কটন ফাইবার এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরুর আগে যেসব প্রাকৃতিক ফাইবার অত্যধিক পরিমানে ব্যবহৃত হত তার মধ্যে নেটল ফাইবার অন্যতম। নেটল নাম টা হয়তো অনেকের কাছে অপরিচিত। কিন্তু এই গাছটিকে প্রায় সবাই চিনে থাকবেন। অনেকে এটিকে না দেখলেও এর নাম শুনেননি এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যাবে। ঠিক আছে আপনাদের সাথে এর পরিচয় করিয়েই দিচ্ছি। বিছুটি নামক সেই ভয়ংকর গাছের পাতার কথা তো শুনেই থাকবেন। হ্যাঁ, সেই বিছুটি পাতা যার রস বা গুঁড়ো কারো গায়ে লাগলে ভয়ংকর রকমের চুলকানি হয়ে থাকে। যাদের এই অভিজ্ঞতা আছে শুধু তারাই বলতে পারবেন বিষয়টি কতোটা কষ্টদায়ক ।এই নেটল ফাইবার একসময় পোশাক শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কটন ফাইবারের জনপ্রিয়তা বাড়ার ফলে এই নেটল ফাইবার এর ব্যবহার পোশাকশিল্পে কমে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশের কথা চিন্তা করে পোশাক শিল্পে কটন ফাইবার এর ব্যবহার কমিয়ে নেটল ফাইবার ব্যবহারের দাবি উঠেছে।
নেটল উদ্ভিদ এর বর্ণনাঃ
নেটল বা বিছুটি হলো উদ্ভিদ জগতের ইউফোরবিয়াসেই পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এটি একটি সপূষ্পক উদ্ভিদ । আর এরা সবুজ উদ্ভিদ । গাছটি লম্বায় প্রায় ১-২ মিটার এবং এর পাতাগুলো প্রায় ৩-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। এই গাছটির পাতা, রস, পাতার গুড়ো প্রভৃতি যদি কোনো ক্রমে শরীরের কোথাও লেগে যায় তবে চুলকোতে শুরু করে। একপ্রকার অ্যালার্জির মতো। পরে শরীরের সেই স্থান ফুলে যায়। গাছটির কাণ্ড জুড়ে অতি সূক্ষ্ম লোমের মত ট্রাইকোম বিস্তৃত থাকে। গাছের গায়ে স্পর্শ করলে ট্রাইকোমের অগ্রভাগ ভেঙে যায় এবং এর ভেতর থেকে হিস্টামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন, সেরোটোনিন সহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। বিছুটি গাছ স্পর্শ করলেই যে হুল ফোঁটার মতো যন্ত্রণা অনুভূত হয়, তার জন্য এই রাসায়নিক পদার্থগুলোই দায়ী।সাধারণত ২ ধরনের নেটল ফাইবার পাওয়া যায়।১/ European Nettle or Stinging Nettle২/ Himalayan Nettle or Allo
ইতিহাসঃপোশাক শিল্পে নেটল ফাইবারের ব্যবহার হুট করেই জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এর ব্যবহার কিন্তু নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায় ২০০০ বছর ধরে এই নেটল ফাইবার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রথমদিকের নেটল ফাইবার এর ব্যবহার ব্রোঞ্জ যুগ বা তাম্র্য যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ – খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০) ডেনমার্কে শুরু হয়েছিল বলেও কিছু কিছু জায়গায় প্রমান পাওয়া যায়।তাছাড়া স্ক্যান্ডিনেভিয়া, পোল্যান্ড এবং জার্মানি সহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল, রাশিয়া,চীন এবং জাপানে এই নেটল ফাইবার উৎপাদনের প্রমান পাওয়া যায়। তুলা বা কটন শিল্পের দ্রুতগামী বিকাশ, তুলনামূলক সহজলভ্য এবং উৎপাদন মোটামুটি সহজতর হওয়ার ফলে ষোড়শ শতাব্দীতে পোশাক শিল্পে নেটল এর ব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস পায়। পোল্যান্ডের পোশাকশিল্পে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত নেটল ফাইবার এর ব্যবহার হয়েছে বলে জানা যায়। তাছাড়া সিল্ক স্কটল্যান্ডে পরিচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নেটল ফাইবার দ্বারা তৈরিকৃত পোশাক ব্যবহার করা হয়েছে যা “স্কট ক্লোথ” নামে পরিচিত ছিল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মান সৈনিকদের পোশাক তৈরিতে এই নিটল ফাইবারই ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
নেটল ফাইবারের গাঠনিক বৈশিষ্ট্যঃ
Diameter (μm): ২৫-৩৫
Length (mm): ৪২-৫১
Tensile strength(cN tex-1): ৩২-৭৬
Elongation (%):৩-৬
Young’s modulus (Gpa): ৫৯-১১৬
Density (g/cm3): ০.৭২
নেটল ফাইবারের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যঃ
সেলুলোজ (%): ৮১-৮৩
হেমিসেলুলোজ (%): ১১-১২
লিগিনিন (%): ২-৩
নেটল ফাইবারের গুণাগুণঃ
১/এটি সম্পূর্ণরুপে বায়োডিগ্রেডেবল।
২/এটি কটন এর চেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব।
৩/এই ফাইবার অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং টেকসই ।
৪/ফাইবারগুলোর ভিতরে ফাঁকা থাকে তাই এটি খুব ভালো অন্তরক হিসেবে কাজ করে।
৫/এই ফাইবার দ্বারা তৈরিকৃত পোশাক খুবই আরামদায়ক হয়ে থাকে।
৬/১০০% জৈব।
৭/নেটল ফাইবার থেকে উৎপন্ন পোশাক দেখতে খুবই আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।
৮/একে তুলার বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।
৯/এই গাছটিতে পোকামাকড় কম আক্রমন করে।তুলার তুলনায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিমান কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।
নেটল ফাইবার এর ব্যবহারঃযেহেতু আগেই বলা হয়েছে যে নেটল ফাইবার কে কটন ফাইবার এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাই বর্তমানে পোশাক শিল্পে আমরা যত ধরনের কটন ফেব্রিক দেখি তার সবই এই নেটল ফাইবার দ্বারা তৈরি করা যায়। শার্ট,প্যান্টসহ টেক্সটাইলের অন্যান্য বিভিন্ন সেক্টরে এই নেটল ফাইবার ব্যবহার করা যাবে। তাছাড়া শীতকালীন পোশাক তৈরিতেও নেটল ফাইবার অত্যন্ত কার্যকরী। কম্বল শিল্পেও এর ব্যবহার রয়েছে। দড়ি এবং মাছ ধরার জাল তইরিতেও এর ব্যবহার রয়েছে।ব্যাগ, মাদুর, টুপি তৈরিতেও এই নেটল ফাইবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ে প্রাকৃতিক ফাইবার এর ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে আবারও নেটল ফাইবারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এটি খুবই উন্নত মানের বায়োডিগ্রেডেবল হওয়ার কারনে নেটল ফাইবার নাইলন, এক্রাইলিক এবং পলিয়েস্টার যেমন প্লাস্টিক ফাইবারের উপর আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করেছে। তাছাড়া তুলা উৎপাদনের চেয়ে নেটল উৎপাদন বেশি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় পরিবেশসচেতন মানুষেরা বর্তমানে নেটল ফাইবার উৎপাদনের দিকে বেশি জোর দিচ্ছেন। তাই হয়ত ধারনা করা যায় এই নেটল ফাইবার পুনরায় কটন ফাইবারের দ্বারা দখলকৃত বাজারে আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করবে এবং তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
Source: www.wikipedia.com
Writer:Omar Saif
Department of Textile Engineering (3rd Batch)
Jashore University of Science and Technology