তাঁতের শাড়ির কথা শুনলেই প্রথমেই যে নামটি মাথায় আসে তা হলো টাঙ্গাইল এর কথা। কারন সেই অনেক আগ থেকেই আমাদের মা খালা, নানী, দাদীদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এর সাথে। বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ইতিহাস অনেক পুরাতন।টাঙ্গাইল জেলার তাঁত শিল্প সেই সর্ববৃহৎ শিল্পের অন্যতম অংশীদার। সেই অনেক আগ থেকেই টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তৈরি করছেন নানা জাতের কাপড়। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং এর ভ্রমন কাহিনীতে টাঙ্গাইল বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙাইলের সুনাম বিশ্বব্যাপী।
ইতিহাসঃ টাঙাইলের তাঁতের শাড়ির নির্ভরযোগ্য ইতিহাস আজ পর্যন্ত জানা যায় নি। ইতিহাসবিদদের মতে, বুনন শিল্পের উপর নির্ভরশীলতা ছিলো অনেকটা যাযাবরের মতো। সিন্ধু নদীর তীরে এদের পূর্ব পুরুষদের আবাস ছিলো। সেখান থেকে জীবন জীবিকার তাগিদে এরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। রাজা লক্ষন সেনের আমলে এদের একটা অংশ ছুটে আসে এ উপমহাদেশে। ধামরাই এবং টাঙাইলের আশেপাশে এদের কিছু সংখ্যক জীবন জীবিকার সন্ধানে বসবাস করতে থাকে। ধামরাইতে আসা বুনন শিল্পীরা পেশা পরিবর্তন করলেও টাঙাইলে আগতরা পূর্ব পুরুষের জীবিকাকেই আঁকড়ে রাখে। সেই থেকে এ অঞ্চলে বুনন শিল্পীদের গোড়াপত্তন হয়। ইতিহাসবিদদের এমনটাই ধারনা। আরো জানা যায় যে উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে টাঙাইল তাঁতশিল্প প্রসার পায়। টাঙাইল শাড়ির তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতীদের বংশধর।
বৈশিষ্ট্যঃ প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাড় বা কিনারার কাজ। টাঙাইল শাড়িতে কাপড়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সূক্ষ কারুকাজ থাকে। অন্যান্য শাড়ি ১০-১২ হাত মাপে হলেও এই শাড়ি তৈরি হয় ১৪ হাত মাপে। এ শাড়ি তৈরির জন্য ১০০, ৮০, ৮২, ৮৪ কাউন্টের সুতার ব্যবহার হয়। পড়তে বেশ নরম ও আরাম অনুভব হয় টেকেও অনেক দিন।
উৎপাদন কেন্দ্রঃ নাম শুনেই বুঝা যায় এ শাড়ি কোথায় উৎপাদন হয়। তবে এ শাড়ি টাঙাইলের বিশেষ কিছু জায়গা ছাড়া সব জায়গায় পাওয়া যায় না। টাঙাইলের বাজিতপুর ও পাতরাইল অঞ্চলের বিশেষ শ্রেণীর তাঁতীরা বংশানুক্রমে এই শাড়ি তৈরি করে আসছে। টাঙাইল জেলার ১১ টি উপজেলা আর ১ টি থানার মধ্যে টাঙাইল সদর, কালিহাতী, নাগরপুর,সখীপুর উপজেলা হচ্ছে তাঁতবহুল এলাকা। এছাড়া ভূঞাপুর উপজেলায় তাঁত শিল্প রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক গ্রামেই তাঁতের প্রচলন রয়েছে। তবে টাঙাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় এ রকম তাঁতের সংখ্যা ২০ হাজারের ও কম। আর এ ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরী হয় প্রধানত বাজিতপুর, পাথরাইল, নলসুন্দা, চন্ডি, বিষ্ণুপুর ও বিন্নাফৈর গ্রামে।
টাঙাইল শাড়ির প্রকারভেদঃ টাঙাইলের তাঁতীরা বিভিন্ন জাতের শাড়ি তৈরি করেন। এগুলো হলোঃ১.সুতি শাড়ি, ২. আধা-রেশমি বা হাফসিল্ক শাড়ি, ৩. সফট সিল্ক শাড়ি, ৪.সুতি জামদানি শাড়ি, ৫. গ্যাস মারচেন্ডাইজড শাড়ি, ৬. টুইস্টেড-সুতি শাড়ি, ৭. ডাংগ্য শাড়ি, ৮. বালুচরি শাড়ি ইত্যাদি।
তাছাড়া টাঙাইলের শাড়ি বোনার তাঁত ২ ধরনেরঃ
১. চিত্তরঞ্জন তাঁত বা মিহি তাঁত
২. পিটলুম তাঁত বা খটখটি তাঁত।
এ দুই ধরনের তাঁতেই তৈরী করা হয় নানা রঙ ও ডিজাইনের নানা নামের শাড়ি। যেমনঃ জামদানী বা সফট সিল্ক, হাফসিল্ক, টাঙাইল বিটি, বালুচরি, জরিপাড়, হাজারবুটি, সূতিপাড়, কটকি, স্বর্নচুড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, সানন্দা, নীলাম্বরী, ময়ূরকন্ঠী এবং সাধারণ মানের শাড়ি।
টাঙাইলের আদি শাড়ি বলতেই সুতি শাড়ি। বাঙালীর সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী এ অঞ্চলে আগে তিন ধরনের শাড়ি বোনা হতো। বিধবাদের জন্য থান শাড়ি, সধবা ও কুমারীদের জন্য নকশাপাড় এবং বুটি শাড়ি। যা বোনা হয় হাতেটানা তাঁতে। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে খটখটি বা গর্ত তাঁত।
নকশাঃ টাঙাইল শাড়ির ডিজাইন বা নকশায় যে বিশেষ দিকটি লক্ষ্যনীয় তা হলো পাড়ের নকশার সাথে সঙতি রেখে রঙিন সুতার সাহায্যে জমিনের নকশা। পূর্বে এই নকশায় অলংকরনের জন্য ব্যবহৃত হত পাকানো সুতা। বর্তমানে এর সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে রেয়ন, জরি, মেটালিক জড়ি। এসিব সুতার সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক নকশা যেমনঃ ফুল, পাখি, লতা, পাতা, ইত্যাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক নকশা ব্যবহার করা হয়।
বুনন পদ্ধতিঃ ৪০ টা সুতা জ্যাকার্ড যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রন করা যায়। যন্ত্রে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। এটা খুবই জটিল ও সৌখিন বুনন প্রক্রিয়া। এই জ্যাকার্ড যন্ত্রে ১০০০ টানা সুতা নিয়ন্ত্রন করা হয় ও অত্যান্ত সূক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এতে হার্নেস এর পরিবর্তে নাইলন সুতা ব্যবহার করা হয়। নিয়ন্ত্রন করার জন্য হার্নেসের ফ্রেমের পরিবর্তে অসংখ্য হুক লাগানো থাকে। কাপড়ে বা পাড়ে যে নকশাটি বোনা হবে সেটা punch card বা নকশা অনুযায়ী ছিদ্র বিশিষ্ট কার্ড দ্বারা করা হয়। নকশার ছিদ্রে হুক আটকানো থাকে। punch card এর সাহায্যে প্রতিটি সুতাকে নিয়ন্ত্রন করে নকশা করা হয়। কার্ডে আঁকা নকশা কাপড়ে বোনা হয়ে গেলে কার্ডটা পড়ে যায়। আবার নক্সার নতুন অংশের আরেকটি কার্ডের কাজ শুরু হয়। এভাবে ক্রমাগত নকশা হতে থাকে। পড়েন সুতা আসা যাওয়া করতে থাকে। এই কাপড় বুননের জন্য সাধারণত বিদেশ হতে আমদানিকৃত সুতা ব্যবহার করা হয়।
টাঙাইল শাড়ির ব্যবহারঃ বৈচিত্র্যময় টাঙাইল শাড়ি শুধুমাত্র অনুষ্ঠান উৎসবে পরার জন্য নয়, সাধারণ ফর্মাল বা ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবেও এর সমান কদর রয়েছে। একটা সময় ছিলো যখন তাঁতের শাড়ি ছিল শুধুই মধ্যবিত্তের পরিধেয় বস্ত্র তবে যুগের পরিবর্তনে রুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে। গরমে আধুনিক নারীর প্রথম পছন্দ হল এ তঁতের শাড়ি। যে কোনো ঋতুর উৎসবেই টাঙাইলের তাঁতের শাড়ির রয়েছে একটা আলাদা কদর।
আটপৌরে গ্রামীণ নারী থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারী এমনকি সেলিব্রেটিদের কাছেও তাঁতের শাড়ির জনপ্রিয়তা রয়েছে। শুধু আরামের দিক থেকেই নয়, ডিজাইনের দিক থেকে অভিনবত্ব ও রঙের বৈচিত্র্য আছে এখনকার শাড়িগুলোয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, জাপান, সৌদি আরব ও ভারতের কিছু রাজ্যে এ শাড়ির সুখ্যাতি রয়েছে।
চৈতী দেব নাথ বৃষ্টি
ক্যাম্পাস টিম মেম্বার
বাংলাদেশ হোম ইকোনোমিক্স কলেজ।