“ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো,
খাট নাই,পালঙ্ক নাই আসন পেতে বসো”
ছোটবেলায় আমাদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মায়েরা কত উপায়ই না অবলম্বন করত। সেটা ছড়া, গান হোক কিংবা আরামদায়ক বিছানা। মানবজীবনের প্রারম্বিক থেকে সমাপন পর্যন্ত রয়েছে টেক্সটাইলের বিস্তৃতি।
মানুষ মাত্রই আরামপ্রিয়। তবে বাঙালি হিসেবে আরামপ্রিয়ের সাথে রয়েছে আমাদের আলসেমির দূর্নাম।সেই আরামের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে তোশকের জুড়ি মেলা ভার। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা পেরিয়ে শান্তির জায়গা হচ্ছে বিছানা।সকাল বা রাতে অথবা ছুটির দিনে বিছানা যেন একটুকরো স্বর্গ। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে একটি চমৎকার ঘুমের বিকল্প নেই।ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে এসে যদি দেখি শুধু মাটির উপর কিংবা তক্তপোষের উপর বিছানা, তবে অনুভূতিটা নিশ্চয় সুখকর হবেনা? আরামহীন বিছানায় ভালঘুম কল্পনায় থেকে যাবে।তাই ভাল ঘুমের জন্য তোশক বা বিছানার বিকল্প নেই।
তোশক বা মেট্রেসঃ
তোশক হলো একপ্রকার প্যাড যা শায়িত দেহের ভার বহন করে এবং বিছানায় আরামদায়ক অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তোশক বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমনঃগদি,জাজিম,খাটের গাদি,কুশন ইত্যাদি।
তোশক শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে এসেছে।আর ম্যাট্রেস (mattress) শব্দটি আরবি “মেট্রাহ” থেকে এসেছে মতান্তরে রোমান ভাষার “মাতেরেস” থেকে এসেছে।যার অর্থ যেখানে কিছু নিক্ষিপ্ত রয়েছে।
তোশকে ব্যবহৃত উপাদানঃ
মোটা নরম কাপড়, চুল,তুলা,পালক,ফোম বা ফেনা,কাঠামো ভিত্তিক লোহার স্প্রিং, রাবার ইত্যাদি।
তোশকের পরিবর্তনশীল উপাদানঃ
মানুষের আরাম কিংবা একটুখানি প্রশান্তির চাহিদা সবসময়। প্রাচীনকালে মানুষ তোশক হিসাবে ব্যবহার করত খড়। খড় বিছিয়ে মোটা স্তর তৈরি করে তার উপর কাঁথা বিছিয়ে ঘুমাত। প্রাথমিক ভাবে তোশক হিসেবে ব্যবহৃত হত খড়,পালক। তারপর ধাপে ধাপে ঘোড়ার চুল,তুলা বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান। বর্তমানে তোশকে বায়ু,পানি,রাবার,আশঁ,পাট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।শিমুলতুলা দিয়ে তৈরি তোশক আরামদায়ক টেকসই এবং উন্নতগুণসম্পন্ন।
যুগে যুগে তোশকঃ
সর্বপ্রাচীন তোশকটি ব্যবহৃত হয়েছিল ৭৭০০০বছর পূর্বে।ক্রুসেডের সময় ইউরোপিয়ানরা আরবদের মেঝেতে জাজিম এবং কুশন দিয়ে শোয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করত । বিশ শতকের প্রথমার্ধে উত্তর আমেরিকা কর্তৃক বিক্রিত তোশকের মজ্জার সাথে তুলার ব্যাটিং বা আশঁ ভর্তি থাকত।
আধুনিক তোশক গুলোতে সাধারণত অন্তঃস্প্রিং লাটেক্স ভিসকোয়ালিটিক বা নরম পলিউরেথিন ফোম থাকে। অন্যান্য ভর্তি সামগ্রির মধ্যে কুন্ডলির উপর বসানো অন্তরক প্যাড থাকে যা বিছানার মজ্জার স্থান গুলোকে অন্তস্প্রিংয়ের সংস্পর্শে আসা থেকে রোধ করে।একই সাথে বিছানার মজ্জায় একটি পলিটরের আবরণ থাকে। ১৮৯৯ সালে জেমস মার্শাল সর্ব প্রথম মোড়ানো স্প্রিংয়ের কুন্ডলিযুক্ত তোশক বাজারজাত করেন। যা সাধারণ ভাবে মার্শাল কয়েলস নামে পরিচিত। তোশক পানি,বায়ু এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা ভর্তি করা হয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে কাপোক এবং দক্ষিণ এশিয়াতে কোইর হলো তোশক তৈরির সাধারণ উপাদান।
বর্তমানে উত্তর আমেরিকার বহুল বিক্রিত তোশক হচ্ছে স্প্রিংয়ের মজ্জাযুক্ত গদি,ফোমযুক্ত বিছানা এবং হাইব্রিড বিছানা।ইউরেোপ পলিইউরেথিন ফোমের মজ্জা এবং লাটেক্সের মজ্জা খুবই জনপ্রিয়।
তোষকের নির্মাণকৌশলঃ
প্রচলিত তোশকের দুটি স্তর,একটি কেন্দ্র বা সমর্তন স্তর এবং অপরটি আরামদায়ক স্তর বা শয়ন স্তর। দুটি স্তরকে মোটা বস্ত্র দিয়ে মোড়ানো হয়।একে বলা হয় ticking. শয়ন স্তরটি সমর্তন স্তরকে ঢেকে রাখে।
শয়ন স্তরটির তিনটি অংশ থাকে।
১.ইন্সুলেটর
২.মধ্যশয্যা
৩.কুইল্ট
তোশক সাধারণত তৈরি করা হয় বেড সাইজিং স্ট্যান্ডার্ডসের সাথে মিল রেখে।
বিভিন্ন প্রকার তোশকঃ
ফোমের ম্যাট্রেসঃ
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ এখন বিছানার তোশকের জন্য জাজিম,কুশনের বদলে ফোমের দিকে ঝুঁকছে।সচেতনতার ফলে এই তোশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফোম মেট্রেসের কাচামালের ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত।চীন,মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম,কোরিয়া থেকে ফোমের কাঁচামাল হিসেবে কাপড় এবং পলিস্টার ফাইবার আমদানি করা হয়।ফোমের মধ্যে লাটেক্স এবং মেমোরি ফোমের জনপ্রিয়তা বেশি।
লাটেক্স ফোমঃ
লাটেক্স মূলত রাবার গাছের আঠা।এটি অনেক আগে থেকে পণ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯২০সালে ডানলফ নামের একটি কোম্পানি রাবার আঠাকে ফোমে পরিণত করেছিল।কথিত আছে যে ই.এ মারফি নামের একজন বিজ্ঞানি তার স্ত্রীর কেক মিক্সার ব্যবহার করছিলেন এই ফোম তৈরিতে। এতে বাতাসের সাথে বুদবুদ যুক্ত হয়ে সুন্দর ফোম তৈরি করেন।প্রথম লাটেক্স গদিটি ১৯৩১সালে চালু করা হয়।
মেমোরি ফোমঃ
মেমোরি ফোম বা ভিস্কোলেস্টিক পলিইউরেথিন ফোম ১৯৭০ সালে নাসা কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়।তারা এই ফোমটি তৈরি করেছিল যাতে বিমান সংস্থাগুলো ভালো কুশনিং এবং ক্রাশ সুরক্ষা সরবরাহ করে। তাপ ও চাপে সংকোচন প্রসারণের কারণে এটি প্রথমে “স্লো স্প্রিং ব্যাক ফোম” নামে পরিচিত ছিল।১৯৯১ সালে এটি বাজারজাত করা হয়।যাদের পিঠে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা হয় তাদের প্রশান্তি দেয় এই মেমোরি ফোম।
পানি ভর্তি তোশকঃ
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি যে বাজারে পানি ভর্তি তোশক বা ওয়াটার বেড পাওয়া যায়।সুন্দর এই বেডটি প্রস্তুতকারক কোম্পানির নাম ওয়াটার বেড আউট কোং।আধুনিক জলের তোশকটি ১৯৪৮ সালে চার্লস হল তার সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ডিজাইন ক্লাসে মাস্টার্স থিসিস হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। এই তোশকের মেটেরিয়াল ৪০০কেজি পর্যন্ত ভারবহনে সক্ষম।
বায়ুর তোশকঃ
এই তোশকের নাম শুনে বিভ্রান্ত হবেন না।এতে অভ্যন্তরীণ কাঠামো বায়ু কুঠুরি দিয়ে তৈরি করা হয়।যা অনুভূতি পরিবর্তন করতে বিশেষ ভাবে ভূমিকা রাখে।এটি ১৯৯৬ সালে প্রথম বাজারজাত করেন মেকানিকাল এম এফ জি কোং।এটি সহজেই কাস্টমাইজ করা যায়। বর্তমানে ব্যবহৃত তোশকটি ১৯৮১ সালে বাজারজাত করা হয় এবং এই তোশকটিতে ম্যানুয়াল অংশগুলো স্বয়ংক্রিয় তে প্রতিস্থাপন করা হয়।
তুলার বালিশ-তোশকের যুগ পেরিয়ে এখন আধুনিক গদি বালিশের ছড়াছড়ি। নরম বালিশে মাথা ডুবিয়ে ঘুমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা।কিন্তু কিছু তোশক আরামের সাথে সাথে দেহের ক্ষতি করে।সিনথেটিক তোশকে অতিরিক্ত কেমিক্যাল থাকার কারণে এটি মাথাব্যথা,ঘাড়ব্যথা,মাইগ্রেন এবংসিনথেটিক তোশকে অতিরিক্ত কেমিক্যাল থাকার কারণে এটি মাথাব্যথা,ঘাড়ব্যথা,মাইগ্রেন এবং সাইনাসের সংক্রমণের মত ব্যথা সৃষ্টি করে।তাই তোশক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। ভালমানের এবং হালকা রংয়ের তোশক ব্যবহার করা উচিত।
প্রাত্যহিক জীবনের সাথে টেক্সটাইল ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। টেক্সটাইলের ব্যাপকতা ছাড়িয়ে গেছে জীবনের প্রতিটি সেক্টরে। তাই পোশাক হোক কিংবা তোশক হোক এটি হয়ে গেছে মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, কালের কন্ঠ,ইউটিউব,সমকাল।
Writer information
Afsana Akther Urme.
Team member-TES(DWMTEC )
Alia Yasmin.
Team member-TES(DWMTEC)