দেশের সর্বত্র এখন কমবেশি একটি চিত্র আমাদের সবার চোখেই পড়ে, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পথশিশু আর ছিন্নমূল মানুষ রাস্তা বা উদ্যান থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করছেন। বাহিরে চলাচলের সময় তৃষ্ণার্থে আমরা ‘মিনারেল ওয়াটার’ হিসাবে পানির বোতল কিনে পানি খেয়ে থাকি। সাধারণভাবে ওই বোতলগুলি একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। এই ফেলে দেওয়া বোতলগুলো তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন কারখানার মালিক অথবা ব্যবসায়ীরা। যা তারা যন্ত্রে কুচি কচি করেন এবং অতঃপর ওই কুচি রপ্তানি করা হয়। কিছু মানুষের পেশায় পরিনত হওয়া এই বিষয়টি থেকে তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের আপার সম্ভাবনা। চীন এককালে এই ফেলনা বোতল রপ্তানির প্রধান বাজার হলেও তা এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত এখন আমাদের প্রধান গ্রাহক। এ ফেলনা বোতল রপ্তানির মাধ্যমে বছরে দুইশ কোটি টাকা আয়ের উৎসের সৃষ্টি হয়েছে। এইসব বোতল দিয়ে আমদানিকারক দেশের কারখানায় নানা পন্য তৈরি হচ্ছে। এর মধেয অন্যতম এবং বিশেষ একটি উদ্যোগ হচ্ছে প্লাস্টিক বোতল থেকে তুলা তৈরি।
যে কোন উন্নত টেক্সটাইলভিত্তিক দেশের পোশাক খাতে বার্ষিক তুলার চাহিদা অনেক বেশি হয়ে থাকে। তুলার অভাব পূরনে প্লাস্টিকের বোতল থেকে তুলা উৎপাদন এবং তা থেকে সুতা তৈরির মাধ্যমে গেঞ্জি, জার্সি, ট্রাউজার এবং ব্লেজারের মতন দামি কাপড়ে ব্যবহার করছে উন্নত দেশগুলো। গবেষকদের মতে, পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়গুলো সবচেয়ে বেশি টেকসই কাপড় হয়ে থাকে। এছাড়াও নতুন ফাইবার তৈরির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের যে প্রয়োজন হয় তা এই পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপড়ে ব্যবহার হয় না। এরফলে প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ থাকে।
যেভাবে প্লাস্টিকের বোতল থেকে জামা তেরি হচ্ছে- নিম্নআয়ের মানুষদের সংগ্রহ করা বোতল নিয়ে ব্যবসায়ীরা বড় বড় মেশিনের মাধ্যমে এগুলো ছোট করে কেটে ফ্লেক্স তৈরি করেন। এর পর গরম পানি দিয়ে সেই ফ্লেক্স ধোয়া হয়। উচ্চ তাপ ও চাপে সেই ফ্লেক্স আট ঘণ্টা বায়ু নিরোধক ড্রামে রাখা হয়। ভ্যাকুয়াম ড্রামে তাপ দেয়ার পর তৈরি হয় পেস্ট। সেই পেস্ট স্পিনারেট দিয়ে স্নাইবার করা হয়। এর পর তা সূক্ষ্ম সুতার আকারে বেরিয়ে আসে। ওই সুতা আবার বিভিন্ন আকারে কাটিং করে মেশিনে ঢোকানোর পর পলিয়েস্টার স্ট্যাপল ফাইবার (পিএসএফ) হিসেবে সাদা তুলা বেরিয়ে আসে।এ থেকে সুতার মতো যে বর্জ্য বের হয় সেটিও আবার রিসাইকেল পদ্ধতিতে তুলা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। উৎপাদিত তুলা বাজারে বিক্রি করা কার্পাস তুলার মতোই মোলায়েম ও মসৃণ। এই তুলা থেকে শেষে বিভিন্ন প্রসেসিং এর মাধ্যমে সুতা। সবশেষে সেই সুতা থেকে বিভিন্ন রং এর জামা তেরি করা হয়। ধারণা করা হয়, একটি টি-শার্ট তৈরি করতে প্রায় ৯টির মতন প্লাস্টিকের বোতল প্রয়োজন হয়।
জানা গেছে, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে রিসাইকেল পদ্ধতিতে তুলা তৈরিতে ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা হয়েছে। ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের পানিয়াশাইলে চীনা প্রযুক্তির একটি কারখানা তৈরি হয়েছে। মুমানু পলিয়েস্টার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কারখানাটিতে কয়েক মাস ধরে প্লাস্টিক পেট বোতল দিয়ে দৈনিক ৪০ টন তুলা উৎপাদন করা হচ্ছে, যা আমাদের দেশ ছাড়াও চীন, ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ড সহ আরও অনেক দেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।
সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিতে সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন প্রযুক্তির কারখানাটি স্থাপনের পর কাঁচামাল সংগ্রহসহ দেশীয় বাজারে উৎপাদিত তুলার যথাযথ মূল্য না থাকায় এটি অলাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে সরকার পেট বোতল ফ্লেক্স রফতানিতে ১০ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিচ্ছে।
গবেষকরা জানান এই পৃথিবীর মাত্র ১১% প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতি বছর প্লাস্টিক বোতল থেকে ফাইবার তৈরি করে আমরা সেই শতাংশকে আরও বাড়াতে পারি। যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতেও কাজে দিবে।
নাজমুল ইসলাম নিরব
ডিপার্টমেন্ট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়াং
জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (নিটার)
১০ম ব্যাচ