▪ধলসুন্দর, বাও, বিদ্যাসুন্দর, কেউত্রা, পাইধা, কাইটাবাও, কাজলা—এগুলো আমাদের গর্বের নাম, যার গরবে বাঙালি গর্বিত ছিল বহুকাল। পাকেচক্রে সে গর্ব এখন বিগত। সোনারং পাট আনত কাঁচা টাকা। আর সে টাকায় সমৃদ্ধ হয়েছিল একটি পুরো জাতি! সে জন্যই তার নাম ছিল ‘সোনালি আঁশ’। প্রায় দুই শ বছর পৃথিবীকে একচ্ছত্রভাবে পাটের জোগান দিয়ে গেছে এই বাংলাভূমি। এখন গল্পের মতো শোনালেও সেটাই ছিল বাস্তবতা।
বিশ্ববাজারে পাটের ক্রমাগত চাহিদা এবং ব্রিটিশ ভারতের সরকার কর্তৃক পাট চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করার ফলে পাট তৎকালীন বাংলায় একটি শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় দ্রুততার সঙ্গে। এ ব্যবসায় লাভবান হতে থাকেন ইউরোপীয় বণিকশ্রেণিসহ এ দেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। শুধু তা–ই নয়, এই ব্যবসা সামনে রেখে বাংলায় ফড়িয়া, ব্যাপারী, আড়তদার ও দালাল শ্রেণির সৃষ্টি হয়। নদীতীরবর্তী শত শত গঞ্জ, বন্দর মুখর হয়ে ওঠে পাট বাণিজ্যের সংস্পর্শে এসে। ‘শিপার’ নামক বিদেশি পাট রপ্তানিকারকদের আবির্ভাব ঘটে সে সময়ে।
পাটের ব্যবসায় শুধু ব্যবসায়ীরাই যে এককভাবে সম্পদের মালিক হয়েছিলেন, তা নয়। পাট উৎপাদন করে বাংলার নিম্ন–মধ্যবিত্ত এবং ধনী কৃষককুল যারপরনাই উপকৃত হয়েছিলেন। কৃষিপণ্য বিক্রি করে উদ্বৃত্ত অর্থ সঞ্চয় করা যায়—বাংলার কৃষকেরা এ কথা স্বপ্নেও কোনো দিন ভাবতে পারেননি। যুগ যুগ ধরে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বাংলার লাখ লাখ কৃষক পরিবার পাট উৎপাদন করে কার্যকরভাবে সর্বপ্রথম আর্থিক সচ্ছলতার পথে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সন্ধান পেয়েছিলেন। বিশেষ করে তৎকালীন বাংলার অনগ্রসর হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী পাট নামক এই ‘ক্যাশ ক্রপে’র কল্যাণে নিজেরা কোমর শক্ত করে দাঁড়াতে পেরেছিল। তারা নিজেদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর উচ্চাশা পূরণ করতে সক্ষম হয় ধীরে ধীরে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরু, এই সময়কালের মধ্যে বাংলার হাজার হাজার মুসলিম পরিবারের শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করে মূলত পাট বিক্রির টাকায়। শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া সমগ্র বাংলার বৃহৎ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরাই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিভিন্ন পরিবর্তনের।
ফলে পাট বাঙালির জীবনে শুধুই একটি অর্থকরী ফসল নয়। এটি বাঙালিকে সমৃদ্ধ করেছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে।
প্রাচীন বইপত্রে সূক্ষ্ম পট্টবস্ত্র বা পাটের শাড়ি, পাটশাকের তরকারি কিংবা বিদেশি ভ্রমণকারীদের বর্ণনায় পাটের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে শত শত বছর ধরে বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে পাট উৎপন্ন হতো এবং সে পাট অর্থনৈতিকভাবে বাংলা অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান, পাট, গম, যব এবং নানা ধরনের ডাল। এগুলো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত হলেও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ফলত সবচেয়ে বেশি। কারণ, পলিবিধৌত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা প্রাকৃতিকভাবে উর্বর অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকা এবং উজানের আসাম অংশের ব্রহ্মপুত্র, বিশেষ করে ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া জেলার ব্রহ্মপুত্র সন্নিহিত অঞ্চলগুলো বিশ্বের প্রধান পাট উৎপাদনের এলাকা। কিন্তু এই বিপুল পাট দেশীয় চাহিদা মেটালেও একটা দীর্ঘ সময় বাংলার প্রধান অর্থকরী সম্পদ হয়ে ওঠেনি। পাট বাংলার প্রধান অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠার পেছনে বেশ কিছু ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক ঘটনা জড়িয়ে আছে, তার মধ্যে দুটি যুদ্ধও আছে!
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পাটের আন্তর্জাতিক বাজারঃ
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের কাঁচা পাটকে সর্বপ্রথম একটি কৃষিপণ্য হিসেবে বাজারজাত করে। ফলে পাট আন্তর্জাতিকভাবে একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে বিশ্বের বাজারে পরিচিতি পায়। কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা জাহাজের জন্য শক্ত রশি তৈরি করার কাজে কোন ধরনের তন্তু কার্যকরি হবে, তার খোঁজ করছিলেন বেশ আগ্রহের সঙ্গে। শেষে তাঁরা এ দেশের পাটকে আবিষ্কার করলেন জাহাজের মজবুত রশি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে। কোম্পানির লোকেরা যখন পাট দিয়ে জাহাজের রশি তৈরির কথা চিন্তা করছেন, তখনো বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালু হয়নি।
যাহোক, বেঙ্গল বোর্ড অব ট্রেডের উদ্যোগে সর্বপ্রথম ১৭৯১ সালে পাটের নমুনা পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে। কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস পাঠানো পাটের নমুনা দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এরই ফলে ১৭৯৩ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এক হাজার টন কাঁচা পাট ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হয়। এর তিন বছর পর ১৭৯৬ সালে, বাংলা থেকে ৬৫ টন কাঁচা পাট দ্বিতীয়বারের মতো রপ্তানি করা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। একই বছর ৪০ টন পাট জার্মানিতে এবং ৬ টন পাট যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। পরবর্তী বছরগুলোতেও বাংলা থেকে পাট রপ্তানি হতে থাকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়।
সে আমলে পাট থেকে প্রস্তুত করা হতো জাহাজের রশি, পাকানো দড়ি, পাপোশ, ডোর ম্যাটস ইত্যাদি। এর কয়েক বছর পরেই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়ে গেল পাটকে কেন্দ্র করে। ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ার জেলার অ্যাবিংডনে ১৮২০ সালে পাটের তন্তু থেকে সুতা তৈরির কৌশল উদ্ভাবন হয়। এ ঘটনার কয়েক বছর পর ১৮৩৫ সালে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি নামক শহরে বিশ্বের প্রথম পাটের কারখানায় পাটের তন্তু বা আঁশ থেকে সুতা তৈরি করে বাজারজাতকরণ শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে সে সময় থেকেই ইংল্যান্ডে পাটের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে শুরু করে।
▪পাটকল স্থাপনঃ
১৮৮৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড একজন বাঙালি অংশীদার (শ্যামসুন্দর সেন) নিয়ে কলকাতার হুগলি নদী তীরবর্তী রিশড়া নামক স্থানে প্রথম পাটকল স্থাপন করেন। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় পাট উৎপাদিত হত। কিন্তু ১৮৮৫ সালের পূর্বে স্থানীয় তন্তুবায় শ্রেণি দরিদ্র জনগণের জন্য মোটা বস্ত্র তৈরি করত। পাটভিত্তিক শিল্প স্থাপনের অনুপ্রেরণা আসে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি থেকে। নেপোলিয়ানের যুদ্ধের সময় ঘন ঘন নৌ-অবরোধের ফলে রাশিয়ার শন জাতীয় গাছের কারখানাগুলি বিকল্প হিসেবে পাট ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। ১৮৩২ সালে বেলফোর ও মেলভিলের কারখানাগুলি কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকে কাঁচাপাট আমদানি করে এবং এই কাঁচাপাটের সঙ্গে তিমির তেল ও পানি মিশিয়ে পাট নরম করে নেয়। ১৯৩৮ সালে এই নতুন প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়। এ সময় ডান্ডির মিলগুলি জাভা থেকে আমদানি করা চিনির জন্য ডাচ সরকারের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যাগ তৈরির কার্যাদেশ পায়। ডাচ সরকার এই তৈরিকৃত পাটের ব্যাগ গ্রহণ করে এবং এই মোটা ক্যানভাস বিশেষ সামগ্রী হিসেবে স্থায়ীরূপ লাভ করে। এই ব্যবস্থা কাপড় ও ব্যাগ উৎপাদনে পাটের ব্যবহার শুরুতে সহায়তা করে। ফলে পাটশিল্পে নতুন প্রেরণার সূচনা হয়। অবশ্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধই (১৮৫৪-৫৬) প্রকৃতপক্ষে পাটশিল্পকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্ববাণিজ্য প্রতি বছর শতকরা ৫ ভাগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে ঔপনিবেশিক অঞ্চল থেকে বিকল্প অাঁশ সহজলভ্য হলে ডান্ডির কারখানাগুলি আর অলসভাবে বসে থাকে নি। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-৬৫) এই বিকল্প প্রক্রিয়ায় আরো উৎসাহ প্রদান করে। এই যুদ্ধের ফলে আমেরিকা থেকে তুলার সরবরাহ অনেকাংশেই সীমিত হয়ে পড়ে। কারণ পরিখা যুদ্ধকালে ইউনিয়ন এবং কনফেডারেসির সৈন্যদের জন্য মোটা বস্তা ও বালির বস্তা, পাটের অাঁশ দিয়ে পাকানো সুতা, দড়ি সরবরাহ বিঘ্নিত হয় এবং মূল্যও বৃদ্ধি পায়। ফলে ডান্ডির টেকসই বিকল্প অাঁশের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। উভয় ক্ষেত্রেই এই শিল্প নতুন ব্যবহারকারীর সন্ধান পায় যারা আর কখনো শন বা তুলার ব্যবহারে ফিরে যায় নি। এই স্থায়ী পরিবর্তনের প্রধান কারণ ছিল তুলনামূলকভাবে পাটের সস্তা দামের সুবিধা।
এভাবে প্রথম যখন বাংলায় পাটকল স্থাপিত হয় তখন ডান্ডির মিলগুলি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তাদের পণ্যের জন্য নতুন বাজারের সন্ধান করছিল। কিন্তু কলকাতার মিলগুলি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দ্রুত অগ্রগতি সাধন করে। ১৮৮২ সালে মিলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮টিতে উন্নীত হয় এবং ১৯০১ সালে ৩ লক্ষ ১৫ হাজার সুতা কাটার টাকু, ১৫ হাজার তাঁত, ১ লক্ষ ১০ হাজার শ্রমিক এবং ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে মিলের সংখ্যা ৩৫-এ উন্নীত হয়। এখানে উৎপাদিত ৮৫% পাটজাত দ্রব্য অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। এভাবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পাট শিল্প উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পে পরিণত হয় এবং কলকাতা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের যাত্রা মূলত শুরু হয় ১৯৫২ সালে নারায়নগঞ্জে বেসরকারী মিল বাওয়া জুট মিলস লিঃ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে পাট শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পূর্বে জুট মিলের সংখ্যা ছিল ৭৫। ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ নং P.O-27 (The Bangladesh Industrial Enterprises Nationalization Order, 1972) অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসি (East Pakistan Industrial Development Corporation) এর মোট ৬৭টি পাটকলের তদারকি, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে এর নিয়ন্ত্রণাধীন মিলের সংখ্যা ছিল ৮২টি। ১৯৮২ সালের পর মোট ৮২টি পাটকল এর মধ্যে ৩৫টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ, ৮টি মিলের পুঁজি প্রত্যাহার এবং ১টি পাটকল (বনানী) ময়মনসিংহ পাটকলের সাথে একীভূত করার পর বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন মিল সংখ্যা ৮২টি থেকে কমে ৩৮টিতে দাঁড়ায়।
▪আদমজী জুটমিলঃ
আদমজী পাট কলে বিভিন্ন পাটজাত দ্রব্য প্রস্তুত করা হত। এটিকে এক সময় বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি (স্কটল্যান্ডের ডান্ডির নামানুসারে)। ১৯৭০ এর দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিন পাটতন্তুর বিকল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে আদমজী পাট কলের স্বর্ণযুগের অবসান হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে ১৯৮০ এর দশকের কয়েকটি বছর ব্যতীত অন্য সব বছর এটি বিপুল পরিমাণে লোকসান দেয়। শ্রমিক ও মূলতঃ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাধা সত্ত্বেও ২০০২ খ্রীস্টাব্দের ২২শে জুন এই কলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। পাকিস্তানের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই এ. ওয়াহেদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ আদমজী যৌথভাবে আদমজী জুটমিল প্রতিষ্ঠা করেন। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়ায় আদমজী জুটমিল গড়ে ওঠে ২৯৭ একর জমির ওপর। ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে এই মিলের উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর। ওই সময় এই মিলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর যাত্রা শুরুর পর পরই আদমজী জুট মিলস লি. শেয়ার ছেড়ে বিনিয়োগ উন্নীত করা হয় ৭ কোটি টাকায়। তখন মিলে তাঁতকল বসানো হয় ৩ হাজার ৩০০টি। আদমজী জুট মিলে উৎপাদিত চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দব্য দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ সময় আদমজী জুট মিল হয় পৃথিবীর অন্যতম জুট মিল এবং এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ কারখানা। আদমজীকে ঘিরে শীতলক্ষ্যার দুইপাড়ে সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর ও সোনারগাঁয়ে গড়ে ওঠে বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাস।
▪বাংলার অভ্যন্তরীণ রপ্তানিমুখী শিল্পঃ
পূর্ববঙ্গের, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় পাটের সুতা থেকে বয়নশিল্পীরা উন্নত মানের কাপড়সহ পাটজাত নানা ধরনের পণ্য তৈরি করতেন। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হতো সেসব পণ্য। স্থানীয়ভাবে পাটের আঁশ থেকে পাওয়া সুতায় তৈরি কাপড় ইউরোপের যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স; উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বার্মা, জাভা, চীন এসব দেশে রপ্তানি হতে থাকে। ১৮৫০ সালে পূর্ববঙ্গে হস্তচালিত তাঁতে উৎপন্ন সর্বমোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৭১৩ পিস কাপড় উল্লিখিত দেশগুলোয় রপ্তানি হয়েছিল। সে আমলে এর বাজারমূল্য ছিল ২ লাখ ১৫৯ হাজার ৭৮২ রুপি।
▪ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, রাশিয়ার ফ্ল্যাক্স এবং আমেরিকার গৃহযুদ্ধঃ
১৮২০ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে স্কটল্যান্ডে পাটের সুতা আবিষ্কার হয়ে গেছে। সে সুতা দিয়ে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি শহরের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরিও শুরু হয়ে গেছে তত দিনে। তারপরও ডান্ডির টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ছিল ফ্ল্যাক্স–নির্ভর। রাশিয়া থেকে ফ্ল্যাক্স ডান্ডির মিলগুলোয় রপ্তানি হতো।
এ সময় তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৩-১৮৫৬)। ১৮৫৩ সালে তুরস্কের সহায়তায় এগিয়ে আসে ইংল্যান্ড। এর ফলে রাশিয়া ইংল্যান্ডে ফ্ল্যাক্স রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ ঘটনায় পাটের ভাগ্য খুলে যায়। ফ্ল্যাক্স তন্তুর বিকল্প হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের পাট তন্তু ব্যবহার করা শুরু হয় বিভিন্নভাবে, যে পাটের বেশির ভাগ উৎপন্ন হতো বাংলায়।
এর পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে শুরু হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫)। এর ফলে সরাসরি পাটের গুরুত্ব বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফেডারেল ও কনফেডারেট এ দুটি বাহিনী লড়ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। পরস্পর যুদ্ধরত এ দুটি দলের সৈন্যবাহিনীর জন্য ব্যাপক প্রয়োজন দেখা দিল পাটের তৈরি ব্যাগের। আগে উভয় সেনাবাহিনী তুলা থেকে তৈরি ব্যাগ দিয়ে প্রয়োজন মেটাত। তুলার ব্যাগের চেয়ে গানি ব্যাগ বা পাটের তৈরি ব্যাগ অনেক বেশি কার্যকর হওয়ার ফলে উভয় দল যুদ্ধ চলাকালীন প্রচুর পরিমাণে পাট বাংলা থেকে আমদানি শুরু করে। উনিশ শতকের এসব আন্তর্জাতিক ঘটনা বাংলার পাটকে আরও বেশি বৈশ্বিক করে তোলে।
এর প্রমাণ মেলে উনিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে সত্তরের দশক পর্যন্ত পাওয়া পরিসংখ্যানে। উল্লিখিত সময়ে বাংলায় পাটের চাষ ও চাষের আওতাধীন মোট জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
বছর || জমির পরিমাণ/একর
১৮৩৫-১৮৪০ || ৮,৩৫৭
১৮৪০-১৮৪৫ || ১৫,৮৪২
১৮৪৫-১৮৫০ || ১৯,৩৬৫
১৮৫০-১৮৫৫ || ৪৮,৭৭০
১৮৬০-১৮৬৫ || ১৮২,৪১৭
পরিসংখ্যান জানিয়ে দিচ্ছে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, আমেরিকা গৃহযুদ্ধ এবং পাটের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ফ্লাক্সের চেয়ে অনেক কম হওয়ার কারণে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলায়, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-পদ্মা অববাহিকায় পাট চাষে রীতিমতো বিপ্লব এনে দিয়েছিল। পাট চাষের ইতিহাসে এটি অভূতপূর্ব ঘটনা।
▪১৮৯৫ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে বিশ্বে পাটের চাহিদা শতকরা ৩০০ গুণ বৃদ্ধি পায় এবং যুদ্ধের বছরগুলিতে এর পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পায়। এর সঙ্গে আরেকটি অনুকূল উপাদান যোগ হয় এবং সেটি হলো যন্ত্রপাতি এবং মিলের প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর রপ্তানির উপর সরকার কর্তৃক আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। ফলে বাংলার পাটকলগুলি থেকে পাটজাত দ্রব্য সামগ্রীর বর্ধিত চাহিদা মেটাতে হয় এবং এ কারণে বিদেশে বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন ক্ষমতার উপর বাধা-নিষেধ আরোপিত হয়ে মিলগুলি উচ্চহারে লাভ করার সুযোগ পায়। প্রকৃত মুনাফার সূচি ১৯১৪ সালের ১০০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯১৭ সালে ৫৭০-এ উন্নীত হয়। কিন্তু এই সাফল্য ও উন্নতি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাটকলগুলির বিনিয়োগ থেকে লক্ষণীয় মাত্রায় মুনাফা হতে শুরু করে এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ১৯২০-২১ এবং ১৯২৯-৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২১টি পাটকল স্থাপিত হয় এবং ১৯৩০ সালের মধ্যে মোট তাঁতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪০০০-এ উন্নীত হয়। এর পাশাপাশি সপ্তাহে কর্ম-সময় ৫৪ ঘন্টা থেকে ৬০ ঘন্টায় বৃদ্ধি পায়।
▪পাট দিয়ে এখন নানা ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে৷ প্রচলিত পাটের বস্তা বা ব্যাগ ছাড়াও তৈরি হচ্ছে শো-পিস, শপিং ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, পর্দা, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, মেয়েদের গহনা, স্যান্ডেল, বেড কভার, কুশন কভার, সোফা কভার, পর্দা, টেবিল ম্যাট, কার্পেট, ডোরম্যাট, শতরঞ্জি, ফতুয়া, কটি প্রভৃতি৷ পাট দিয়ে বিকল্প পলিব্যাগ তৈরির একটি প্রকল্পও শুরু হয়েছে৷ ডেনিম জিন্স তৈরির জন্যও সরকার প্রকল্প দিয়েছে৷ আছে পাট পাতার হার্বাল চা, যা রপ্তানি হচ্ছে জার্মানিতে৷ পাট দিয়ে বিকল্প পলিব্যাগ তৈরির প্রকল্পেও আছে জার্মান কারিগরি সহায়তা৷ চলুন আরো কিছু পাটের আবিষ্কার সম্পর্কে জেনে আসি-
▪পাট থেকে ঢেউটিনঃ সৃষ্টির শুরু থেকে প্রতিনিয়ত আমরা কোনো না কোনো আবিষ্কারের আভাস পেয়ে যাচ্ছি । তার মদ্ধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী আবিষ্কার থাকে যা সত্যি ই অবাক করে দেওয়ার মত। ঠিক তেমনি অবাক করার মত এক আবিষ্কার নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মুবারক আহমেদ খান। যখন আবিষ্কারের নামটি শুনবেন, তখন আপনিও অবাক হবেন এবং বিশ্বাস নাও হতে পারে আপনার। আচ্ছা, আমরা তো সকলে টিন সম্পর্কে জানি। তবে যদি বলা হয় এই টিনই হতে পারে পরিবেশ বান্ধব, তবে কি অবাক হবেন?
হ্যাঁ অবশ্যই অবাক হবেন। বিজ্ঞানী ড.মুবারক আহমেদ খান সকল কে অবাক করে দিতেই এমন এক অদ্ভুত আবিষ্কার নিয়ে হাজির হলেন। আবিষ্কারটি হচ্ছে পাট দিয়ে পরিবেশ বান্ধব টিন তৈরি। পাটের ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে Jute । তাই পাট দিয়ে তৈরি বলে এই টিনের নাম জুটিন। বাংলাদেশের এই বিজ্ঞানীর বিশ্বাস, এই জুটিন ১০০ বছর অনায়াসে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। টিনের প্রধান উপকরণ লেড এবং জিংকের যোগান পুরোটাই আমদানি নির্ভর। এই অর্থসাশ্রয়ের কথা চিন্তা করেই বিজ্ঞানী এই আবিষ্কারটি করেন। কারণ এই জুটিনের ব্যবহার বাড়লে প্রতি বছর সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা।
▪পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগঃ দেখে মনে হবে পলিথিনের ব্যাগই৷ ব্যবহারও করা যাবে পলিথিনের মতোই৷ কিন্ত সেটি মোটেও পরিবেশ দূষণকারী নয়৷ কেননা এই ব্যাগের কাঁচামাল পাট৷ যা ফেলে দিলে মাটি বা পানির সঙ্গে মিশে যায় অনায়াসে৷ এই সোনালি ব্যাগের উদ্ভাবক বাংলাদেশের একজন বিজ্ঞানী৷
▪পাটের পাতা থেকে সবুজ চাঃ বাংলাদেশে পাটের পাতা থেকে ‘সবুজ চা’ উৎপাদন শুরু হয়েছে৷ এরইমধ্যে তা রপ্তানি হচ্ছে জার্মানিতে৷ তবে বড় পরিসরে উৎপাদন শুরু করতে আরো সময় লাগবে৷ সেজন্য জামালপুরে একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়।
▪পাট কেবল আঁশ আর শাক নয়, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উপকারীও বটেঃ আবাদি ও অনাবাদি মিলে পাটের (Corchorus spp) ৬০ টি প্রজাতি আছে। দেশী পাট (Corchrorus capsularis) এবং তোষাপাট (Corchous olitorius) প্রধানত আঁশের জন্য আবাদ করা হয়। তবে এ দুটি প্রজাতির কচি পাতা শাক হিসাবে ও ব্যবহার হয়। অন্যান্য অনাবাদি প্রজাতিগুলির পাতা কুড়িয়ে পাওয়া শাক হিসেবে ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে । মিশরীয় সভ্যতা বিকাশের সাথে পাট শাক ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। এক সময় ব্যাবিলনের রাজপথে পাট শাক ফেরি করে বিক্রী হতো। জানা যায় পাট শাক ফেরাউন এবং রানী ক্লিপ্রেট্টার পছন্দের তালিকায় ছিল। স্থান ভেদে পাট শাকের বিভিন্ন স্থানীয় নাম পাওয়া যায় যেমন mulukhiya,molohiya, mloukhiya ইত্যাদি।
▪পুষ্টি গুণঃ পাট শাকে প্রচুর পরিমাণ খনিজ লবণ যেমন পটাশিয়াম,আয়রন, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম এবং ভিটামিন যেমন ভিটামিন সি, ই, কে, বি- ৬ এবং নিয়াসিন রয়েছে। পাট শাকে আরো আছে এন্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যারোটিন,এবং খাদ্য আঁশ যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
▪বেসরকারি বনাম সরকারি পাটকলঃ
১৯৮৪ সালে কুষ্টিয়ার বিসিক শিল্প এলাকায় সাড়ে পাঁচ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় নর্দান জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি। বেসরকারি খাতের মিলটি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাটের সুতা বিক্রি করে মুনাফা করেছে ছয় কোটি টাকা।
দেশে বেসরকারি খাতে অন্যতম বড় পাটকল আকিজ জুট মিলস। গত ২০১৫ সালে ৮১ হাজার ৩৩৮ মেট্রিক টন পাটপণ্য রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬২ মেট্রিক টন। তার মানে তিন বছরের ব্যবধানে আকিজের পাটের সুতার রপ্তানি বেড়েছে ২৪ হাজার ৭২৪ মেট্রিক টন। অন্যদিকে সরকারি পাটকলের রপ্তানি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৩৫ কোটি টাকা হলেও পরের বছর সেটি কমে ২৫৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
শুধু তা-ই নয়, গত বছর যেখানে আকিজ একাই ১ লাখ মেট্রিক টন পাটপণ্য রপ্তানি করেছে, তার বিপরীতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে-বিদেশে সরকারি ২২টি পাটকলের পাটপণ্য বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ শতাংশ বা ৫৮ হাজার ৩৬৫ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে বিজেএমসি।
▪সরকারি পাটকলের যুগের অবসানঃ
সরকারের পাটকলগুলো ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। সে সময় যেসব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিল, তা দিয়েই চালানো হচ্ছিল। ফলে উৎপাদনশীলতা অর্ধেকে নেমে আসে। ২০০৯ সালে পাটকল লাভজনক করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নে নজর দেওয়া হয়নি। এমনকি যে বিজেএমসিকে নিয়ে বর্তমানে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, সেখানেও সংস্কারের কোনো হাত পড়েনি। ফলে লোকসানের গল্পের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
২০১০-১১ অর্থবছরেই কেবল একবার সরকারি পাটকলগুলো ১৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা মুনাফা করে। পরের বছরই ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করে। তারপর ধারাবাহিকভাবে লোকসান বেড়েছে। এর মধ্যে সব মিলিয়ে গত ১০ বছরেই ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল।
দেরিতে হলেও পাটকলের আধুনিকায়নে একটা উদ্যোগ নিয়েছিল অবশ্য বিজেএমসি। সেখানেও ছিল গলদ। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইউএমসি, জেজেআই ও গালফা হাবিব—এই তিন মিল বিএমআরই করার জন্য ১৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। একনেকে পাসের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আড়াই কোটি টাকা ছাড় করা হলেও পুরোটা ব্যয় করতে পারেনি করপোরেশন। ৩৭ লাখ টাকা ফেরত যায় সরকারের কোষাগারে। এরপর ২২টি পাটকল বিএমআরই করার জন্য চীনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা এগোলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
নির্বাচনী ইশতেহারে পাটশিল্পকে লাভজনক ও বেসরকারীকরণ বন্ধ করার কথা ছিল। আর তাই ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধ দুই পাটকল চালু এবং বেসরকারীকরণ করা তিন পাটকল ফিরিয়ে এনে আবার চালু করে। এ জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। এর পরের ১০ বছরে সরকারি পাটকল লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। অথচ বেসরকারি পাটকল এখনো লাভের মুখ দেখছে।
সব মিলিয়ে সরকারি পাট খাতের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ এখন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে স্বেচ্ছা অবসরে (গোল্ডেন হ্যান্ডশেক) পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে ১ জুলাই পাটকল বন্ধ করা হয়েছে।
▪পাটের সুসময়ে পাটকল বন্ধঃ
পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে কিন্তু এখনো সুসময় চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্যসহ অন্য বড় সব খাতের রপ্তানি আয় যেখানে কমে গেছে, সেখানে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
বিদায়ী অর্থবছরের ৮৮ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির মধ্যে পাটসুতা ৫৬ কোটি ডলারের। নব্বইয়ের দশকে যাত্রা শুরু করা বেসরকারি পাটকলগুলোই বর্তমানে পাটসুতা রপ্তানি করছে। সেই পাটসুতা রপ্তানি করেই মুনাফা করছে একেকটি পাটকল। তবে সরকারি পাটকলগুলো তার ধারেকাছেও ছিল না। বস্তা দিয়ে উৎপাদন শুরু করা সরকারি পাটকলগুলোর কার্পেটের নিচের অংশের কাপড় বা সিবিসি উৎপাদনই ছিল মূল কাজ। কয়েক বছর ধরে কয়েক ধরনের পাটের ব্যাগ করলেও বহুমুখী পণ্য উৎপাদনেও পিছিয়ে ছিল বিজেএমসি। সোনালি ব্যাগ নামে পাটের পলিব্যাগ ও পাট থেকে পানীয় উৎপাদনের বিষয়টি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করলেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। বিশ্বব্যাপী পলিথিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়েছে। সুযোগটি ভালোভাবে কাজে লাগানো গেলে পাটপণ্যের রপ্তানি বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব।
▪পাটের বর্তমান অবস্থানঃ
দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ধারাবাহিকভাবে ভাটার টান থাকলেও সোনালি আঁশ খ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্যে এবার জোয়ার আসছে। বিশেষ করে পাট ও পাটজাত পণ্যের কাঁচামাল প্রায় শতভাগ দেশীয় হওয়ায় চীনের করোনাভাইরাসের ফলে এ খাতে ইতিবাচক প্রভাবই পড়ছে। পাটের সুতার চাহিদা তুরস্কসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে বাড়ছে। এসব দেশে বাংলাদেশের পাটের সুতা থেকে উন্নত মানের কার্পেট তৈরি করে বিভিন্ন দেশে বিশ্বমানের কার্পেট সরবরাহ করা হয়। তাঁরা আরো জানান, রপ্তানি আয় বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে পাট ও পাটজাত পণ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে পাটজাত পণ্য ও বাজার বহুমুখী করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি দেশের পাটজাত পণ্য ইউরোপ, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া, আফ্রিকা, কোরিয়া এবং চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশে এর চাহিদাও বাড়ছে।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে। ওই অঙ্ক ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছিল ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে পাটসুতা রপ্তানি থেকে ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। অর্থাৎ মোট রপ্তানি ৬৪ শতাংশই এসেছিল পাটসুতা রপ্তানি থেকে। কাঁচাপাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছিল ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। এছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১৯ কোটি ডলারের। এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে পাট খাত। আজ যখন ‘পরিবেশবান্ধব’ উপকরণের চাহিদা রয়েছে পুরো পৃথিবীতে, তখন আমরা আমাদের পরিবেশবান্ধব ফসলটির সব সম্ভাবনা গলা টিপে হত্যা করেছি। আমরা কি এতটাই আত্মঘাতী?
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো, বাংলা পিডিয়া।
Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador – TES
NITER (10th Batch)