশাকের চাহিদা খুব বেশি। শুধু এদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক ফ্যাশন মানচিত্রেও হাতে লেখা অক্ষরের অবদান সাঙ্ঘাতিক।
“টাইপোগ্রাফি” ডিজাইনের অন্যতম একটি অংশ। টাইপোগ্রাফির সঠিক ব্যবহার করে ডিজাইনে পরিপূর্ণতা আনা সম্ভব। তাই পরিশেষে বলা যায়, ডিজাইনের আউটলুক, মুড, ব্যতিক্রমী মাত্রা কিংবা ক্রিয়েটিভিটি বাড়াতে টাইপোগ্রাফির বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্রঃ গুগল এবং ইউটিউব।
লেখিকা পরিচিতিঃ
আছিয়া আক্তার
১ম বর্ষ, ব্যাচ-২৪
সেশনঃ ২০১৯-২০২০
বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।