জিন্স ও ডেনিম আমরা প্রত্যেকে প্রতিনিয়ত যেমন ব্যবহার করি ,তেমনি একজন টেক্সটাইল পড়ুয়া ছাত্র হিসেবে অনেকেই আমাদের প্রশ্ন করেই থাকে, “তোমার পরিধানকৃত প্যান্টটি ডেনিম নাকি জিন্স”।আর তখনই ঘটে বিপত্তি।অনেকের মতো আমি নিজেও এ বিষয়ের একজন ভুক্তভোগী।বিষয়টি আসলেই একটু ভাবনার কারণ বিশ্বের অনেকের মতো আমরাও জিন্স বলতেই ডেনিম কে বুঝি। তাই ক্লাসের কিছু শিক্ষার্থী স্যারদের প্রশ্ন করেই বসে,এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য কি?কিংবা আসলেই কি জিন্স বলতে ডেনিমকে বোঝায়!
যাইহোক,মূলত দুটি শব্দ ডেনিম এবং জিন্স দুটোই ভিন্ন জিনিস কিন্তু তারা একে অপরের সাথে জড়িত।
ডেনিম জিন্সের ইতিহাসঃ বর্তমানে ফ্যাশন গার্মেন্টেসের যুগে ডেনিম বা জিন্স বিশাল এক জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।জিন্স,বুড়ো থেকে শুরু করে তরুণ সমাজর কাছে এক অন্যরকম পছন্দের পরিধান।কিন্তু এই ডেনিম/জিন্সের জন্ম কিন্তু সে উদ্দেশ্যেও হয়নি।
ইতালিতে বিশেষ একপ্রকার শক্তিশালী ফেব্রিক উৎপাদিত হতো যার নাম সার্জ।সে সময়ে ফ্রান্সের Nimes অঞ্চলের কিছু অধিবাসীরা ইতালিয়ান ওই ফেব্রিকের অনুকরণে ফেব্রিক তৈরি করতে গেলেই ডেনিম ফেব্রিক তৈরি হয়ে যায়। তারা এই ফেব্রিকের নাম দেয় ‘সার্জ ডি নিমস’ (Serge De Nimes), যার অর্থ নিমস শহরের সার্জ ফেব্রিক। এই নামের ইংরেজি অংশ ডি আর নিমস মিলে হয়ে যায় ‘ডেনিম’।
অন্যদিকে জিন্স নামের উৎপত্তি হয়েছে ইতালির সমুদ্র বন্দর জেনোয়ার নাবিকদের থেকে।সেসময় জেনোয়ারের নাবিকদের বলা হতো জিন “Genes” বা দৈত্য।পরের সময়ে এই জিনের এর বহুবাচক শব্দ হিসেবে নাম হয়ে গেছে জিন্স।আবার অনেকের গবেষণা এটাও বলে যে, ফ্রান্সের ডেনিম ফেব্রিকের গঠনকে বলা হয় “জিন ফুস্টিয়া”।
গোল্ড রাশ বা সোনার খনন এর সুসময় শুরু হয় ১৮৪৮ সালের প্রথম দিকে এবং প্রায় ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত এটি টিকে ছিলো।ক্যালিফোর্নিয়ার কোলোমা অঞ্চলে,সাক্রামেন্টো উপত্যকায় সোনার খনি আবিষ্কৃত হয়।আর ধারণা করা হয় আধুনিক জিন্স বা ডেনিমের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ এর এর মাঝামাঝি সময় থেকেই।সোনার খনি আবিষ্কারের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে গেলে সেসময় আমেরিকা থেকে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ সেখানে পাড়ি জমায়।বাভারিয়ার অধিবাসী লেভি স্ট্রস যিনি ১৯৪৮ সালে জার্মানি থেকে নিউ ইয়ার্কে পাড়ি জমান।সেখানে সে তার ভাইয়ের সাথে পোশাক, লিনেন কাপড়, শার্টের লাইনিং কাপড়, বোতাম ইত্যাদির ব্যবসা শুরু করেন।এই ব্যবসা বেশিদিন সুবিধার হয়নি,বরং ভুমিকম্পে ও অগ্নিকান্ডে ভেঙে পড়ে তাদের ব্যবসার দোকান ঘর।আর এই দুর্ঘটনাই হয়তো লেভি স্ট্রসের জীবনে আশীর্বাদ ডেকে আনে।কেননা ইতিহাস থেকে জানা যায় দূর্ঘটনার পর দুখী লেভি স্ট্রসের চোখে পড়ে যে, সেখানে সোনার খনি শ্রমিকরা যে প্যান্ট পরত তা খুব বেশিদিন টিকত না।পরনের প্যান্টগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ছিড়ে যেত।তাই তিনি তার গুদামে থাকা ব্যবসার উদ্দেশ্যে আনা শক্ত বাদামী বর্ণের কাপড় বের করে সেটি দিয়ে একটি শক্ত প্যান্ট তৈরি করলেন।আর এই কাজে তার সাথে ছিলো জ্যাকব ডেভিস যিনি পেশায় ছিলেন একজন দর্জি।পরে সেই ডেনিম কাপড়ে নীল রঙ দিয়ে ডাই করেছিলেন লেভি এবং ওই নীলরঙা কাপড় থেকেই তৈরি হচ্ছিল শ্রমিকদের শক্তিশালী প্যান্ট।ব্লু জিন্সের উৎপত্তি মূলত সেখান থেকেই।এই গল্প শতভাগ সত্যতা পায়নি ,তবে মোটামোটি এটাই ধারনা করেন অনেক গবেষকরা।আর তখনকার সেই জিন্স ,ডেনিম এখন আধুনিক হয়ে এখন জ্যাকেট, স্যুট কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে।তবে এই ইতিহাসে মজার বিষয়ও আছে।আমরা এখন যে জিন্সের প্যান্ট পরে থাকি সেকালের অভিজাত শ্রেণিরা এই পোশাক পরত না।এই ডেনিম ,জিন্স পোশাকগুলোকে একসময় মনে করা হতো শ্রমিক শ্রেণির পোশাক,যারা সারাদিন পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করত।এর একটা ছোট প্রমানও রয়েছে।প্রখ্যাত গায়ক বিং ক্রসবিক তিনিও লেভি স্ট্রস এর তৈরী করা জিন্স (বর্তমানে লেভি’স জিন্স) প্রায়ই পরতেন।একবার তিনি কানাডায় শিকার করতে গেলেন জিন্স পরে।আর সেখানেই তার সাথে ঘটে এক বিপত্তি। তিনি যখন একটি হোটেলে রুম নিতে যাবেন,ঠিক তখনই তাকে শ্রমিক মনে করে হোটেল ম্যানেজার কোন রুম দিলেন না।যদিও পরে তার পরিচয় পেয়ে হোটেলের লোকজন রুম দিয়েছিলো এবং দুঃখ প্রকাশ করেছিল।
ডেনিম কি?
ডেনিম জিন্স তৈরি করতে ব্যবহৃত ফ্যাব্রিকের নাম।সচরাচর আমরা যে শার্ট-প্যান্ট পরে থাকি,ডেনিমের গঠন এসব থেকে কিছুটা আলাদা।এর গঠনকে বলা হয় টুইল বুনন (Twill Weave)। এই ধরনের বুননের ফলে ফেব্রিকে কোনাকুনি লাইনের মতো দেখা যায়।এই ফেব্রিক তৈরি করা হয় শতভাগ কটন/হেম্প থেকে,তাই ব্যবহারে খুব আরামদায়ক।পরবর্তীতে সেটা চলে আসে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে এবং ওই ফেব্রিক থেকে তৈরি করা হয় শার্ট, প্যান্ট, জ্যাকেট, স্যুট, ব্যাগ ইত্যাদি।ফেব্রিক বুননে সাধারণত দু ধরনের সুতা ব্যবহার করা হয়।আর এটা আমাদের সবারই জানা।কাপড়ের দৈর্ঘ্য বরাবর সুতাকে বলা হয় ওয়ার্প সুতা এবং আড়াআড়ির সুতাকে বলা হয় ওয়েফট সুতা।ওয়েফট সুতা ওয়ার্প সুতার উপর নিচ দিয়ে প্রবেশ করানোর কারণেই কাপড় তৈরি হয়।সাধারণ ফেব্রিকের ক্ষেত্রে একটা বাদে একটা ওয়ার্প সুতার উপর দিয়ে বা নিচ দিয়ে প্রথম ওয়েফট সুতা প্রবেশ করানো হয়।পরবর্তী ওয়েফট সুতা প্রবেশ করানো হয় সেটার বিপরীতভাবে।অপরদিকে ডেনিম ফেব্রিকে ওয়েফ্ট সুতা দুই বা ততোধিক ওয়ার্প সুতার নিচে দিয়ে যায়।ডেনিমের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ওয়ার্প সুতাই রঙিন হয়,ওয়েফট সুতা সাদাই থাকে।এ কারণেই ডেনিমের সামনের অংশ রঙিন হলেও পেছনের অংশ সাদা থাকে।তাই ডেনিম এর সারফেসে একটি কালারই প্রাধান্য পায়।ডেনিম তৈরিতে ইন্ডিগো সূতার ব্যবহার করা হয়।
জিন্স কি?
জিন্স এক ধরণের জনপ্রিয় পোশাক।পরিধানে আরাম হওয়ায় এটা খুব জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত।জিন্স তৈরিতে ডেনিম ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়।স্পষ্টভাবে বলতে হলে,জিন্স বলতে সাধারণত ইনফরমাল প্যান্ট/ট্রাউজার কে বোঝায় যা ডেনিম ফেব্রিকের তৈরি।তাই এটা বলাই যায় যে, সকল জিন্সই ডেনিম, কিন্তু সকল ডেনিম জিন্স নয়।কারণ ডেনিম ফেব্রিক দিয়ে শুধু প্যান্টই না আরো অনেক কিছু তৈরি করা হয়।পূর্বের শ্রমিক শ্রেণির ব্যবহ্রত এই জিন্স বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয় একটি ফ্যাশনের অংশ।নীল রং এর জিন্স, জিন্স এর একটি স্বঃতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কালারের জিন্স পাওয়া যায়।
ডেনিম ফেব্রিকের কিছু বৈশিষ্ট্য :
১) এই ফেব্রিকে সহজে ক্রিজ পরেনা।
২)এটি খুব শাক্তিশালী ও স্থায়ী।তাই পরিধানের সময় শক্ত সুরক্ষা দেয়।
৩)ডেনিম ডাইং এ ভ্যাট ও সালফার ডাই ব্যবহার করা হলে পরিধানে গরম লাগবে না।প্রধানত আট প্রকার ডেনিম ফেব্রিক পাওয়া যায়।যেমন:কালারড ডেনিম,বাবল গাম ডেনিম ,মার্বেল ডেনিম,রিভার্স ডেনিম ইত্যাদি।
জিন্স কেনো পরিধানে উপকারি :
প্রথমতই আয়রনের কোনো ঝামেলা নেই,আয়রন ছাড়াই অনায়েসে জিন্স পরা যায়।ওয়াসিং এর ঝামেলাও কম।দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়।
তথ্যসূত্র: history of jeans, racked, txehouse, textilebangla, bunon,YouTube,textilelab
Writer’s Information :
Bipro Brota Roy
Ahsanullah University of Science and Technology
Department of Textile Engineering
(Batch-40)