কাপড় তৈরীর জন্য সূতা প্রয়োজন। স্পিনিংয়ের পর এতেই তৈরি হয় ইয়ার্ন বা সুতা। সূতা তৈরীতে কাঁচামাল হিসেবে যে সব তন্তু বা আশঁ ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে টেক্সটাইল ফাইবার বলা হয়। সুতা থেকে বয়নশৈলীর মাধ্যমে তৈরি হয় কাপড়।
টেক্সটাইল ফাইবারের কতগুলো বিশেষ গুণাবলি থাকা প্রয়োজন যেমন-পাকানোর জন্য ন্যূনতম দৈর্ঘ্য, শক্তি, কমনীয়তা, নমনীয়তা, সমতা, আর্দ্রতা, ধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি অন্যতম।তবে একই ফাইবারে সব গুণাবলী থাকে না।ইদানিং উন্নততর পদ্ধতিতে ফাইবারকে স্পিনিং ছাড়াই পাশাপাশি সাজিয়ে কিংবা রাসায়নিক বা তাপীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে টেক্সটাইল সামগ্রী তৈরী করা হচ্ছে। সে কারণেই একই ফাইবার সকল গুণাবলীও সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়। টেক্সটাইল ফাইবার প্রধানত দুই ধরনের- ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক এবং আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম। শেষেরটাকে আবার ম্যানুফ্যাকচারড্ ফাইবারও বলে। ফলে সুতা হয় দুই ধরনের।
তবে বর্তমানে কৃত্রিম সুতায় বিভিন্ন রাসায়নিক সংমিশ্রণের কারণে কাপড় তৈরির মহাযজ্ঞে দূষিত হয়ে পড়ছে বিশ্বপরিবেশ। সিনথেটিক ফাইবার বা ফেব্রিকের ধ্বংসাবশেষ সহজে পচে না। উপরন্তু এটি তৈরি করতে গিয়ে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যহানি একই সঙ্গে ঘটছে। অন্যদিকে, ন্যাচারাল ফাইবার সহজে পচনশীল। ফলে এটা পরিবেশবান্ধব ও শরীরসম্মতও বটে। যেকোনো অবস্থায় ন্যাচারাল ফাইবারই সবচেয়ে আরামদায়ক। শিল্পদূষণে সরাসরি প্রভাবিত পরিবেশে উৎপাদন ব্যাহত হবার কারণে ন্যাচারাল ফাইবার অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। ফলে টেক্সটাইল কারখানার মালিকরাও বাধ্য হয়ে কৃত্রিম ফাইবারের দিকে ঝুঁকে পরছেন।
ন্যাচারাল ফাইবার প্রধানত চার শ্রেণির- সেলুলোজ, রাবার, মিনারেল ও প্রোটিন। সেলুলোজ ফাইবারের মধ্যে রয়েছে সিড হেয়ার, কটন, কেপক। এই শ্রেণিবিভাগে অন্যগুলো হচ্ছে লিনেন, রেমি, পাট, হেম্প, বাস্ট, কেনাফ, কয়্যার, সিস্যাল, পিন, সয়াবিন, কর্ন ইত্যাদি।
সেলুলোজ ফাইবার মূলত গাছের আঁশজাতীয়, যা কোনো ছোট বা বড় গাছের বাহ্যিক অংশ থেকে সংগৃহীত হয়। শ্রেণিবিভাগে এরপরই প্রোটিন ফাইবারের স্থান, যা পোকামাকড় ও জীবজন্তুর শারীরবৃত্তীয়। অর্থাৎ শরীরের অংশ থেকে সংগৃহীত হয়। প্রোটিন ফাইবারের শ্রেণিবিভাগে রয়েছে অ্যানিমেল হেয়ার, উল, ক্যাশমেয়ার, ক্যামেল, মোহেয়ার, আলপাকা, লামা, হুয়ারিজু, ভিকুনা, গুয়ানাকো, চিয়েনগোরা (কুকুরের লোম), অ্যাঙ্গোরা (খরগোশ), ইয়াক, স্পাইডার সিল্ক ও সিল্ক।
ন্যাচারাল সেলুলোজিক ফাইবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে কটন বা সুতি, লিনেন ও পাট। তারপর রয়েছে রেমি। এগুলোর সঙ্গে আমরা পরিচিত। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, জুটের ভিসকস ফাইবার আবিষ্কৃত হয়েছে আমাদের দেশে। এর মধ্য দিয়ে ন্যাচারাল ফাইবারের আরেকটি ধারা যোগ হয়েছে বিশ্বব্যাপী। ফলে সম্ভব হবে আরও বহুগুণ বেশি পাটপণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা। প্রকৃতিতে জন্মে এমন সব গাছ, ফুল প্রাণী খনি ইত্যাদি থেকে আহরণ করা হয় বলে এসব কে প্রাকৃতিক ফাইবার বলা হয়। প্রাকৃতিক ফাইবার এর মধ্যেও শ্রেণীভেদ আছে। যেমন উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ ও খনিজ।
আমাদের কৃষি অর্থনীতির জন্য দারুণ সুখবর বয়ে আনছে ন্যাচারাল ফাইবার। কৃষির উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে আবিষ্কৃত হচ্ছে একের পর এক ন্যাচারাল ফাইবার। এমন অনেক কিছুই আমাদের চারপাশে রয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে আমরা জানি না; অথচ সেসব থেকে কত চমৎকার উপকরণ বের হতে পারে। যেমন ধইঞ্চা গাছ। পাটের বিকল্প হিসেবে ধইঞ্চা চাষে লাভবান হচ্ছেন কৃষক এবং এ গাছ থেকে ন্যাচারাল ফাইবারও তৈরি হচ্ছে। ফলে ধইঞ্চা শব্দটি অবজ্ঞাসূচক থাকছে না। কারণ, এই উদ্ভিদ থেকে জ্বালানি, সবুজ সারের পর এখন উৎপাদিত হচ্ছে ন্যাচারাল ফাইবার। আবার আফ্রিকান ধইঞ্চা গাছ কীটনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সোনালি আঁশ ন্যাচারাল ফাইবার হিসেবে সারা বিশ্বে নতুনভাবে পরিচিতি লাভের দ্বারপ্রান্তে। এর কাছাকাছি ন্যাচারাল ফাইবার হিসেবে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে ধইঞ্চা গাছের ফাইবার। পাটগাছ যেভাবে জাগ দিয়ে আঁশ বের করা হয়, ধইঞ্চা আঁশও সেভাবে বের করা হয়। পরিমাণে পাটের মতো না হলেও এর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ধইঞ্চা গাছের ন্যাচারাল ফাইবারের রঙ হচ্ছে রুপালি। ন্যাচারাল বাস্ট ফাইবারের মধ্যে পাটের মানসম্পন্ন আঁশের মতো ধইঞ্চার আঁশও মানসম্পন্ন করা যাবে, যদি যথাযথ উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদি তা হয়, বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত হবে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ। ধইঞ্চা ফাইবার কিছু অংশে পাটের তুলনায় ভালো। যেমন- ফাইবারের দৈর্ঘ্য, আণবিক বিন্যাস, দৃঢ়তা, স্থায়িত্ব, ঘর্ষণ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ময়লা রোধের ক্ষমতা, পরিচ্ছন্নতা। তবে পাটের সহায়ক হিসেবে ধইঞ্চা ব্যবহার করার সুযোগ আছে। পাটের জিন গবেষণা ও উন্নয়নে যেমন বিজ্ঞানীরা সাফল্য এনেছেন, তেমনি ধইঞ্চার জিন নিয়ে গবেষণা এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে বৈপ্লবিক কিছু ঘটানো সম্ভব।
তথ্য ও ছবিঃ উইকিপিডিয়া।
Writer Information
বাঁধন মজুমদার
জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
নিটার ১০ম ব্যাচ