ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার৷ মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা৷ রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যতটুকু কাজ করা সম্ভব তার সর্বোচ্চটাই করে যাওয়া প্রিয় মানুষটি৷
দেশে যখন কিট সংকট তখন তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালনায় একদল গবেষক আবিষ্কার করলেন জিআর কোভিড ১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিট ৷ যা বহু নাটকিয়তায় এখনও পরীক্ষাধীন অনুমোদনের অপেক্ষায় ৷
সেই কিটেই পরীক্ষা করে জানতে পারলেন তিনি করোনা আক্রান্ত ৷ খবরটা শুনে বুকের ভেতর দাগ কাটে ৷
তারপর চেষ্টা করলাম মহান মানুষটি সম্পর্কে জানার এবং লেখার —
কোন ক্ষমতায় না থেকে পুরো দেশের স্বাস্থ্যখাতের সকল মাথা ব্যাথ্যা তিনি একাই বোধয় বহন করেন ৷ মাথা ব্যাথ্যা বলেই তো বাংলাদেশে সৃষ্টির থেকে এখন পর্যন্ত লড়ে যাচ্ছেন দুটি অকেজো কিডনি নিয়ে সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করে।
আজ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে ফিল্ড হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ছন, বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। হাসপাতালটি গড়ে তোলার অন্যতম উদ্যোক্তার নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র কার্ডিয়াক সার্জন ডা. এম এ মবিন। ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্র ইউনিয়নের মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন। ১৯৬৪ সালে ডিএমসি থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিডিএমএ)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি।
যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে নিজের দেশের পরিচয় পাকিস্তান মোছার লক্ষ্যে লন্ডনের হাইড পার্কে পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তারপর বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা।
যুদ্ধের পরও ডা. জাফরুল্লাহ -১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিল্ড হাসপাতালটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়ার সময়, নাম নিয়ে আপত্তি করল প্রশাসন থেকে। পরে ডা. জাফরুল্লাহ প্রস্তাবিত তিনটি নামের একটি “গনস্বাস্থ্য কেন্দ্র” রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পছন্দে রাখা হয় ৷বঙ্গবন্ধু শুধু নাম রাখেননি সাথে ২৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিলেন।জোহরা বেগম, পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব এম এ রব ও ডা. লুৎফর রহমানও সাভারে তাদের পারিবারিক সম্পত্তি থেকে পাঁচ একর জায়গা দিয়েছিলেন হাসপাতালের জন্যে।সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ পরিবর্তিত ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে যাত্রা শুরু করে।সেই থেকে সত্যিকার সেবার মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ৷
১৯৮১ সালে গড়ে তোলেন অত্যাধুনিক ‘গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল’। অন্য সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওষুধের চেয়ে গণস্বাস্থ্য উৎপাদিত ওষুধের দাম প্রায় অর্ধেক।রাজধানীর মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশনে নিজে ডায়ালাইসিস করার সময় অন্য রোগীদের কাছ থেকে অসহায়ত্বের কথা জেনে চালু করেন ২০১৭ সালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার ৷এটাই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। খরচ অবিশ্বাস্য রকমের কম। হতদরিদ্ররা বিনা মূল্যে ডায়ালাইসিস করার সুযোগ পায় ৷
গণস্বাস্থ্যের পর তার বড় অবদান হচ্ছে ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতিতে ৷ স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে।স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে কম দামে ওষুধ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনায়ও নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ৷দেশীয় ওষুধ শিল্প ও নীতির বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকেও। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ওষুধ নীতি নিয়ে কাজ করুক।কিন্তু জিয়াউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী শফিউল আযমদের সঙ্গে নেওয়ায়, চার পৃষ্ঠার চিঠি লিখে মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান ডা. জাফরুল্লাহ। পরবর্তীতে এরশাদকে বুঝিয়ে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন ১৯৮২ সালে। পোশাক শিল্পের পর যে ওষধ শিল্প এখন এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ৷আর সেই শিল্পে অবদান রাখা মানুষটি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ ৷
নারী ক্ষমতায়নে আগ্রণি ভূমিকা রেখেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মাধ্যমে ৷ইলেকট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার, ওয়েল্ডার হিসেবে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারী ড্রাইভাররা বড় বড় জিপ চালাতে শুরু করেন ১৯৮২ সাল থেকে। যুদ্ধের সময়ও বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালেপ্যারামেডিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলেন একদল সেবাদানকারী। মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামালও তাদের একজন ৷
সাম্প্রতিক সময়ে মহান মানুষটি করোনা আক্রান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজে কেবিন বুকড করলেও বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং বলেন -আমি তো ডাক্তার। করোনা রোগ নিয়েও কাজ করছি। আমি জানি, করোনা রোগীর কোন সময় হাসপাতালে যেতে হবে আর কোন সময় বাসায় থাকতে হবে। করোনা শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যেতে হবে— এটি একেবারেই ঠিক নয়।
আমি যদি হাসপাতালে গিয়ে কেবিনে উঠি তাহলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যাবে যে, শনাক্ত হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যেতে হয়। করোনা রোগীদের জন্যে আমি ভুল বার্তা দিতে চাই না। ফলে, আমার জন্যে ঢামেকে কেবিন বুকিং দিয়ে রাখা সত্ত্বেও আমি হাসপাতালে না গিয়ে বাসায় আছি। এটাই করোনা রোগের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
সবার ক্ষেত্রে এটাই করা উচিত। এমনিতেই হাসপাতালে জায়গা নেই। যাদের দরকার নেই তারাও যদি হাসপাতালে চলে যাই, তাহলে তো সংকট আরও বাড়বে।
সেই কথোকপথনে তিনি আরও জানান ১৮ বছর আগে যখন উনার চোখের অপারেশন করা দরকার হয়েছিল৷ তখন তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য হবার সুবাধে চাইলেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশের উন্নত হাসপাতালটিতেও বিনা পয়সায় চোখের অপারেশন করাতে পারতেন৷ কিন্তু করিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে৷
১৯৪১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ও পৈত্রিক নিবাস। সেই পৈত্রিক জমিও বোনকে দান করে দিয়েছেন এই লোভহীন মানুষটি৷ তবু চাঁদাবাজি, জমিদখল, পুকুরের মাছ চুরির অভিযোগসহ একের পর এক মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
মহান এই মানুষটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন৷ এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রেমন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। এতসব পুরষ্কারের ভিড়ে মানুষটির বড় অর্জ
ন হয়ত কোটি মানুষের ভালোবাসা৷
লেখকঃ
আসাদুল্লাহ রাব্বুল
Port City Internation University (২য় বর্ষ)