★ইতিহাসঃ
আদিকালে গাছের লতা,পাতা,ছাল এবং পশুর চামড়া দিয়ে মানুষের বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মিটানো হতো এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আঁশ,সুতা এবং কাপড়ের ব্যবহার রপ্ত করে। কবে ,কখন এবং কোথায় প্রথম কাপড়ের ব্যবহার আরম্ভ হয় তার সঠিক তথ্য আজও অজানা, তবে একথা সত্য যে, এক সময়ে মানুষ সুই সুতা দিয়ে হাতে সেলাই করে পোশাক তৈরি করত। সেলাই মেশিনের সাহায্যে পোশাক সেলাই করার ইতিহাস মাত্র ২৬০ বছর আগের ইতিহাস। রেডিমেড পোশাক তৈরির ইতিহাস মাত্র ১৮০ বছরের প্রাচীন কাহিনী।
★বাংলাদেশে পোশাক কারখানার যাত্রাঃ
বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় ১৯৬০ সালে ঢাকার উর্দুরোডে যার নাম রিয়াজ গার্মেন্টস। রিয়াজ ষ্টোর নামে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম গার্মেন্টস। ১৯৬৫ সালে রিয়াজ ষ্টোর এর মালিক জনাব রিয়াজ উদ্দিন করাচি ভ্রমণকালে একটি গার্মেন্টসকে মাসে ১লক্ষ পিস পোশাক রপ্তানী করতে দেখেন। ভখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বিদেশে পোষাক রপ্তানীর স্বপ্ন দেখতে থাকেন। শুরুতে তাঁরা শুধু দেশের চাহিদাই পুরণ করত।
ইংরেজি ১৯৬৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস এর উৎপাদিত ১০,০০০ পিস শার্ট বাংলাদেশ হতে সর্বপ্রথম বিদেশে (ইংল্যান্ডে) রপ্তানি করা হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে রিয়াজ ষ্টোর এর নাম পরিবর্তন করে রিয়াজ গার্মেন্টস রাখেন। ১৯৭৮ সালের ২৫শে জুলাই টিসিবির সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে সর্বপ্রথম ৪ লক্ষ টাকা মূল্যের পুরুষদের শার্ট রপ্তানী করা হয় ফ্রান্সে।
★ বাংলাদেশে পোশাক কারখানার অগ্রগতিঃ
১৯৭৭-৭৮ সালে এদেশে ছিলো শুধুমাত্র ৯টি রপ্তানিমূখী প্রতিষ্ঠান যারা ইউরোপের বাজারে১০লাখ মার্কিন ডলারের ব্যবসা করতো প্রতিবছর। সেইসময় ৩টি বড় ও সুপ্রসিদ্ধ পোশাক কারখানা ছিলো দেশে। এগুলো হলো;
১। রিয়াজ গার্মেন্টস,
২। জুয়েল গার্মেন্টস,
৩। প্যারিস গার্মেন্টস।
১৯৮০ সালে ইয়াঙ্গুন নামে অপর একটি কোরিয়ান কর্পোরেশন বাংলাদেশি ট্রেকসীম লিমিটেড নামে অপর একটি কোম্পানির সঙ্গে প্রথম যৌথ উদ্যোগে তৈরি পোশাক কারখানা গড়ে তোলে। বাংলাদেশি অংশীদাররা নতুন প্রতিষ্ঠান ইয়াঙ্গুনস বাংলাদেশ-এ শতকরা ৫১ ভাগ ইকুইটির মালিক হয়। এটি প্রথম ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে প্যাডেড এবং নন-প্যাডেড জ্যাকেট সুইডেনে রপ্তানি করে।
কম উৎপাদন খরচের কারণেই বাংলাদেশ বিদেশি ক্রেতার কাছে ক্রমবর্ধমান আকর্ষণীয় ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।
এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। বাংলাদেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং ১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২,৯০০টিতে উন্নীত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্পের সাফল্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই ধারাবাহিকতায় উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষমতা সমানতালে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯ সালে কারখানার সংখ্যা ৩ হাজারে উপনীত হয়। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তন্মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের স্থান ষষ্ঠ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে টি-শার্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থান দখল করে আছে। ১৯৯০-এর দশকে এ শিল্পখাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে বার্ষিক প্রায় ২২ শতাংশ হারে।
১৯৮৩-৮৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয় মাত্র ০.৯ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩.৮৯ ভাগ। ১৯৯৮-৯৯ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় ছিল ৫.৫১ বিলিয়ন ডলার যা মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৭৫.৬৭ ভাগ। তবে নিট বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ছিল এর মাত্র ৩০% কারণ, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ আমদানিতে ব্যয় হয় আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৭০%।
২০১৬ নাগাদ বাংলাদেশে রপ্তানীমুখী পোশাক শিল্পের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। প্রতি বছর যেমন শত শত নতুন কারখানা স্থাপিত হয় তেমনি শত শত কারখানা প্রতিযোগতিায় টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যায়।
★বিশ্ববাজারে অবস্থানঃ
বাংলাদেশ প্রধানত কম মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানী করে থাকে যাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের হার খুবই কম। বিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রধানত উত্তর আমেরিকা ও ইয়োরোপে রপ্তানি হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই, বিশেষ করে ২০০৫-এ কোটা পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় বাংলাদেশী উদ্যোক্তরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তৈরি পোশাক রপ্তানীর চেষ্টা চালাতে থাকে এবং সফলতা আসতে থাকে।
২০০৫ পর্যন্ত কোটা প্রথার কারণে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানীর ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করেছে। লিস্ট ডিভালপড কান্টি হিসেবে ‘রুলস অব অরিজিনের’ আওতায় বাংলাদেশী তৈরী পোশাক ইয়োরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশেও শুল্কমুক্ত বা হ্রাসকৃত শুল্কে প্রবেশাধিকার লাভ করেছে।
★বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি(BGMEA)ঃ
এই সমিতি গঠিত হয় ১৯৭৭ সালে, যার সদর দপ্তর ঢাকা। এটি আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৮৩ সালে। ১২ জন সদস্য নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৪৫০০।
★বর্তমান সরকারি তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
১. আটটি ইপিজেড এ ১৮১ টি কারখানা।
২. ঢাকায় ১৫৫৫ টি কারখানা
৩. গাজীপুরে ৮৯৪ টি কারখানা
৪. নারায়ণগঞ্জ এ ৫২৬ টি কারখানা
৫. চট্টগ্রাম এ ৪৭১ টি কারখানা
৬. ময়মনসিংহে ৩৪ টি কারখানা
৭. টাঙ্গাইলে ৬ টি কারখানা
৮. কুমিল্লায় ৩ টি কারখানা
৯. মানিকগঞ্জ এ ৩ টি কারখানা
১০. নরসিংদী তে ৩ টি কারখানা
মোট ৩৬৭৬ টি কারখানা।
বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এতো অল্প সময়ের মধ্যে পোশাক কারখানার এই উন্নতি অভাবনীয়। এর মাঝে ও নানা সময়ে নানা প্রতিকুলতা আসছে, বিশেষ করে ১৯৭১ পূর্ববর্তী সময়ে পোশাক কারখানার
আধিপত্য বিস্তার করে পাকিস্তানিরা, এতে অর্থনীতিক ভাবে ক্ষতির স্বীকার হয় পূর্ব পাকিস্তান।
লেখকঃ
আবদুর সবুর সাজ্জাদ
পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
Department of Textile Engineering
৩য় বর্ষ
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, গুগল সার্চ