Thursday, November 21, 2024
Magazine
More
    HomeGarments & Apparelঢাকাই মসলিন ফিরছে স্ব-মহিমায়

    ঢাকাই মসলিন ফিরছে স্ব-মহিমায়

    মসলিনের অনেক রকম কিংবদন্তি শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। মসলিন শাড়ি এত সূক্ষ্ম যে দেশলাইয়ের বাক্সে এঁটে যায়, আংটির ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে। আর শুনেছি, ব্রিটিশরা মসলিন কারিগরদের আঙুল কেটে দিয়েছিল, তাই এটা হারিয়ে গেছে, এখন আর নেই।

    ♦ মসলিনের উৎস

    বাংলা মসলিন শব্দটি আরবি-ফারসি কিংবা সংস্কৃতমূল নয়। এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ কর্তৃক প্রকাশিত অভিধান ‘হবসন জবসন’-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে ‘মসুল’ থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হল মসুল। এই মসুলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হত। এই ‘মসুল’ এবং ‘সূক্ষ কাপড়’ -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় ‘মসলিন’।অবশ্য বাংলার ইতিহাসে ‘মসলিন’ বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম এক প্রকার কাপড়কে যা বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সূতা দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়বিশেষ। এটি ঢাকাই মসলিন নামেও সুবিদিত। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত। চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হত যার ফলে মসলিন হত কাচের মত স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হত।

    ♦ কিভাবে হারিয়ে গেল সোনালি মসলিন?

    একটি শিল্প গড়ে উঠা, টিকে থাকা কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করে অনেক ভৌগলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক নিয়ামক। বাংলায় গড়ে উঠা মসলিন শিল্পও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলার মসলিনের খ্যাতি ছিল ভারত ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে। এর সমাদর ছিল ফ্রান্স, ব্রিটেন সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মোগল শাসক, দেশীয় রাজা কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তি, খ্যাতি আর অর্থবিত্ত সম্পন্ন লোকেদের গায়েই দেখা যেত মসলিনে নির্মিত পোশাক আর পাগড়ির ঝলকানি।

    উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের কাপড়ের বাজারে মসলিনের চাহিদা ছিল না বললেই চলে। তাই তাঁতিদের হাত থেকে মসলিন চলে যেত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাতে, সেখান কয়েক হাত বদলে থেকে চড়া দামে মসলিন কিনতেন উঁচুতলার মানুষেরা।

    তাছাড়া দীর্ঘ দিনে ধরে ইংরেজরা বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে, সেখান থেকে নিজেদের কুঠির লোকজন দিয়েই মসলিন সংগ্রহ করা শুরু করে, পরবর্তীতে সেখান থেকেই বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। দেশীয় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সাথে বিদেশীরাও যুক্ত হয়, ধীরে ধীরে তারা দেশীয় এবং বিদেশী প্রতিযোগীদের হারিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তাই ইউরোপের বাজারে প্রশংসিত হওয়ার সাথে সাথে যখন মসলিনের চাহিদা বাড়ে তখন থেকেই দেশীয় বাজার থেকে মসলিন সংগ্রহের ব্যাপারে ইংরেজরা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করে। কিন্তু সেই জায়গাটিও বদলে যেতে শুরু করে ম্যানচেস্টারের কাপড়ের কল আসার পর।

    ♥♥ ফিরে এসেছে মসলিন ♥♥

    ৩০০ বছর পর বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ‘মসলিন’ কাপড় আবারো ফিরে আসছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম।

    সোনালি ঐতিহ্যের সেই মসলিন আবার ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মসলিন তৈরির প্রযুক্তি উদ্ঘাটিত হয়েছে জানিয়ে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম সোমবার নিজ দফতরে সাংবাদিকদেরকে জানান ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বখ্যাত ‘মসলিন’ কাপড় তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার হয়েছে। শিগগির এ কাপড় আবার উৎপাদন শুরু হবে।প্রথম মানসম্মত তৈরি মসলিনের শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিকে সুখবর দেয়া হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আবারও মসলিনের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে।’

    জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সোনালি ঐতিহ্যের মসলিন তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পরে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় “বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার। “(প্রথম পর্যায়)

    মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় বুননের বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে দেয়া হয়।

    দলের সদস্যরা হলেন : রাবির অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আলম, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন আলীমুজ্জামান, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের একজন ও তাঁত বোর্ডের দু’জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে আরও তিনজন সদস্য এ বিশেষজ্ঞ দলে কাজ করছেন।

    সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সভাকক্ষে বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান গবেষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মনজুর হোসেন, তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আস্রাফ আলীসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

    সভায় জানানো হয়, ইতিমধ্যে মসলিনের ৪টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মসলিন তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন তা উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
    যে সুতা থেকে মসলিন তৈরি হতো, সেই ফুটি কার্পাস তুলাগাছ চাষ হচ্ছে দেশেই। শিগগির ওই গাছের তুলা থেকে মসলিন কাপড়ের শাড়ি বা স্কার্ফ তৈরি করা হবে। ওই শাড়ি বা স্কার্ফ প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সুখবর জাতিকে জানাবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

    লেখক:

    তানভীর শিকদার সিয়াম,
    ডিপার্টমেন্ট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং,
    জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (১০ ব্যাচ)

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Related News

    - Advertisment -

    Most Viewed