প্রাচীন লোকসংস্কৃতি, গ্রামীণ কুটির শিল্প, গল্প, গান কিংবা জসীম উদ্দীনের সেই অমর আখ্যানকাব্য “নকশী কাঁথার মাঠ” সর্বত্রই খুজে পাবেন নকশী কাঁথার গৌরবমন্ডিত ইতিহাসের কথা।
আচ্ছা কাঁথার সঙ্গে যোগসূত্র নেই এরোকম পরিবার তো দু-বাংলাতে পাওয়াই ভার আর কাঁথা যদি হয় সূচের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠা ভালোবাসা আর বেদনার কাহিনী সমৃদ্ধ নকশী কাঁথা তবে সেখানে প্রয়োজনের চাইতে নকশার বাহাদুরি ই বেশি থাকবে তা তো বলাই বাহুল্য। আর তাই তো বলতেই হয়,
“নকশী কাঁথার নকশা নিয়ে যদি জানতে চাও, কোথাও যাইয়ো না রাধে, মোর আর্টিকেলে তাকাও।”
কাঁথা না নকশী কাঁথা??
কাঁথা শব্দের অভিধানিক অর্থ ‘জীর্ণ বস্ত্রে প্রস্তুত শোয়ার সময়ে গায়ে দেয়ার মোটা শীতবস্ত্রবিশেষ’, কাঁথা শব্দের কোন উৎস স্পষ্ট ভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ ও প্রাকৃত শব্দ ‘কথ্থা’ থেকে ‘কাঁথা’ শব্দের উত্পত্তি। কাঁটা তারে বাংলা এফোঁড় ওফোঁড় হলেও দুই বাংলাতেই কাঁথার রয়েছে সমান কদর এবং বাংলাদেশের অঞ্চলভেদে কাঁথাকে খাতা, খেতা বা কেথা, কেতা নামে ডাকা হয়।
বেশিরভাগ নারীরাই এই শিল্পে দক্ষ।গ্রামাঞ্চলের নারীরা পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করে থাকেন,বলা হয়ে থাকে কাঁথা মিতব্যয়ীতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সাধারণত খানিকটা ছিড়ে যাওয়া, পুরাতন হয়ে যাওয়া শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি কিংবা চাদরকেই সাধারণত কাঁথা বানানোতে কাজে লাগানো হয়, তবে কাঁথা বানাতে শাড়ির আছে আলাদা কদর। প্রথমে পুরাতন কাপড়কে ধুয়ে, এতে মাড় দেওয়া হয় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখানে একাধিক পুরানো জিনিস একত্রিত করেও নতুন একটি কাঁথা তৈরি করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁথার পুরুত্ব কম বা বেশি হয়। পুরুত্ব অনুসারে তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরে স্তরে সাজিয়ে নিয়ে স্তরগুলোকে সেলাইয়ের মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়। আজকাল পুরাতন সামগ্রীর বদলে সূতির কাপড় ব্যবহার করা হয়।
নকশী কাথাঁর নকশাঃ
নকশী কাথাঁয় নকশা করার পূর্বে খসড়ার জন্যে কোন কিছু দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়। তারপর সুঁই-সুতা এবং বুননের মধ্য দিয়ে ওই আঁকা বরাবর সেলাই করা হয়। নকশী কাঁথায় সাধারণত মধ্যের অংশের নকশা আগে করা হয় এবং ধীরে ধীরে চারপাশের নকশা ক্রমাগত এগুতে থাকে। আগে নকশী কাঁথার খসড়ার জন্য কাঠের ব্লক ব্যবহার করা হলেও এখন এতে এসেছে কিছুটা ভিন্নতা বেশিরভাগ সময়ই এখন এই কাজে ট্রেসিং পেপার ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং বুননেও আসতে শুরু করেছে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া। বলে রাখা ভালো নকশী কাথাঁর নকশা কিন্তু কোন ধরা-বাধা নিয়ম মেনে হয় না, এটি মূলত শিল্পী তার আপন শৈল্পিক কারুকাজে সজ্জিত করে থাকেন তবে প্রাচীনকাল থেকেই নকশায় প্রাধান্য পেয়ে আসছে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির, এই ধরুণ পদ্ম নকশা, রথ নকশা, কাল্কা নকশা কিংবা সূর্য নকশা সব গুলোতেই কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাস ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে।
পদ্ম নকশার কথাই ধরা যাক, এই নকশা বহুল জনপ্রিয় কেননা পদ্মফুল হিন্দুধর্মের দেব-দেবীর সাথে যুক্ত।
কাঁথার কাজ শুরু হয় কেন্দ্র থেকে যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জায়গা পেয়ে থাকে বিভিন্ন ফুল কিংবা সুন্দর মোটিফ যাকে কেন্দ্র করে সুই- সুতো সমন্বয়ে চলতে থাকে নকশার বাহারী মেলা এবং যার হয় শেষ কাঁথার পাড়ে গিয়ে, বলাই বাহুল্য পাড় হলো একটি কাথাঁর সীমানার দিকের অংশ এবং পাড় গুলোও একটি কাথাঁকে আকর্ষনীয় করে তুলতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে যার মধ্যে মালা পাড়,গ্রেফি পাড়, চিক পাড় অন্যতম তবে কখনো কখনো শাড়ির পাড়কেই কাঁথার পাড় বানানো হয়ে থাকে।
তবে আমার লিখনী যেন শেষ হয়েও হইলো না শেষ, এই সোনালী অতিত সমৃদ্ধ বস্তুটি আমাদের হয়েও যে আমাদের হলো নাহ। কেনো?? জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই নাহ?? কারন এই সোনালী অতিত সমৃদ্ধ বস্তুটির ভৌগলিক স্বীকৃতি ২০০৮ সালে ভারতের পশ্চিম্বঙ্গ রাজ্য পায় যাহ আমাদের জন্যে নিতান্তই দুঃখজনক।
এই ঐতিহাসিক, গৌরবমন্ডিত পণ্যটিকে বিশ্ব-দরবারে তুলে ধরার দায়িত্ব কিন্তু আপনার উপরই ন্যস্ত।
Writer: ARAFAT KHAN PRITOM
CAMPUS AMBASSADOR
Textile Engineers society (TES)
Email: [email protected]