ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস এবং নদীর পানির গুণমানের অবনতি বাংলাদেশের জন্য এক উদ্বেগজনক সমস্যা। পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সর্বাধিক বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী শিল্প খাত হলেও এটিই বার্ষিক পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। তুলা থেকে কাপড় তৈরি হয়ে আমাদের হাতে আসা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আসতে হয় এবং এর প্রতিটি ধাপে প্রচুর পানির ব্যবহার হয়ে থাকে। আমরা আজ জানতে চেষ্টা করবো বস্ত্রশিল্পে মূলত কোথায় কোথায় পানির ব্যবহার হয়, এই ব্যবহৃত পানি কি করা হয় এবং এই পানি পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব কিনা।
বস্ত্রশিল্পে পানির ব্যবহার শুরু হয় স্পিনিং মিলে যেখানে তুলা থেকে সুতা তৈরি হওয়ার পর সেই সুতা পরিষ্কার এবং সুতা রঙ করা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশী পানির ব্যাবহার হয় যেকোনো কম্পোজিট কারখানায় (যেসকল কারখানায় তুলা থেকে সুতা এবং সেখান থেকে তৈরি পোশাক পর্যন্ত বানানো হয় তাকে কম্পোজিট কারখানা বলে) যেখানে ধূসর কাপড়গুলি ব্লিচ করা হয় (পরিষ্কার করার জন্য), সেগুলোকে রঙ করা হয় এবং একটি তৈরি পোশাক (টি-শার্ট, জিনস ইত্যাদি) বানানোর পরে ধৌত করা হয়। একটি পোশাক তৈরিতে ঠিক কতটা পানির প্রয়োজন হয় সেটা জানতে নিচের তালিকাটি আমরা লক্ষ্য করে দেখতে পারি।
তো দেখা যাচ্ছে যে স্পষ্টতই পোশাকশিল্পে প্রচুর পরিমাণে পানি ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) এক রিপোর্ট অনুযায়ী বস্ত্রশিল্পে প্রতিদিন প্রায় ৪১১ কোটি লিটার পানি এবং বছরে প্রায় ১৫০০ বিলিয়ন লিটার পানির দরকার হয়। এই পরিমাণ পানি দিয়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষের সারাবছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব।
প্রতিনিয়ত এই পরিমাণ ব্যবহারের ফলে প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ২.৫ শতাংশ হারে নীচে নেমে যাচ্ছে। এই পানি অনেক ক্ষেত্রেই অপরিশোধিত অবস্থাতেই নদী-নালা বা খালে ফেলে দেওয়া হচ্ছে যা সেসকল পানির উৎসকে দূষিত করছে। টঙ্গীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ নদী ইতিমধ্যে এই দূষণের কারণে আজ মৃতপ্রায়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কার্যকরী সমাধান হচ্ছে পানির ব্যবহার কমানো, পানির পুনঃব্যবহার এবং নদী-নালায় পানি ফেলে দেওয়ার আগে পানি পরিশোধন। শিল্প কল-কারখানায় পানি ব্যবহারের পর নদী-নালায় পানি ফেলে দেওয়ার আগে পরিশোশধন করতে হয়। এই পরিশোধিত পানি অনেক ক্ষেত্রেই পুনঃব্যবহার করা সম্ভব।
বর্তমানে দেশে বেশ কিছু পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে যারা কার্যকরী উপায়ে পানির ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছে। সেই সাথে তারা ব্যবহৃত পানি পরিশোধনের পর তা পুনঃব্যবহারের চেষ্টা করছে এবং নদী-নালায় পানি ফেলে দিলে তার দূষণ যেন সহনীয় মাত্রায় থাকে তারও চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশের বেশ নামকরা কিছু প্রতিষ্ঠান যেমনঃ ফকির অ্যাপারেলস (যারা প্রায় ৭০ শতাংশ পানির ব্যবহার কমিয়েছে), মন্ডল ফেব্রিকস (যারা প্রায় ২৭ শতাংশ পানির ব্যবহার কমিয়েছে) এরা অন্যতম।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর সকল শিল্প কল-কারখানার জন্য পরিবেশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট প্রদান করার সময় পানিদূষণ রোধে সেই প্রতিষ্ঠানের কি পরিকল্পনা রয়েছে সেটা জমা দিতে বাধ্যতামূলক করেছে। এমনকি প্রতিবছর এই সার্টিফিকেট পুনরায় ইস্যু করার সময়ও এই পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। তারা একে বলছে 3R Plan, যার মানে হচ্ছে Reduce, Reuse and Recycle। অর্থাৎ পানির ব্যবহার কমানো, পানির পুনঃব্যবহার এবং পানি পরিশোধন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এসম্পর্কে স্পষ্ট নীতিমালা না থাকায় এখনও অনেক শিল্প কারখানা নিয়ম নীতিমালার ফাঁকফোকরে সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা না থাকা সত্ত্বেও তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আসন্ন ভবিষ্যতে পানি সংকট নিরসনের কথা মাথায় রেখে সরকার এবং বেসরকারী সংস্থাগুলো আরও কঠোর, জোরদার এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে এটাই আমাদের আশা।
লেখকঃ
মোঃ খালেদ হাসান মোরশেদুল বারী
ডিপার্টমেন্ট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।