জুট বা পাট, বাংলাদেশর সোনালী আশ নামে সুপরিচিত এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে বাওয়া জুট মিলস লি: স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। যেটা ছিল নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত বাংলাদেশর প্রথম পাটকল । পরবর্তীতে এই সময়েই একই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজী পাটকলের এবং এর পরপরই কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে ওঠে অসংখ্য শিল্প কারখানা, ১৯৬০’এ যার সংখ্যা ১৬টি ও স্বাধীনতার পূর্বে সংখ্যা ছিল ৭৫টি । তার পর থেকেই শুরু হয় পাটকল এর অগ্রযাত্রা।
পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিশ্ব যখন পলি ব্যাগ কে না করছে আমরা তখন পাটশিল্পর মত একটি শিল্পকে নিজ হাতে খুন করেছি।একসময় পাট বাংলাদেশর সবচেয়ে অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত ছিল। শুধু তাই নয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত ছিল পাট।কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি মৃত প্রায়। বিশ্ব যখন কৃত্রিম তন্তু বাদ দিয়ে পাট ও তুলা কে প্রাধান্য দিচ্ছে আমরা তখন নির্বুদ্ধিতা আর দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে পাটের সুতা আর চট এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছি ।
স্বাধীনতার পরপর পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে রপ্তানি আয়ে ৮৭ শতাংশ আসত যা আজ সিঙ্গল ডিজিটে রুপান্তরিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ৬৭টি ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকল তদারকি, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন’ গড়ে তোলেন।আবার পাটের গবেষণা ও উন্নয়নে উৎকর্ষ অর্জনের রূপকল্প এবং পাটের কৃষি, কারিগরি শিল্প ও জুট টেক্সটাইল বিষয়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষক ও পাটসংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদের উপার্জন বৃদ্ধি, দারিদ্র, হ্রাস, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং পরিবেশ রক্ষা করার অভিলক্ষ্যকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে অ্যাক্টের মাধ্যমে দেশের অন্যতম প্রাচীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বর্তমান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু কিছু বছরের মধ্যেই এই সংস্থা গুলি পাট শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। লোকসানের দোহাই দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় নয়তো ব্যক্তি মালিকানাধীন করে দেওয়া হয় এই সব পাটকল ।
দুর্নীতি, অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনার কারনে একের পর এক বন্ধ হতে থাকে পাটকল । শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি না দেওয়ার কারনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন শ্রমিকরা ।
বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্র্রণাধীন পাটকল ও মিলকারখানার সংখ্যা মোট ৩২ টি ।
মিলের ধরণ | মিলসংখ্যা |
পাটকল/ জুটমিল | ২২টি |
নন-জুটমিল | ৩টি |
বন্ধমিল (মনোয়ার জুট মিলস লিঃ মামলাজনিত কারণে হস্তান্তর হয়নি) | ১টি |
পুনঃ গ্রহণকৃত মিলের সংখ্যা | ৬টি |
মোট মিলের সংখ্যা | ৩২ টি |
বিজেএমসির মিল/প্রতিষ্ঠানসমূহ :
জুট মিলসমূহ | |
১. বাংলাদেশ জুট মিলস লি. ঘোড়াশাল, পলাশ, নরসিংদী। | ১২. বাগদাদ-ঢাকা-কার্পেট ফ্যাক্টরি লি. নর্থ কাট্টলী, চট্টগ্রাম। |
২. করিম জুট মিলস লি. ডেমরা, ঢাকা। | ১৩. কেএফডি, রাংগুনিয়া, চট্টগ্রাম। |
৩. লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লি. ডেমরা, ঢাকা। | ১৪. কার্পেটিং জুট মিলস লি. রাজঘাট, নোয়াপাড়া, যশোর। |
৪. ইউএমসি জুট মিলস লি. নরসিংদী। | ১৫. যশোর জুট ইন্ডাষ্ট্রিজ লি., রাজঘাট, নোয়াপাড়া, যশোর। |
৫. রাজশাহী জুট মিলস লি.শ্যামপুর, রাজশাহী | ১৬. ইস্টার্ন জুট মিলস লি. আটরা শিল্প এলাকা, খুলনা। |
৬. জাতীয় জুট মিলস লি. রায়পুর, সিরাজগঞ্জ্ | ১৭. আলীম জুট মিলস্ লি. আটরা শিল্প এলাকা, খুলনা। |
৭. আমিন জুট মিলস লি. ও ওল্ড ফিল্ডস লি.,ষোল শহর,চট্টগ্রাম। | ১৮. ক্রিসেন্ট জুট মিলস লি. টাউন খালিশপুর, খুলনা। |
৮. গুল আহমদ জুট মিলস লি. কুমিরা, বারবকুন্ড, চট্টগ্রাম। | ১৯. প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস লি. টাউন খালিশপুর, খুলনা। |
৯. হাফিজ জুট মিলস লি. বার আউলিয়া, চট্টগ্রাম। | ২০. খালিশপুর জুট মিলস লি. টাউন খালিশপুর, খুলনা। |
১০. এম এম জুট মিলস লি. বাঁশবাড়িয়া, চট্টগ্রাম। | ২১. দৌলতপুর জুট মিলস লি. টাউন খালিশপুর, খুলনা। |
১১. আর আর জুট মিলস লি. বাঁশবাড়িয়া, চট্টগ্রাম। | ২২. স্টার জুট মিলস লি. চন্দনী মহল, খুলনা। |
নন-জুট মিল :
১. জুটো ফাইবার গ্লাস ইন্ডাষ্ট্রিজ লি. (নন-জুট), রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ। |
২. গালফ্রা হাবিব লি. (নন-জুট), নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম। |
৩. মিলস ফার্নিসিং লি. (নন-জুট), নাসিরাবাদ, চট্টগ্রাম। |
বন্ধ মিল |
১. মনোয়ার জুট মিলস লি. সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ |
পুন:গ্রহণকৃত (Take Back) মিল |
১. ঢাকা জুট মিলস্ লি. কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা |
২. এ, আর, হাওলাদার জুট মিলস্ লি. মাদারীপুর |
৩.ফৌজি চটকল লি. পলাশ, ঘোড়াশাল, নরসিংদী |
তবে দুঃখের বিষয় ২ জুলাই সর্বশেষ পাটকলগুলোও বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সরকারি পাটকলে লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। তারা পাট কেনে দেরিতে ও বেশি দামে। এ ছাড়া সরকারি পাটকলের উৎপাদনশীলতা কম, উৎপাদন খরচ বেশি, যন্ত্রপাতি পুরোনো এবং বেসরকারি খাতের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি বেশি। অথচ
(ক) স্থবিরতা বা রপ্তানি মূল্য হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি;
(খ) পুরাতন যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস;
(গ) শ্রমিক সমস্যা;
(ঘ) বহুবিস্তৃত দুর্নীতি;
(ঙ) অদক্ষ ব্যবস্থাপনা
এই সমস্যা গুলি আমরা সমাধান করতে পারছি না । আর করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি না।
অন্যদিকে দেশের বেসরকারি পাট খাতে ভালো সময় চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পাট ও পাটপণ্য রপ্তানিতে আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। এর মধ্যে পাটকলগুলোর উৎপাদিত মূল পণ্য পাটসুতা ৩৩ শতাংশ এবং চট ও বস্তা রপ্তানি ৬ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানির ৮০ শতাংশই বেসরকারি পাটকলের দখলে। লোকসান ও অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি পাটকলগুলো প্রায়ই শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারে না। অবিক্রীত পণ্য গুদামে পড়ে থাকে। অথচ আমাদের দেশে পাটের বাজার জমজমাট।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাঁচা পাট উৎপাদন ছিল ৭৫ লাখ ৫ হাজার বেল। যা পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে ছিল যথাক্রমে
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৫ লাখ বেল,
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৮ লাখ ৮৯ হাজার,
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯২ লাখ বেল এবং
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৭৩ লাখ ১৫ হাজার বেল।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাট খাতে বিশেষ করে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় ছিল ৬ হাজার ৪১৮ কোটি ৭২ টাকা।
যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটি আরও বেড়ে ৭ হাজার ৬৮৩ কোটি ৩২ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯৬ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয় ৬ হাজার ৭৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা।এছাড়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাটজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় ছিল ৫ হাজার ৬০২ কোটি টাকা, পরের বছর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৬ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ হাজার ৪৩০ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬ হাজার ৮০১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ২২০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
বাংলাদেশে ৯০ দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে প্রায় ৩০-৪০ বছর পাটের এলাকা কমতে কমতে ৪.০-৪.৫ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির সাথে সাথে গত ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত পাট চাষের এলাকা বৃদ্ধি প্রায় ৭-৮ লাখ হেক্টরে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। মোট শ্রমশক্তির প্রায় ১২ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে পাট উৎপাদনের কাজে। পাট শিল্পে জড়িত আছেন ১ লাখ ৬২ হাজার শ্রমিক। জিডিপিতে পাট খাতের অবদান ০.২৬ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে ১.৪ শতাংশ ।
তুলনামূলক বিচারে পাট থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় হ্রাস পেলেও বিশ্ববাজারে এখনও বাংলাদেশী পাটের আধিপত্য বিরাজমান। বাংলাদেশী কাঁচাপাট প্রধানত রফতানি করা হয়, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরিকোষ্ট, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে। আমাদের কাঁচাপাট আমদানির বেলায় পাকিস্তান, চীন ও ভারত শীর্ষ অবস্থানে করছে
অপরদিকে পাটজাত পণ্য রফতানি হয় ইউরোপ, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, সিরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রে। পাটজাত দ্রব্য আমদানির বেলায় ইউরোপ ও তুরস্কের স্থান সবার শীর্ষে। তার অন্যতম কারণ পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী এখন নিরুৎসাহিত করছে পরিবেশবাদীরা, পলিথিন ও সিনথেটিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অপরদিকে পাট পরিবেশবান্ধব। তাই এর চাহিদা বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। এক সময় সিনথেটিকের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গিয়েছিল পাট। এখন পরিস্থিতি পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। তাই পাটের ক্রমবিকাশমান আন্তর্জাতিক বাজার ধরার জন্য আমাদের খুবই তৎপর হওয়া প্রয়োজন।
বর্তমানে পাটকলসমূহে হেসিয়ান, স্যাকিং, সিবিসি, ব্লাংকেট, এবিসি (জিওজুট), উন্নতমানের পাটের সূতা, বিভিন্ন প্রকরণের ডাইভারসিফাইড জুট ব্যাগ ও কাপড় (ফাইনার জুট ফ্যাব্রিক, ইউনিয়ন জুট ফ্যাব্রিক, ইউনিয়ন ক্যানভাস) এবং পাটের বহুমুখী পণ্য যেমন-ফাইল কভার, ফ্যাশন ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস হ্যান্ড ব্যাগ,সেভিং কিটস, নার্সারি পট, নার্সারি সিট, জুট টেপ, কুশন কাভার, পর্দা ও কাপড়, ব্লিচড ও বিভিন্ন ও রঙ্গিন কাপড় ইত্যাদি ছাড়াও রটপ্রুফ পাটের কাপড় এবং কাপড় দ্বারা রটপ্রুফ পাটের কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি উৎপাদিত হয়।
বর্তমানে পাটের চাহিদা বাড়ছে অথচ সরকার তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না । উন্নত জাতের পাট চাষ যেমন কাঁচা পাটের উৎপাদন বারাবে তেমনি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে । তাই পাট ও পাট শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র: পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় , বিবিসি , কালের কন্ঠ, প্রথম আলো, সহ আরো কিছু পত্রিকা।
Written by:
Md. Abir Hasan
BGMEA University of Fashion and Technology
Batch: 201
Department: Textile Engineering