ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির একটি ফ্রান্স। এই দেশ দেখতে যেমন সুন্দর সেই সাথে এটি তার নিজের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির জন্যও বিখ্যাত। আয়তনের দিক থেকে ফ্রান্স ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তর রাষ্ট্র আর অন্যদিকে জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র। ফ্রান্সের এর পাশাপাশি তারা তাদের নিজস্ব ফ্যাশনের জন্য বিশ্বের মাঝে শ্রেষ্ঠ।
বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো জাতি আর রাষ্ট্রের মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। প্রাচীন থেকে প্রাচীন সব ধরনের নিদর্শন পাওয়া যায় এই দেশে। ফ্রান্সের রাজধানীর নাম প্যারিস। বলা হয় রূপের আর সৌন্দর্যের অপার এক নিদর্শন হচ্ছে প্যারিস। ফ্রান্সের প্যারিস কে বলা হয় ফ্যাশন এর রাজধানী। এছাড়া ইউরোপীয় দেশ গুলার মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্য সচেতন আর পরিষ্কার পরিছন্ন দেশ হচ্ছে ফ্রান্স। এসব কিছুর পাশাপাশি এটি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী আর সুশিক্ষিত একটি জাতি। ফ্রান্সের মানুষ সংস্কৃতিমনা হয়ে থাকে। মূলত পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ফ্রান্স।ফরাসি সংস্কৃতি পৃথিবীর কাছেই বিখ্যাত। শিল্পকলা, সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, নৃবিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানের উন্নয়নে ও প্রসারে ফ্রান্সের সংস্কৃতি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এই জন্মভূমিতে বিরাজ করছে হাজারো দুনিয়া বিখ্যাত ব্যক্তি বর্গ মধ্যযুগ থেকেই প্যারিস কে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ধরা হয়। ফরাসি রন্ধন শিল্প ও পোষাক শিল্পের পণ্য (ফ্যাশন) বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফ্রান্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই সংস্কৃতিময় এই জাতি তাদের ফ্যাশনকে নিয়ে গিয়েছে বিশ্বের দ্বার প্রান্তে। ফ্যাশনের দিক থেকে পশ্চিমা পোশাকেই নিজেদের সাজাতে পছন্দ করেন। ফ্রান্সের মেয়েদের কাছে শরীরের সাথে আঁটসাঁট করে পরা পোশাক বেশি পছন্দ। তাছাড়া তারা পোশাকের উপরে কোটি পরতে ভালোবাসে। আর সপ্তাহের অন্তত একটি দিন তারা শার্ট এবং জিন্স পরে । অফিসিয়াল কাজের জন্য ক্যাজুয়াল পোশাক পরে থাকে। তারাই মূলত তাদের পোশাক নির্বাচন করে তাদের কাজের উপর নির্ভর করে। তাছাড়া কোনো অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তারা এক কালার এর কাপড় পড়তে পছন্দ করে। যেমন কালো রঙের শার্ট, প্যান্ট, কোট আর টাই পরতে ভালোবাসে আর এটাকে তাদের সম্মানের প্রতীক হিসেবে মনে করে।
১৮২৯ সালে ৮০ টি সেলাই মেসিন নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে বিশ্বের প্রথম গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি চালু হয়। যেখানে মিলিটারিদের ইউনিফর্ম তৈরি করা হত।
টেক্সটাইল শিল্প দীর্ঘকাল ধরে ফরাসি অর্থনীতিতে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করেছে। 17 তম শতাব্দী থেকে, কলবার্টের প্ররোচনায়, টেক্সটাইল সেক্টর কাঠামোগত এবং দ্রুত বিকাশ লাভ করেছিল, বিশেষত প্রদেশে। সেই সময়, 1665 এবং 1683 এর মধ্যে, জিন-ব্যাপটিস্ট কলবার্ট ছিলেন দেশীয় অর্থ (অর্থমন্ত্রী)।তারপর সে ফ্রান্সের রাজাদের সাথে মিলে এর ফলে পুরো ফ্রান্স জুড়ে শহর এমনকি গ্রামেও টেক্সটাইল শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটিয়েছিল। লোডেভ এবং রোমানস-সুর-ইসেরের মতো ছোট শহরগুলি প্রদেশে টেক্সটাইল শিল্পের প্রয়োগের উদাহরণ দেয়, যদিও লিওন এবং প্যারিসের মতো বড় শহরগুলিও টেক্সটাইল শিল্পের মূল চাবি কাঠি ছিল। লোডেভ ফ্রান্সের দক্ষিণে ল্যাঙ্গুইডোক-রাউসিলন অঞ্চলে হ্যারাল্টের ডিপার্টমেন্টের একটি ছোট শহর।
17 শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, কলবার্ট রাজকীয় অনুমোদনের সাথে একটি উলের কারখানা তৈরি করে লোডেভে। যার ফলে টেক্সটাইল শিল্পের বিকাশ করেছিলেন। এই শিল্পের বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে অনেক পরিবার নিয়ে ড্রেপারগুলি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
রেশম এর জন্ম এশিয়ায় হ
লেও , টেক্সটাইল মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে এক উন্নত বিকাশ লাভ করেছে। রাজা হেনরি চতুর্থ ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ল্যোনাইজ সিল্ক শিল্পের জন্য সস্তা সস্তা কাঁচামাল সরবরাহ করার জন্য এবং পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষত প্রোভেন্সে সিলিকালচার (রেশম চাষ) উন্নত ভাবে বিকাশ করেছিলেন। তারা রঙিন ফ্যাব্রিক তৈরি করে, তাদের 4 মিটার উঁচু রেশম স্পিনিং মেশিনে তাদের ছোট ছোট ওয়ার্কশপ-অ্যাপার্টমেন্ট এ কাজ করে। কাজের অবস্থার দিক দিয়ে একই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে এই শ্রমিকরা একটি শক্তিশালী এসপ্রিট ডি কর্পস গড়ে তুলেছিল।
1831 সালে, ফ্রান্স প্রচুর অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল তারপর থেকে রেশম এর ব্যবহার আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
তাছাড়া আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে পছন্দের কাপড় হচ্ছে ডেনিম। সেই ডেনিমের জন্ম কিন্ত এই ফ্রান্সে। ডেনিমের ইতিহাসঃ-
১৮৭০ সাল , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ছুটেছিল স্বর্ণে খোজার নেশায়। যা ইতিহাসে গোল্ড রাস নামে পরিচিত ।সেই সময় পুরো পশ্চিমা দেশ গুলোতে আবিষ্কৃত হচ্ছিল স্বর্ণের খনি। ঠিক তখনই মোটা সুতার বুননে তৈরী কাপড়ের নীল রঙের একটি প্যান্ট বাজারে ছেড়ে হুলস্থুল ফেলে দেয় LEVI’S নামের একটি ফরাসি প্রতিষ্ঠান। কর্মীদের কাছে পরিধেয় বস্ত্র হয়ে উঠে এই নীল জিন্স যার আরেক নাম ডেনিম। ফ্রান্সের নিমস শহরে সুতার মোটা বুননে এই কাপড় তৈরী হয় ১৫ শতকে। সেখান থেকেই মূলত এই ডেনিম নামের উৎপত্তি। তখন নাবিকরা এই কাপড়ের পোশাক পড়তেন। কিন্তু ডেনিম জনপ্রিয় হয় মূলত মার্কিন খনি শ্রমিকদের হাত ধরে। পপ সাম্রাজ্য বিরাজের সাথে সাথে আমেরিকার তরুণদের কাছে জিন্স হয়ে উঠে ফ্যাশনের অন্যতম একটি মাধ্যম। এভাবে ৬০ আর ৭০ দশক অতিক্রান্ত হয়। ৮০তে প্রথম ডিজাইনের জিন্স বাজারে আসে। এভাবে ডেনিম জায়গা করে নেয় ঝলমলে র্যাম্প আর ফ্যাশনের মূল ধারায়। এই বিবর্তনে প্যান্টের গন্ডি পেরিয়ে ডেনিম ছড়িয়ে পড়ে জ্যাকেট ও টি-শার্টে। যা কিনা এখন দুনিয়া বিখ্যাত পোশাক।
তাছাড়া ফ্রান্সের পোশাকের পাশাপাশি বিখ্যাত কিছু ফ্যাশন ডিজাইনার আছেন। যারা কিনা তাদের নিজেদের কে নিয়ে গেছেন ফ্যাশন জগতের সু-উচ্চ শিখরে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন এর নাম এবং তাদের তৈরি করা বিখ্যাত ফ্যাশন ব্যান্ড গুলো হলোঃ
১. কোকো চ্যানেল (১৮৮৩-১৯৭১)
কোকো ছিলেন এক বিখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার এবং সুপরিচিত চ্যানেল ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই একমাত্র ফ্যাশন ডিজাইনার যিনি টাইম 100 তে নামকরণ করা হয়েছিল শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে।
২. খ্রিস্টান ডায়ার
1905 সালে জন্মগ্রহণ, আইকনিক ফরাসি ডিজাইনার তার স্বতন্ত্র “নিউ লুক” সিলুয়েট জন্য খ্যাতিমান ছিল। 1947 সালে আত্মপ্রকাশ করা, খ্রিস্টান ডায়ার স্যুট এবং পোশাকগুলি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নারীদের পোশাক এবং ফ্যাশন বিবেচনা করার পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটায় । 2016 সালের জুলাইয়ে মারিয়া এবং গ্রাজিয়া চিউরির নামকরণ করে ডায়ারের সাত দশকের পুরুষ নেতৃত্বের প্রথম মহিলা শিল্পী পরিচালক হিসাবে । দুটি বছরে , প্রাক্তন ভ্যালেন্টিনো আর গ্রাজিয়া ইতিমধ্যে ফ্যাশন হাউসে অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলেছেন, ফ্যাশন হাউসের রাস্তা টিকে বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীবাদ এবং চারুকলার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
৩.থিয়েরি মুগলার
পাওয়ার স্যুট, চামড়ার মুখোশ এবং ভবিষ্যত বর্ম বানানোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। আজ তিনি মুগেলার মূলত সিরকু ডু সোলিল এবং বেওনসের সফরের পোশাক ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত । মুগলারের শীর্ষে বিক্রি হও
য়া পন্য এর মধ্যে অ্যাঞ্জেল ফ্রেগ্রেন্স তার খ্যাতির কিছু অংশে অবদান রাখে।
৪.পাকো রাবনে
তিনি একজন ফরাসি ডিজাইনার যিনি পোশাক ডিজাইনে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। ডায়ার, গিভঞ্চি এবং বালেন্সিয়াগার সাথে কিছু সহযোগিতার পরে রাবনে বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী এবং ফিল্ম বার্বেরেলার পোশাক ডিজাইনের জন্য জনসাধারণের কাছে পরিচিত লাভ করেন । শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ব্র্যান্ডটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং যদিও ফ্যাশন জগতে তার ইতিহাস জুড়ে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে, তিনি ফ্রান্সের ‘বোহেমিয়ান চিক’ লুকের অন্যতম প্রধান উদ্ভাবক রয়েছেন।
৫.নিনা রিকি
যদিও ইতালিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, প্যারিসে বসবাসকারী র্যাফিন এর সাথে কাজ করেন। তিনি সেই বাড়িতে ডিজাইনার এবং ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে 20 বছর কাজ করার পরে 49 বছর বয়সে পুত্র রবার্ট রিকির সাথে তার নিজস্ব ফ্যাশন হাউজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিনা রিকি ব্র্যান্ডটি ১৯৩০ এর দশক জুড়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল, এটি কেবল পোশাক-পরিধানের জন্যই নয়, চামড়ার পণ্য এবং ফ্যাশন আনুষাঙ্গিকগুলির জন্যও পরিচিত। 1949 সালে, তিনি ‘L’air du টেম্পস’ নামের আতর যা ব্র্যান্ডের সর্বাধিক বিখ্যাত পণ্য হিসাবে রয়েছে গেছে।
এই ব্রান্ড এবং ব্যক্তি বর্গ ছাড়া আরও অনেক বিখ্যাত ব্রান্ড এবং ফ্যাশন ডিজাইনার আছে যাদের নাম বললে হয়তো সারাদিন লেগে যাবে।
Source: Google, Wikipedia
Writer Information:
Afsar Uddin
Department of Textile Engineering
BGMEA University of Fashion & Technology(BUFT)