বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির প্রধান শক্তিমত্তা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো প্রাকৃতিক গ্যাস।
মূলত দেশে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি প্রায় ৪ দশক আগে শুরু হয়েছে। অনেক বাধা বিপত্তি, সীমাবদ্ধ অতিক্রম করে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরও বাস্তবে এই ইন্ডাস্ট্রি পুরোপুরি শক্তভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি।
এখনো বাংলাদেশের এই ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। স্বল্প শ্রমিক মজুরি সহ কিছু সুবিধার কারণে দেশে স্বল্প মূল্যের গার্মেন্টস প্রোডাক্ট এর বেশি উৎপাদন সম্ভব, এজন্য বেসিক গার্মেন্টস প্রোডাক্ট গুলোর প্রোডাকশন দিয়েই চলছে ইন্ডাস্ট্রি। অথচ চীন এসব স্বল্প মূল্যের গার্মেন্টস প্রোডাক্ট গুলো দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি দাঁড় করালেও, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির পর এখন উচ্চমূল্যের ও বৈচিত্র্যময় পোশাক উৎপাদনের দিকে ঝুকছে, আর আমরা তাদের ই ফেলে দেয়া বাজার দখলে ব্যস্ত।
অর্থাৎ বিশ্ববাজারে আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার ইউনিক ওয়ে এখনো আমরা বের করতে পারি নি।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকার মূল দুটি কারণ হলো:-
১) শ্রমিকদের স্বল্প মজুরি।
২) জ্বালানি খাতে কম খরচ।
কিন্তু এই দুটি প্রধান শক্তিমত্তাই এখন ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা আর দ্রব্যমূল্যের সাথে সাথে শ্রমিকদের মজুরি ও বাড়াতে হবে, এটা তাই কোনো স্থায়ী শক্তিমত্তা হতে পারে না। ইতিমধ্যেই ২০১৮ তে ন্যূনতম ৫৬০০ টাকা মাসিক বেতন থেকে ৮০০০ টাকা ধার্য্য করা হয়েছে। আগামী ১ বছরের মধ্যে আরো বাড়ার সম্ভবনা রয়েছে। আর ইন্ডাস্ট্রি থেকে নতুন উচ্চমূল্যের ও বৈচিত্রময় প্রোডাক্ট উৎপাদনের মাধ্যমে আগাতে হলেও শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে তখন মজুরিও বাড়াতে হবে অবশ্যই। তাই এই শক্তিমত্তা দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে ভবিষ্যতে কতোটুকু অবদান রাখবে তা চিন্তার বিষয় !!
এবার মূল বিষয় নিয়ে আলোচনায় আসা যাক।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি গুলো এখন সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা হলো জ্বালানি সংকট।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি গুলোর ব্যবহৃত জ্বালানি গুলোঃ-
প্রাকৃতিক গ্যাস-৮৫%
লিকুইড ফুয়েল-৬.৭৬%
কয়লা-৫.৪১%
হাইড্রোপাওয়ার-২.৪৫%
বিশ্ববাজারে RMG এক্সপোর্টার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দী দেশগুলোর থেকে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপস্থিত পরিমাণ অনেক বেশি। আর প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে খরচ অন্যান্য জ্বালানি অপেক্ষা অনেক কম। আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের খরচ হিসাব করলেও সে তুলনায় প্রাকৃতিক গ্যাস ৬০-৭০% সাশ্রয়ী।
মূলত প্রধান জ্বালানি হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার না হলে দেশের ইন্ডাস্ট্রি দাড়াতেই পারতো না। কিন্তু বর্তমান প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইন সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ ও হয়ে যাচ্ছে। গত ২ বছরেই দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ২২২% বৃদ্ধি করা হয়েছে। দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধিতে গার্মেন্টস গুলো মুখ থুবড়ে পরছে।
অপর দিকে গ্যাসের পর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জ্বালানি হলো লিকুইড ফুয়েল। দেশের গার্মেন্টস এ লিকুইড ফুয়েল হিসাবে সাধারণত জ্বালানি তেল ডিজেল ব্যাবহৃত হয়। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে জ্বালানি তেলের দান আন্তর্জাতিক বাজারের ১.৫-২ গুণ। এমনকি বর্তমানে যখন করোনা দূর্যোগে চাহিদার অভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেক কমানো হয়েছে,তখন ও দেশে দাম কমানো হচ্ছে না। এর কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশে জ্বালানি তেল মজুদ এর জায়গার ঘাটতি রয়েছে, ইতিমধ্যে দেশে ধারণ ক্ষমতা তুলনায় অনেক তেল মজুদ রয়েছে, কারখানা ও পরিবহন বন্ধ থাকার চাহিদা কমে গেছে তেলের। এ অবস্থায় নতুন করে কম দামের তেল কিনে রেট কমানো সম্ভব নয়। আবার ভবিষ্যতে কমানোর কোনো পদক্ষেপ বা ইচ্ছাও দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থাউ প্রাকৃতিক গ্যাসের সাপ্লাই কমে যাওয়ায় এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও চিন্তা করা যাচ্ছে না।
আমাদের দেশের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনাম দুই দেশেই আমাদের তুলনায় ডিজেলের দাম কম।বাংলাদেশে,চীন ও ভিয়েতনামে ডিজেলের দামঃ-
বাংলাদেশ-৬৫ টাকা/লিটার
চীন-৬০ টাকা/লিটার(প্রায়)
ভিয়েতনাম-৫৩টাকা/লিটার(প্রায়)
পার্শ্ববর্তী ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় তেলের দাম বেশি হলেও সরকার থেকে বাংলাদেশের তুলনায় সকল শীল্পখাত ও পরিবহন খাতে প্রচুর ভর্তুকি দেয়া হয়, পাকিস্তানেও করোনা দূর্যোগে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি প্রায় ১৫ টাকা কমানো হয়েছে। এ অবস্থায় তেল-গ্যাসের দামের এই ঊর্ধ্বগতিতে ও সাপ্লাই এর সীমাবদ্ধতায় গার্মেন্টস গুলোকে লোকশান গুনতে হচ্ছে। যাত্রাকালের পর সর্বপ্রথম গত বছর ২০১৯ সালে দেশের গার্মেন্টস খাতে প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক ছিলো, যা এই শীল্পর টিকে থাকা নিয়ে আশংকাজনক।
আবার দেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, জার্মানি, পাকিস্তান….ইত্যাদি দেশের প্রকৌশলী, টেকনোলোজিস্ট, ডিজাইনার…দের পারিশ্রমিক বাবদ প্রতি বছর ২০বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। সে জায়গায় বাংলাদেশি প্রশিক্ষিত জনবল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করলে অনেকাংশে ব্যয় কম হয় এবং দেশের অর্থ দেশেই থাকবে। কিন্তু সে উন্নত প্রশিক্ষণ ব্যাবস্থাও ইন্ডাস্ট্রির যাত্রাকালের প্রায় ৪০ বছর পরেও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অনেকাংশে নিশ্চিত হলেও বিদেশি জিনিসের চাহিদা বেশি নীতির কারণে বাংলাদেশিরা দেশের ইন্ডাস্ট্রিতেই অনেকক্ষেত্রে অবহেলিত!
এছাড়া আরেকটি জিনিস হলো দেশের গার্মেন্টস গুলো একটি আরেকটির সাথে বেশি অর্ডার লাভের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থেকে পণ্যের দাম কমিয়ে আনছে প্রতিবছর, যার প্রভাবে অর্ডার প্রতি লাভের পরিমাণ ও কম হচ্ছে।
আর এই শ্রমিক মজুরি,জ্বালানি সমস্যা থেকে উত্তরণ, গার্মেন্টস গুলোর এই ধরণের প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন সমিতি বিজিএমইএ, বিকেএইএ,…..ইত্যাদির পর্যাপ্ত ভূমিকার অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের সাথেও সমিতিগুলোর কোনো ইফেক্টিভ আলোচনা বা চাপ প্রয়োগ কখনোই দেখা যায়নি।
বর্তমান করোনা মহামারীর কারণে লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্টস খোলা-বন্ধ থাকা নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো তা এই সমিতি গুলোর ভঙ্গুর চেইন অব কমান্ডের ই প্রতিচ্ছবি। এমনকি বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি ও সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে এসেছে গণপরিবহনে ভাড়াবৃদ্ধির পর থেকে। জ্বালানি সংকটে এর সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পর ও টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্বশীল কারো কাছ থেকে এসব দাবি বা প্রস্তাবনা আসে নি।
এখন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে ভবিষ্যতে দীর্ঘসময় বাংলাদেশে এই ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্পমূল্যের বেসিক ট্রেডিশনাল গার্মেন্টস আইটেম প্রোডাকশনের পাশাপাশি নতুন বৈচিত্রময় গার্মেন্টস আইটেম, মেডিকেল টেক্সটাইল, স্পোর্টস টেক্সটাইল, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল..ইত্যাদি প্রোডাকশনের দিকে ঝুকতে হবে এবং এর জন্য যেহেতু দেশে পর্যাপ্ত উন্নত মানের প্রযুক্তি তৈরি হয়না, তাই আমদানি করে সেসব প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতের জন্য প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী, ডিজাইনার, আর এন্ড ডি সেক্টর ও দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে হবে। বিদেশী প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ দের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি গুলোর শক্ত চেইন অব কমান্ড বিশিষ্ট সমিতি ও কমিউনিটি গড়তে হবে,যারা ইন্ডাস্ট্রির যাবতীয় সমস্যা ও সমাধান এর জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা গঠন ও বাস্তবায়ন করতে পারে,এবং সরকারের নিকট প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা তুলে ধরতে পারে।পোশাক শ্রমিকদের সমিতি ও সংগঠন গুলোর নীতি নির্ধারকদের ও দেশের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির সার্বিক অবস্থা ও চাহিদা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। কারণ ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের চেয়ে শ্রমিকদের ইউনিটি সব সময় ই বেশি। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংগঠন গুলোর নীতি নির্ধারকদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকলে তারা ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে বেশি ইফেক্টিভ ভূমিকা রাখতে পারবে।
Writer information :
Abdullah Mehedi Dipto
Campus ambassador (TES),
Primeasia University, Batch-181