১৮০০ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে হঠাৎ একধরণের কাপড়ের বুনন নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হলো। এতো স্বচ্ছ, এতো হালকা, এতো পাতলা এবং এতো নমনীয় কাপড়ের বুনন আগে কেউ দেখেনি। এর নাম ‘ঢাকাই মসলিন’, যার উৎপত্তি ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশ তথা বর্তমান বাংলাদেশ। এ এমন এক কাপড় ছিল যা একধরণের বিরল প্রজাতির তুলা থেকে উৎপাদন করা যেত যা শুধুমাত্র মেঘনা নদীর তীরেই পাওয়া যেত। মসলিন কাপড় বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রচলিত আছে এতো সুক্ষ বুনন ছিল এই কাপড়ের যে ১০০ গজের একটি কাপড় নাকি একটি আংটির ভিতর দিয়ে চলে যেতে পারত এবং একটি আস্ত শাড়ি নাকি একটি দিয়াশলাইয়ের বক্সে আঁটানো যেত। পশ্চিমা মানুষের মাঝে প্রচলিত ছিল যে সম্ভবত পানির নীচে কোনও জলপরী, কিংবা কোনও দৈত্যের হাতে এই কাপড় তৈরি হয়েছে কেননা এতো চমৎকার কাজ কোনও মানুষের হাতের কাজ হতে পারে না।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলাদেশে আসার আগে এই মসলিন সারাবিশ্বে পাওয়া যেত। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যে ভারতবর্ষ থেকে মসলিন কাপড় যেত বলে জানা যায়। এমনকি প্রায় ২ হাজার বছর আগে মিসরীয় সভ্যতার একটি বইয়ে ‘ভারতীয় মসলিন’-এর উল্লেখ রয়েছে। ১৮ শতকেও এটিই ছিল সেসময়কার সবথেকে দামী কাপড় যা শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষেরই সামর্থ্য ছিল কেনার। তবে ১৯ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে শুধুমাত্র কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং যাদুঘর ছাড়া আর কোথাওই এর দেখা পাওয়া যেত না। কেননা মসলিন বোনার সুতা যেই ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার গাছ থেকে তৈরি হয় তা একদম বিলুপ্ত হয়ে যায়। তা কিভাবে এই হয়েছিল এই সর্বনাশ? তাহলে সম্প্রতি যে মসলিন কাপড় ফিরে আসার কথা শোনা যাচ্ছে কিভাবে তারা এই অসাধ্য সাধন করলেন?
১৮শ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে এই পুরো শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। এরপর আরও বেশী পরিমাণে এবং আরও কম মূল্যে এই কাপড় তৈরি করার জন্য তাঁতিদেরকে জোর করতে থাকে। কিন্তু মসলিন তৈরি করা একটি খুবই সূক্ষ্ম ও নিপুণ প্রক্রিয়া যা বেশ সময়সাপেক্ষ ছিল। যে কারণে এটি চড়া মূল্যে বিক্রি হতো। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এধরণের কর্মকাণ্ডের ফলে তাঁতিরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং যেই ঋণ শোধ করা হয়ে পড়ে অসম্ভব। অন্যদিকে মসলিন তৈরির পুরো প্রক্রিয়া অনুকরণ করে লন্ডনের কাছেই তারা এই ধরণের কাপড় তৈরি করার চেষ্টা করে। যদিও সেই কাপড় ঢাকাই মসলিনের ধারেকাছেও ছিল না কিন্তু অত্যন্ত কম মূল্যে এই কাপড় বিক্রি হওয়ায় ঢাকাই মসলিনের চাহিদা আস্তে আস্তে কমে আসে। বাধ্য হয়ে তাঁতিরা অন্যান্য স্বল্পমূল্যের কাপড় তৈরি শুরু করে অথবা চাষবাস শুরু করে এবং আস্তে আস্তে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মসলিন প্রায় চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। এও প্রচলিত আছে যে, মসলিন শিল্পীদের আঙুল কেটে দেওয়ার পরে ঢাকাই মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।
যদিও ভারতে এখনও মসলিন বানানো হয় তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকাই মসলিনের আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। ঢাকাই মসলিনের শেষ প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে ১৮৫০ সালে। এর ১৭০ বছর পরে বাংলাদেশে আবার বোনা হলো সেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন কাপড়ের শাড়ি। ঠিক সে রকমই, যেমনটি বলা হতো—আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় আস্ত একটি শাড়ি। ইতিমধ্যেই ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদন পাওয়া গেছে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশের একদল গবেষক দীর্ঘ ছয় বছর গবেষণা করে সক্ষম হয়েছেন ঢাকাই মসলিন তৈরিতে। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষকরা ছয়টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন। যার একটি ইতোমধ্যে প্রধামন্ত্রীকে উপহার দিয়েছেন তারা।
পুরো গবেষণা প্রক্রিয়ায় রাবি, ঢাবিসহ ৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৮জন গবেষক কাজ করেছেন। সম্পূর্ণ কাজকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একভাগে ছিল মসলিন তৈরির অপরিহার্য উপকরণ কার্পাস তুলা খুঁজে বের করা। অন্য অংশে ছিল তুলা থেকে সুতা বানানো ও মসলিন কাপড় তৈরি। মসলিন শাড়ির নমুন দেখতে একটি দল যুক্তরাজ্যের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যায়। সেখান থেকে মসলিনের ডিএনএ বের করে সিকোয়েন্স করা হয়। পরে কার্পাস তুলার জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। দেশের নয়টি জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে কাপাসিয়ার একটি কার্পাস তুলার সঙ্গে মসলিনের সংগৃহীত ডিএনএর মিল পাওয়া যায়। পরে গুটি কার্পাস তুলার ওই জাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মাঠে লাগানো হয়। তুলা সংগ্রহই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তুলা খুঁজে, চাষ করে, তাঁতী বাছাই করে দীর্ঘ ছয় বছর পরিশ্রমের পর অবশেষে পাওয়া যায় কাঙ্ক্ষিত ফল।
বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকাইয়া মসলিন বিলিয়ন ডলারের ওয়ার্ল্ড ব্র্যান্ড। দেশবিদেশ থেকে অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে গবেষকদের কাছ থেকে জানা যায়। ফিরে আসা মসলিন বাংলার হারানো ঐতিহ্য কিছুটা হলে ফিরিয়ে আনবে এবং দেশিয় পোশাকশিল্পে এক নববিপ্লবের সূচনা করবে এই আমাদের কাম্য।
লেখকঃ
মোঃ খালেদ হাসান মোরশেদুল বারী
মোঃ রাহাতুল ইসলাম
সাবের রুহুল ইসলাম