বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর একটি দেশ হিসেবে খ্যাত হলেও দেশের রপ্তানী খাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা খাতটি হলো তৈরী পোশাক খাত। দেশের রপ্তানী আয়ের সিংহভাগ অর্থাৎ ৮০% এরো বেশি আসে তৈরী পোশাক খাত থেকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী প্রসংশা কুড়িয়ে তৈরী পোশাক শিল্প আজ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আমরা গার্মেন্টস ব্যাপারটির সাথে সকলেই পরিচিত। কিন্তু মনে হতে পারে, যে দেশে পাটকে বলা হয়ে থাকে সোনালী আঁশ, সেখানে এই পাটজাত পণ্য প্রস্তুত করা হয় কোথায়? আবার অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে পোশাক কারখানা গুলোতেই কি প্রস্তুত হয় পাটজাত পণ্য? নাকি বিশেষায়িত কোন প্রতিষ্ঠান আছে পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করার জন্য? এতো প্রশ্নের বেড়াজালে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ নিয়ে বসে থাকা মানুষেরগুলোর জন্য পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকারণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য নিয়েই সাজানো আজকের লেখাটি। চলুন ধীরে ধীরে পরিষ্কার হওয়া যাক অজানা এ বিষয়টি নিয়ে।
আমাদের দেশে পাটকে সোনালী আশ বলা হয়ে থাকে। সোনালী আশ বলার পিছনে রয়েছে পাট গাছের নিজস্ব গুণাবলি। যার দরূন পাট এর আঁশ থেকে প্রাচীন থেকে বর্তমানে তৈরী হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব সামগ্রী।একসয় পাট থেকে শুধু শক্ত বস্তা,ব্যাগ ই প্রস্তুত করা যায় এমনটি ধারনা ছিলো সবার। কিন্তু বর্তমানকালে সীমাবদ্ধতার খোলস থেকে বেরিয়ে পাটের আঁশ থেকে প্রস্তুত হয় চমৎকার কিছু সামগ্রী,যা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন। পাটের আঁশের গুনাবলি তো আমাদের সকলেই জানা, কিন্তু মাঠ পর্যায় থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ থেকে শুরু করে পন্য প্রস্তুত এর মাঝে সকল কাজ সংগঠিত করে থাকে এমন একটি “জাতীয়” প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচিত হওয়া যাক এবার।
দেশে তৈরী পোশাক প্রস্তুতকরণের জন্য অনেক নামি দামি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকারি ভাবে পোশাক প্রস্তুত করণের জন্য এধরনের প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। কিন্তু দেশে পাটজাত পণ্য প্রস্ততের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সম্পূর্ন উল্টোচিত্র। দেশের পাটজাত পণ্য প্রস্তুতের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে অর্থাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। দেশে পাটজাত পণ্য প্রস্তুত এর সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো ” বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন বা বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি)”। শুরুতেই জানা যাক প্রতিষ্ঠানটির সূচনা লগ্ন থেকে বর্তমান সময়ে পাড়ি জমানোর কিছুটা বাস্তব চিত্র সম্পর্কে।
ভৌগলিক ভাবে দেশে পাট উৎপাদন ভালো হওয়ার কারনে যুদ্ধবিদ্ধস্ত এ দেশকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়ের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়।বিজেএমসি মূলত একজন কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।বিজেএমসি এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে সরকারি ভাবে পরিচালিত অনেক পাটকল এর আওতাধীন রয়েছে। দেশে বর্তমানে বিজেএমসির আওতাধীন ২৬ টি পাটকল রয়েছে, যে প্রতিষ্ঠান গুলো দিনের পর দিন পাটজাত পণ্য প্রস্তুত করে দেশে এর চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করে আসছে। এছাড়াও বিজেএমসির আওতাধীন আরো ৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাট ব্যাতীত অন্যান্য তন্তু নিয়ে কাজ করা হয়ে থাকে। ২৬টি পাটকলের মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের অধীনে রয়েছে ৭টি পাটকল, চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধীনে রয়েছে ১০টি পাটকল এবং খুলনা অঞ্চলের অধীনে রয়েছে ৯টি পাটকল। বাংদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার কারণে ধারণা করাই যাচ্ছে বিজেএমসির আওতাভুক্ত কল গুলোতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান এর ব্যাবস্থা রয়েছে। গাণিতিক রূপ দিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫৫০০ জনে। এর মধ্যে শ্রমিক রয়েছেন ৭০০০০জন এবং কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন ৫৫০০ জন। এছাড়াও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষি পরিবার জীবীকা নির্বাহ করে থাকে থাকে বিজেএমসির উপরে।সার্বিক দিক বিবেচনা করে একটি খসড়া হিসাব করলে দেখা যায়, দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫ কোটিরও অধিক সংখ্যক মানুষ পাট ও পাটশিল্পের উপর নির্ভরশীল।
ভবিষ্যতে বিজেএমসি নিজেদেরকে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানী মূখর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের পাশাপাশি কিছু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।বৈশ্বিক বাজারে বিজেএমসির নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা ও সার্বিকভাবে নিজেদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করা,দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার করে সর্বোৎকৃষ্ট মানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন করা,কৃষকদেরকে পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদানের বিষয়ে সহায়তা করা এবং পাট ও পাটশিল্পের উন্নয়নের জন্য সময়োপযোগী সেই সাথে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করা।মূলত এপদক্ষেপ গুলোকে লক্ষ্য স্থির করে ভবিষ্যতে পাড়ি জমানোর জন্য প্রস্তুত বিজেএমসি। দেশে পর্যাপ্ত পাট উৎপাদন সেই সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের সদিচ্ছাই পারে পাটকল কর্পোরেশন বা বিজেএমসিকে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে।
বিজেএমসি তাদের পণ্য প্রস্তুতের কথা মাথায় রেখে মাঠ পর্যায় থেকে কাচামাল অর্থাৎ পাট সংগ্রহের জন্য দেশে ১৬০ টি পাটক্রয় কেন্দ্রে স্থাপন করেছে। এই নির্ধারিত কেন্দ্রগুলোতে পাট বিক্রিয়ের মাধ্যমে কৃষকরা কম হয়রানির পাশাপাশি পাচ্ছেন তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য। মাঠ পর্যায় থেকে পাট সংগ্রহ করে পরবর্তী সময়ে বিজেএমসি নানা ধরেনের পাটজাত পণ্য প্রস্তুত করে থাকে। প্রস্তুতকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে প্রধানত হেসিয়ান কাপড়, পাটব্যাগ, বস্তার কাপড়, বস্তা,পাট তন্তু থেকে প্রস্তুতকৃত দূর্লভ কম্বল, মোটা কাপড় ইত্যাদি বিলাসবহুল পন্য প্রস্তুত করে থাকে।যা পরবর্তী সময়ে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা আয় করছে, সেই সাথে বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশীয় পাটের এবং পাটজাত পণ্যের কদর।এতকিছুর পাশাপাশি বিজেএমসি বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্বও পালন করে আসছে দীর্ঘসময় থেকে। বিজেএমসির দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা তাদের কল গুলোতে কর্মকর্তা কর্মী শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষালাভের জন্য বিদ্যালয়, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়াও তাদের কলগুলোতে রয়েছে ঈদগাহ, হাসপাতাল, প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র, মসজিদ ও খেলার মাঠ। তাদের এসব কার্যক্রম সত্যিই প্রসংসার দাবি রাখে।
দেশের অর্থনীতির ক্রান্তিকালে পাটজাত পন্য প্রস্তুকারক প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি যেভাবে তাদের অবদান রেখেছে দেশের অর্থনীতিতে, তা ভোলবার নয়।দেশের প্রত্যেকটি পোশাক কারখানার পাশাপাশি শিল্প ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গুলোর উচিত বিজেএমসির আদর্শ কে তাদের কার্যধারার মুকুটে স্থাপন করা। বর্তমান সময়ে কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশে পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যা সকলেরই জানা।সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি এবং বিজেএমসির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে দেশের পাট শিল্প ফিরে পাবে প্রাণ সেই সাথে নতুনমাত্রা যুক্ত হবে দেশের পাটজাত পণ্য প্রস্তুতকৃত প্রতিষ্ঠান গুলোতে এটিই প্রত্যাশা সকলের।
তথ্যসূত্র : bjmc.gov.bd
লেখক:
মুনতাসির রহমান
Department Of Textile Engineering
Batch:201
BGMEA UNIVERSITY OF FASHION AND TECHNOLOGY