শিল্পায়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের বড় কারণ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক কাঠামোর পরিবর্তনে এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প ৫০০ বছরেরও বেশি পুরানো। সমৃদ্ধ ইতিহাস সহ এটি সবচেয়ে প্রাচীন ও সফল শিল্প গুলোর মধ্যে একটি। তবে ২০১৯ সালের শেষে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরে,যার প্রভাব বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্পে অনুভূত হয়েছে। কোভিড-১৯ উন্নয়নশীল এবং উন্নত উভয় দেশেই বিশ্বজনীন জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অবস্থান
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড এবং দেশের আয় এর প্রধান উৎস হলো আমাদের টেক্সটাইল শিল্প। আমাদের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি বিগত ২৫ বছর ধরে দেশের রপ্তানি বিভাগ এর মূল আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে পোশাকশিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা ৫৮২,০০০ ছিল এবং ১৯৯৯ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৪০৪,০০০জন। ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ চীনের পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক প্রস্তুতকারক ছিল। ২০০৬ সালে,চীন,ইউরোপীয়ন ইউনিয়ন,হংকং,তুরষ্ক এবং ভারতের পরে বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ রপ্তানিকারক দেশ ছিল। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বোনা পোশাকের বৃহত্তম বাজার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের বুনো পোশাক এর ৪৭% ই রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশ ৫৩.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এর পোশাক রপ্তানি করেছে, যা তাদের মোট পোশাক রপ্তানির ৫০%।
অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল খাত হওয়ার কারণ
বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন ট্রান্সফার অফ প্রোডাকশান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যেখানে উন্নত দেশ গুলো উন্নয়নশীল দেশ গুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো কিভাবে ব্যয় হ্রাস করে আউটপুট বাড়ানো যায়। আর এটি সম্ভব হবে, যখন এমন একটি দেশে উৎপাদন স্থানান্তর করা যাবে যেখানে শ্রমিকদের মজুরি এবং প্রোডাকশন কস্টিং কম হবে। আর উৎপাদনশীল দেশগুলোর মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি এবং প্রোডাকশন কস্টিং তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ঘন্টায় শ্রমিকদের মজুরি ১০.১২ মার্কিন ডলার,তবে তা বাংলাদেশে শুধুমাত্র ০.৩০ মার্কিন ডলার। তাই,উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর কাছে পোশাক তৈরি জন্য অন্যতম পছন্দ বাংলাদেশ,যার কারণ হলো শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি এবং লো প্রোডাকশন কস্ট।
এভাবেই উন্নত বিশ্বের দেশগুলো, তৃতীয়বিশ্বে তাদের উৎপাদন স্থানান্তর করে দেশগুলোর অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়তা করছে এবং তাদের নিজেদের অর্থনীতির ও গতিবৃদ্ধি করছে।
কোভিড-১৯ এর প্রভাব
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২রা মার্চ,২০২০থেকে সম্পূর্ণ দেশে লকডাউন ঘোষণা করেন, যা পরবর্তীতে ৩০মে,২০২০ অবধি অব্যাহত ছিল। লকডাউনের ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সরকারের লকডাউন নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ দ্বারা প্রভাবিত ক্রমবর্ধমান গ্লোবাল লকডাউনের কারণে পোশাক চালানের প্রকিয়াগুলো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। অনলাইনে ক্রয়ের চাহিদা বাড়লেও, অনেক ধরনের প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সরবরাহ চেইনগুলোর পক্ষে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় নি।
- ফলস্বরূপ, আরএমজি কর্মী সহ ~ 10 মিলিয়ন শ্রমজীবী লোকেরা ঢাকা থেকে তাদের নিজ শহরে ফিরে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, COVID-19 প্রতিরোধ সম্পর্কিত ব্যবস্থা যেমন- অন্যের থেকে ন্যূনতম নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা ও ব্যার্থ হয়েছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বজায় না রেখে বাস, ফেরি এবং ট্রেনে প্রচুর জনসমাগমের খবর পাওয়া গেছে, যা সংক্রমণের মাত্র আরো বাড়িয়ে দেয়। এতে করে তাদের স্বাস্থ্যঝুকির পাশাপাশি অর্থকষ্টের প্রভাব আরো বেশি লক্ষণীয়।
- কোভিড -১৯ মহামারী চলাকালীন বিশ্বে পোশাক সরবরাহের শৃংখলার উপর একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পরেছে।কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের থেকে বহুবার অর্ডার বাতিল হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশী সাপ্লাইয়ার্স দের থেকে ৩বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থমূল্যের পোশাকের অর্ডার স্থগিত করা হয়েছে। “মোজাইক ব্র্যান্ড” নামক একটি বৃহৎ অস্ট্রেলিয়ান সংস্থা ১৫মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছে।
- করোনাভাইরাস এর সেকেন্ড ওয়েভ যেমন ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়া পরেছে,তেমন ই এর প্রভাব বাংলাদেশ এর স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক সেক্টরে অনুভূত হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাপে পোশাক ক্রেতারা ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিল করেছিলেন। তাই গতবছরের কথা মাথায় রেখে, এইবছর বিক্রেতারা কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি পরিচালনা করছেন।
- ইউনিসেফ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পোশাক কারখানা গুলোতে পর্যান্ত পিপিই থাকলেও,তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাবহারের অনুপযোগী এবং নিম্নমানের। নূন্যতম ৩ ফুট সামাজিক দূরত্ব রাখার প্রবণতা ও লক্ষ্য করা যায় নি।
নারী স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে
বাংলাদেশে ৪.১মিলিয়ন আরএমজি কর্মীর মধ্যে বেশিরভাগ কর্মী ই নারী। এদের মধ্যে ১৮-৩০ বছরের নারীর সংখ্যা ই ৮০ শতাংশ। কেউ রয়েছেন গর্ভবতী, কেউ বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান,কিংবা কারো ১০বছরের কম বয়সী সন্তান রয়েছে। এছাড়া ও তারা সকলেই অতিরিক্ত জনবহুল এলাকায় বসবাস করে থাকেন। আবার তাদের কর্মস্থলেও ও যথেষ্ট জনসমাগম রয়েছে। যার ফলস্বরূপ,তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের মাস্ক রপ্তানিতে সাফল্য
কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন সময়ের প্রথম এগারো মাসে ফেইস মাস্ক রপ্তানি বেড়েছিল, যা থেমে যাওয়ার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পরিসংখ্যানের ডাটা অনুযায়ী,বাংলাদেশ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে ৯৫.৯মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মুখোশ রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে মার্কিন বাজারেই ৪০মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সার্জিকাল এবং কেএন 95 মাস্ক রপ্তানি হয়।এই সময়কালে, ফেইস মাস্ক গুলোর জন্য বিশ্ব বাজারে মূল্য ছিল ৬৫মার্কিন বিলিয়ন ডলার এবং চীন বিশ্ববাজারের শীর্ষে ছিল। কানাডা ১১মাসের সময়কালে ৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মাস্ক আমদানি করে, বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশী পণ্যের তৃতীয় আমদানিকারক দেশ।
পোশাক শিল্পে স্বাস্থ্যবিধির প্রয়োগ
পোশাক শিল্পের কারখানা গুলোতে দৈনন্দিন হাজার হাজার মানুষ এর সমাগম হয়ে থাকে। এই হাজার হাজার আগত মানুষ আবার কোনো না কোনো ভাবে আরো অনেক মানুষ এর সংস্পর্শে এসে থাকে যেমন- যাওয়া আসার পথে, জনবসতি তে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পোশাক শিল্প কারখানায় সংক্রমণের হার অত্যাধিক মাত্রায় বাড়ছে। কিন্তু কারখানার শ্রমিকরা কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে? এটাই প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক একটি রিপোর্ট এর সূত্র অনুযায়ী-
- ২০২০ সালের মে মাসে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার হার ছিল ৭৭%, যা ডিসেম্বর মাসে এসে ৫৬% হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- ৪২% শ্রমিক বলেছেন তারা সর্বদা মুখে মাস্ক ব্যবহার করে থাকেন।
- ১৭% শ্রমিক বলেছেন তারা ভীড় এড়ানোর চেষ্টা করে থাকে।
- উত্তরদাতাদের ১% বলেন,তারা কোনো নির্দেশনা মেনে চলেন না।
করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। করোনায় বাসায় বন্দী শ্রমিকদের কাজে গেলে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, তেমনই কাজে না গেলে রয়েছে অর্থকষ্ট। করোনা ভাইরাসের অনিয়ন্ত্রিত ব্যাপক বিস্তারের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে বড় ধরনেএ বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে, সেখানে বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে তার প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে সক্ষম,তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশ স্ট্যাটিস্টিক্স ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশেএ অর্থনীতিতে এখন শিল্প খাতের অবদান প্রায় ৩৫শতাংশ। তবে সবকিছুর উর্ধে, করোনা হতে পারে বাংলাদেশের জন্য শাপেবর। বাংলাদেশের তৈরি লো বাজেটের পণ্য রপ্তানি করে থাকে সাধারণত। সেক্ষেত্রে বিলাসী পণ্য কিংবা দামি ব্র্যান্ডের পোশাক রপ্তানি করা দেশ গুলোর তুলোনায় বাজার হারানোর আশঙ্কা কিছুটা হলেও কম।পোশাক রপ্তানি খাতে সবার প্রথমে চীন এবং দ্বিতীয় বাংলাদেশ। ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া সাধারণত কৃত্রিম পোশাক রপ্তানি করে থাকে। আর লো বাজেটের পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান। করোনার উৎপত্তিস্থল চীন হওয়ার কারণে অনেকেই তাদের অর্ডার সরিয়ে আনতে পারেন বাংলাদেশে।
- সেক্ষেত্রে টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের প্রতি নজর দেওয়া একটি সময়োপযোগী এবং কার্যকরী ও সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। কেননা, মোটেই কোনো বিলাসী পন্য নয় বরং অনেকটাই নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদান।
- চিকিৎসার প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন- ডাক্তার দের ব্যাবহারের জন্য পিপিই,গ্লাভস,মাস্ক এগুলো সবই অতি গুরুত্বপূর্ণ নিত্য ব্যাবহারের উপাদান। এসব উৎপাদনের কারণ আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে।
- এছাড়া নজর দিতে হবে টেক্সটাইলের গবেষণার উপর, যাতে সাস্টেইনেবল ও রিইউজেবল পণ্য তৈরি করা যায়।
- ভাইরাস প্রতিরোধী কিংবা বিশেষায়িত কাপড় প্রস্তুত করা যায়।
- করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে মালিকদের দেউলিয়া ঠেকাতে সঠিক নীতিমালা নির্ধারণ করা খুব ই জরুরি। পাশাপাশি কাঁচামালের মালিকদের সাথে সমঝোতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই।
- পোশাক কর্মীদের চাকরির ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট নীতিনির্ধারণ করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এতে মালিকপক্ষের ও ক্ষতি হবেনা, পোশাক কর্মীদেরও চাকরি সুরক্ষিত হবে।
সঠিক পরিকল্পনা, সুনির্দিষ্ট নীতিনির্ধারণ অবশ্যই দেশের এই শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পকে বাঁচাতে সক্ষম।অন্যথায় কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ও গুরুত্বের অভাবে ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। তাই দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন সুদীর্ঘকালের পরিকল্পনার প্রতি।কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রণীত নির্দেশনা মেনে চললে অবশ্যই আমরা এই বৈশ্বিক রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করবো।