বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ও নান্দনিকতার ছোঁয়ায় স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প সমুহের মধ্যে এপ্লিক অন্যতম। যার নজরকাড়া ডিজাইন কিংবা নকশার জন্য তা জনপ্রিয়। তো চলুন জেনে নেয়া যাক এপ্লিক নামক এই কারুশিল্পের সম্পর্কে জানা-অজানা সকল তথ্য।
শুরুতেই জেনে নেই এপ্লিক কি?
এপ্লিক:এপ্লিক হলো সেলাইয়ের এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে টুকরো কাপড়কে জোড়া দিয়ে সেলাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রঙবেরঙের এবং পছন্দসই আকৃতির নকশা তৈরি করার শিল্প যা শোভাবর্ধক সূচিকর্ম নামেও পরিচিত এবং নিঁখুত ও নিপুণ নকশার জন্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। এটি সাধারণত সাজসজ্জার কাজে অধিক ব্যবহৃত হয়।
এপ্লিকের নামকরণ :এপ্লিক শব্দটি এসেছে মূলত ফ্রেঞ্চ এবং ল্যাটিন শব্দ এপ্লিকেয়ার থেকে যার অর্থ জোড়া দেয়া বা সংযুক্ত করা।সুতরাং এর নাম থেকেই বোঝা যায় কিছু একটা জোড়া দেয়ার কথা বলেছে আর তা হলো রঙিন টুকরো কাপড় যার মাধ্যমে একটি নকশা পূর্ণতা লাভ করে।সর্বপ্রথম মিশরীয়রাই এপ্লিক আবিষ্কার করেন।কিন্তু কিভাবে তা তৈরি করা হয় কিংবা কাজ করে চলুন এবার জেনে নেই।
প্রস্তুতকরণ:এপ্লিকের কাজটি করার জন্য প্রধানত কটনা বা ফাইন সিল্কের তৈরি সুতা ব্যবহৃত হয় কারন এ ধরনের ফাইবারের সুতা মসৃণ ও উজ্জ্বল হওয়াতে নকশার নিপুণ কারিগরি স্পষ্ট ফুটে ওঠে। সাধারণত রেডিমেড মডার্ণ চাইনিজ কাপড় কে প্রথমে ভালোভাবে ওয়াশ করে, আইরন করে ডিজাইন করা হয়।পরবর্তীতে এই এই নকশা খচিত টুকরো কাপড়টিকে পছন্দসই কাপড়ের উপর রেখে হেম সেলাই করা হয়ে থাকে।
এপ্লিক তৈরির পদ্ধতি:এপ্লিক তৈরির এই কাজটি বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে করা যায় যাতে ভিন্নধারার বা বৈচিত্র্যময়ী নকশা পাওয়া যায়।যার মধ্যে তিনটি পদ্ধতি বহুল ব্যবহৃত।
১) মেশিন এপ্লিক
২) হ্যান্ড এপ্লিক
৩) ফিউজড এপ্লিক
১) মেশিন এপ্লিক:এ পদ্ধতিতে এপ্লিকের সম্পূর্ণ কাজটি করা হয় মেশিনের মাধ্যমে এবং নকশাটি জিগজ্যাগ বা সাটিন প্যাটার্নের হয়।
২) হ্যান্ড এপ্লিক:এ প্রক্রিয়ায় শুধু হাতে সুচ-সুতা দিয়ে সেলাইয়ের কাজ করা হয়।এ পদ্ধিতিটি মূলত লেপ সেলাইয়ের কাজে ব্যবহৃত।
৩) ফিউজড এপ্লিক:যারা এপ্লিকের কাজে কম অভিজ্ঞ বা কম সময়ে নকশার কাজ করতে চান তাদের জন্য এই প্রক্রিয়াটি বেশ লাভজনক এবং এক্ষেত্রে মিশ্র /বিচিত্র নকশার ব্যবহার দেখা যায়।
এপ্লিকের ধরন:এসকল পদ্ধতি ছাড়াও কিছু ভিন্ন ধরনের এপ্লিক ও রয়েছে।যেমন,
১)স্মুথ এজ এপ্লিক
২) রো এজ এপ্লিক
৩) রিভার্স এপ্লিক
৪)ডেকোরেটিভ এপ্লিক
এর মধ্যে ডেকোরেটিভ বা সৌন্দর্যবর্ধনে এপ্লিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
এপ্লিকের সহজলভ্যতা: এপ্লিক ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প হলেও বর্তমানে তা এশিয়া মহাদেশ ছাড়িয়েও বিশ্ববিখ্যাত। লেদার এপ্লিক নামে যে এপ্লিকটি রয়েছে তা স্কানডিনাভিয়া, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপে এপ্লিক পাওয়া যায়।এর পাশাপাশি পাকিস্তান ও মরক্কোতেও এপ্লিক ব্যবহৃত হয়।এছাড়া মিশর,সাইবেরিয়া,বেনিন,পশ্চিম আফ্রিকাতেও এপ্লিক পাওয়া যায়।তবে ভারতের পিপিলি এবং পুরি নামক শহরে এপ্লিকের প্রচলন থাকলেও ওড়িশায় এপ্লিক বেশি ব্যবহৃত ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।তাছাড়াও খাতোয়া নামে একটি বিশেক এপ্লিক আছে যা কেবল ভারতের বিহারেই তৈরি ও ব্যবহৃত হয়।
এপ্লিকের ব্যবহার :সৌন্দর্য বা শোভাবর্ধন ছাড়াও এপ্লিকের আরও বহুল ব্যবহার রয়েছে।
☑️ বিছানার চাদরে
☑️ পোশাকের গলায়/হাতায়
☑️পর্দায়
☑️কুশন কভারে
☑️ এপ্লিকের শাড়ি
☑️ ওড়নায়
☑️শার্টে
☑️ পাঞ্জাবিতে
☑️ মেক্সিতে
☑️ ফতুয়ায়
☑️কম্বল /লেপে
☑️ ব্যানার তৈরিতে
☑️ কাপড়ের ব্যাগে
☑️ফ্লোর কাভারিংয়ে
☑️কিচেন এপ্রোনে
☑️ সিরামিকে
এছাড়াও নানান ক্ষেত্রে এপ্লিকের ব্যবহার রয়েছে সারা বিশ্বজুড়েই।
কর্মসংস্থানের খাত:এপ্লিকে হাতের কাজের ব্যবহার থাকায় তা গ্রামীন নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের উৎস হিসেবে কাজ করছে যার মাধ্যমে তারা এ শখের কাজটি করে উপার্জন করে সংসার চালানে এবং স্বাবলম্বী /আত্মনির্ভরশীল হতে সক্ষম।তাছাড়া আমাদের অর্থনীতির একটা বিরাট অংশ জুড়ে আছে পোশাকক্ষেত্র তাই এটি কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও সহায়ক কারণ মসলিন,নকশিকাঁথার মতো এপ্লিকের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা আছে এশিয়া এবং ইউরোপের সকল দেশে।
এপ্লিক মূলত কারুশিল্পে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং বিচিত্র নকশাই জনসাধারণের নজর ও মন কেড়েছে তাই এটি এশিয়া মহাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। আর এপ্লিকের নকশার বিশেষত্ব হচ্ছে শিল্পী তার মনের মতো আকৃতির রং, নকশা ফুটিয়ে তুলতে পারেন কোনো বাধাধরা বা গতানুগতিক নিয়ম অনুসরণ করে কাজটি করতে হয়না বলে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে নকশা তৈরিতে যার ফলে বিচিত্র নকশা এবং শিল্পের নৈপুণ্য পরিলক্ষিত হয়। আর এভাবেই এই নিঁখুত ও নজরকাড়া নকশার জন্যই এপ্লিক বিখ্যাত। তাই এ শিল্পকে বাচিঁয়ে রাখতে আমদের শিল্পচর্চার পাশাপাশি সংরক্ষণে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
তথ্যসূত্র :গুগল, উইকিপিডিয়া, ইউটিউব
Writer’s Information :
Tasnim Tajmi Islam Arjita
Ahsanullah University of
Science and Technology
Department of
Textile Engineering
(Batch-40)
2nd Year 1st Semester