তৈরী পোশাক খাত আমাদের গর্বের একটি অংশ। এই খাতের মাধ্যমেই “মেইড ইন বাংলাদেশ” ট্যাগটি পরিচিতি পেয়েছে বিশ্ব দরবারে। ২য় বা ৩য় যে অবস্থানেই থাকুক না কেন আমাদের রপ্তানী আয়ের শতকরা ৮৩ ভাগের যোগানদাতা এই একটি মাত্র সেক্টর। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা। ৬০ এর দশকে রিয়াজ গার্মেন্টেস নামের ছোট্ট একটি দর্জি দোকান থেকে আজকে প্রায় ৪০০০+ পোশাক কারখানায় বিস্তৃতি লাভ করেছে আমাদের পোশাক শিল্প। বিশ্বের ২৫ টি পরিবেশবান্ধব গ্রীণ ফ্যাক্টরির ৭ টিই বাংলাদেশের। শিল্পে সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশ,বাড়ছে প্রবৃদ্ধি। এত এত সমৃদ্ধির পড়েও ঠিক কোথায় যেন আমরা পিছিয়ে। এই যে সাফল্য আসে যাদের হাত ধরে, তারা কিন্তু বরাবরই অবহেলার স্বীকার। না পেয়েছে বিচার আর না অধিকার। যাদের হাত ধরে ” মেইড ইন বাংলাদেশ ” ট্যাগটি আমাদের হলো। বলছিলাম তাদের কথা, পোশাক খাতে কর্মরত অসংখ্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জীবন গাথা।আমরা শুধু মুদ্রার একপিঠই দেখেছি। চাঁদের কলঙ্কের মতো আমাদেরও কিছু কলঙ্কজনক অধ্যায় আছে পোশাক শিল্পকে ঘিরে। আজকের পর্বে আমরা সেগুলোই জানবো
ফিরে দেখা, তাজরীন গার্মেন্টেসে অগ্নীদগ্ধ জীবিত লাশের আর্তচিৎকার কিংবা রানা প্লাজার কংক্রিটে চাঁপা পড়া আহতদের বাঁচার আকুতি মনে পড়ে বাংলাদেশ?৮ ঘন্টা বা তারও অধিক সময় কাজ করে ৮/১৫ হাজার টাকায়, টাকার শহর ঢাকায় টিকে থাকা যে কতটা মুশকিল তা আমরা সকলেই জানি। তারপরও শুধু পরিবারের কথা ভেবে সব সয়ে যায় নিরবে। কিন্তু পোশাক খাতে ঘটে যাওয়া একেকটি দূর্ঘটনায় শুধু তাদের দেহই চাপা পড়েনি, চাপা পড়েছে তাদের স্বপ্নগুলোও। একের পর এক দূর্ঘটনায় পরিবার হারাচ্ছে তাদের স্বজন, আর আমরা হারাচ্ছি একেক জন দক্ষ শ্রমিককে। প্রতিটি দূর্ঘটনার পেছনের কারণ, অনিয়ম আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। চলুন ফিরে দেখা যাক বিগত ৩ দশকে ঘটে যাওয়া এমনই কিছু দূর্ঘটনা।
১. ১৯৯০ঃ এবছর ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টস অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ২৭ জন শ্রমিক।
২. ১৯৯৬ঃ রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে লুসাকা এ্যাপারেলস এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মারা যান ১০ জন শ্রমিক।
৩.১৯৯৬ঃ এবছর ঢাকার ২ টি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ২৮ জন শ্রমিক। এর মাঝে তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটেডে ১৪ জন।
৪. ১৯৯৭ঃ মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ হারায় ২৭ জন শ্রমিক। একই বছরে রহমান এন্ড রহমান এ্যাপারেলস এ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান আরো ২২ জন।
৫. ২০০০ঃ ২৫ ই নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিঃ এ অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারায় ৫৩ জন শ্রমিক, হতাহতের দিক থেকে তখন পর্যন্ত সেটিই ছিলো সবথেকে বড় দুর্ঘটনা। একই বছরে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিঃ এ প্রাণ হারায় ১২ জন, এখানেও অগ্নিকান্ড।
৬. ২০০১ঃ ৮ই আগষ্ট মিরপুরে মিকো সোয়েটার লিঃ এ আগুন লাগার গুজবে পদদলিত হয়ে মারা যান ২৪ জন শ্রমিক। একই বছর মিরপুরের কাফরুলে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগলে প্রাণ হারায় ২৬ জন।
৭. ২০০৪ঃ এ বছর ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে একটি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ হারায় ৪৮ জন শ্রমিক।
৮. ২০০৫ঃ ৭ই জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জের শান নিটিং এ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ২২ জন। একই বছর সাভারের স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ এ ভবন ধসে নিহত হন ৬৪ জন শ্রমিক।
৯. ২০০৬ঃ ২৪ শে ফেব্রুয়ারী তেজগাঁও ফিনিক্স গার্মেন্টস এ ভবন ধসের ঘটনায় প্রাণ হারায় ২১ জন শ্রমিক। একই বছর চট্টগ্রামের KTS Textile Ltd. এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ হারায় আরো ৬৫ জন শ্রমিক।
১০. ২০১০ঃ এবছর ফেব্রুয়ারীতে গাজীপুরের গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার এ ২১ জন শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। একই বছরের ১২ই ডিমেম্বর হামীম স্পোর্টসওয়্যার এ অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ২৪ জন, আহত শতাধিক।
১১. ২০১২ঃ ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টস এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রাণ হারায় ১১২ জন শ্রমিক ২০১২ সাল পর্যন্ত এটিই ছিলো সব থেকে বড় দূর্ঘটনা যেখানে নিহতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যায়।
১২. ২০১৫ঃ মিরপুরের স্টাইরোফোম প্যাকেজ ফ্যাক্টরিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ১৩ জন শ্রমিক।
১৩.২০১৯ঃ গাজীপুরের মাল্টি ফ্যাবস গার্মেন্টস এ অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ১৩ জন, আহত ৪৭।
১৪. ২০১৩ঃ ২০১৩ সালকে পোশাক খাতের বিভীষিকাময় সময় বলা হয়। পর পর ৪ টি দূর্ঘটনায় নিহত হয় ১৫০০+ শ্রমিক, আহত অসংখ্য। এবছর ২৬ শে জানুয়ারী মোহাম্মদপুরে স্মার্ট এক্সপোর্ট এ আগুন লেগে মারা যায় ১২ জন। মে মাসে রাজধানীর দারুস সালামে তুং হাই সোয়েটারে ৭ জন এবং অক্টোবরে গাজীপুরের শ্রীপুরে আসওয়াদ কম্পোজিট এ অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ৭ জন শ্রমিক।
৪ এপ্রিল ২০১৩, স্তব্দ হয়ে যায় পুরো দেশ, কোথাও কোন শব্দ নেই স্বজন হারানোর আহাজারি ছাড়া। এ এক মর্মান্তিক দৃশ্য,বলছিলাম সাভার ট্র্যাজেডির রানা প্লাজা ধ্বসের কথা। একযোগে সমাধি হয়েছিলো ১১৩৪ জন শ্রমিকের। বেসরকারি মতে নিহতের সংখ্যা আরো বেশী। হতাহতের দিক থেকে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম শিল্প দূর্ঘটনা এটি। আর বাংলাদেশে প্রথম। দূর্ঘটনা পরবর্তী ঘটনাগুলো আরোও বেশী রোমাঞ্চকর। উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে দেখা গেলো, আমাদের নেই বলতে তেমন কিছুই নেই সরঞ্জাম। স্যালাইন আর হ্যাক ‘শ’ ব্লেডের জোগান দিতে গিয়ে যথারীতি ঘাম ছুটাতে হয়েছে সাধারণ জনগণের। যদিও দূর্টনার কিছুদিন পূর্বেই ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তারপরও মালিক পক্ষের হুমকির মুখে চাকরি বাঁচাতে কাজে যোগ দেয় শ্রমিকেরা। এটাই যে জীবনের শেষ কর্মদিবস হতে যাচ্ছে ক্ষুণাক্ষরেও তা টের পায়নি কেউ। এটাকে দূর্ঘটনা না বলে গণহত্যা বললেও ভুল হবে না। কোথায় সেই বিচার, কোথায় তাদের পুনর্বাসন?যারা যুগ যুগ ধরে জুগিয়েছে আমাদের বসন তাদের কথা আসলেই সবাই নিরব হয়ে রয় এখানে।
রানা প্লাজা ধ্বসের পরই টনক নড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তুপক্ষের। ঘটনার পূর্বেই যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যেত, তবে বেঁচে যেত অনেকগুলো প্রাণ। দূর্ঘটনা পরবর্তী সময়টা জাতীয় অর্থনীতির জন্য অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং ছিলো। ক্রেতা দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ খুব একটা সহজ ছিলো না তা বলাই বাহুল্য।
শেষ করব, অর্থনীতিবীদ অধ্যাপক এম এম আকাশ স্যারের উক্তি দিয়ে। যিনি পোশাকশিল্পের বর্তমান অবস্থাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন ” স্যালাইন বা ভর্তুকি দিয়ে টিকে রাখার মতো পর্যায়ে নেই এই সেক্টর, বিগত ১ দশকে কৈশোর থেকে সোনালী তারুণ্যে উপণীত হয়েছে আমাদের পোশাক শিল্প “।
শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত হচ্ছে দিনকে দিন। নতুন কোন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক তা চাই না। প্রতিটি প্রানই মূল্যবান তার পরিবার কিংবা এই সেক্টরের জন্য। বেঁচে থাকুক পোশাক শিল্প টিকে রাখা প্রতিটি স্পন্দন।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিবিসি নিউজ, প্রথম আলো, ডেইলি বাংলাদেশ।
Writer Information:
Ahmmed Ronju
Apparel Engineering 1st Batch
Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College
Pirganj, Rangpur.