কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে খাদি কাপড়। ঐতিহ্যের খাদি এখন ফ্যাশনে সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। এশিয়ার বাইরে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে খাদি কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। সেসব দেশে খাদি কাপড়ের তৈরি পোশাক-পরিচ্ছদ রপ্তানি করা হয়। এ সুনাম অর্জিত হয়েছে বহু বছর ধরে অনেক কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে।
এক সময় সংগ্রামী মানুষ আর গরিবের পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল কুমিল্লার খাদি। সেই খাদি এখন ফ্যাশনে সময়ের চাহিদা মেটাচ্ছে। ঈদ-পূজা কিংবা বিভিন্ন উৎসবে খাদির কাপড় ক্রয়ে আগ্রহী হচ্ছেন ক্রেতারা। কুমিল্লায় খাদি কাপড়ের দোকানে এখন প্রতিদিনই ক্রেতাদের ভিড় লেগেই থাকছে। দিন দিন বাড়ছে কুমিল্লার খাদির কদর।
প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশে হস্তচালিত খাদি ছিল জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু এ শিল্পের প্রচার প্রসার ঘটে ১৯২০ এর দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়কালে। ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বদেশী পণ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং খাদি কাপড় হতে পারে এর অন্যতম উদাহরণ- এ চেতনাকেই জাগ্রত করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এ কারণেই স্বদেশী আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত খাদি কাপড়।
খাদির নামকরণ :
খাদি কাপড়ের নামকরণ নিয়ে রয়েছে মতবাদ। দেশে যখন খাদি কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায় তখন সাধারণ মানুষের কাপড়ের চাহিদা পূরণ করার জন্য মাটির নিচে গর্ত করে পায়ে চালানো প্যাডল দ্বারা এ কাপড় তৈরি হতো। খাদ থেকে তৈরি হতো বলে এর নাম হয় খদ্দর বা খাদি। আবার অনেকে বলে থাকে খদ্দর শব্দটি গুজরাট শব্দ। এই শব্দ থেকে খাদি বা খদ্দর হচ্ছে।
খাদির ইতিহাস :
প্রাচীন কাল থেকেই এ উপমহাদেশে কুমিল্লার তৈরি খাদি বা খদ্দর কাপড়ের চাহিদা ছিল প্রচুর। এই চাহিদা কে ধরে রাখার জন্য ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তৎকালীন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড.আখতার হামিদ খান ও তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগীতায় দ্য খাদি এন্ড কটেজ ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। তখন কুমিল্লার অভয়াশ্রমে, চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ, আর নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে খাদি বা খদ্দর কাপড় বোনা হতো। তখন চান্দিনাতে ড.আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড এর হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ। তারা এই খাদিশিল্পের সুনাম ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অনবরত কাজ করে গেছেন। শৈলেন গুহ মারা যাবার পর তার ছেলে বিজন গুহ এ শিল্প কে ধরে রাখছেন কোন মতে। চান্দিনাতে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত একটি তাঁতশিল্প রয়েছে আজও। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লার খাদিশিল্প তাদের গুণগত মানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়।
কুমিল্লার চান্দিনা, মুরাদনগর ও দেবিদ্বারে সহস্রাধিক তাঁতশিল্প রয়েছে। এই সব অঞ্চলের তাঁতশিল্পীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ সুনাম খ্যাত শিল্প কে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির তৈরি করা কাপড়ের সাথে টিকে থাকাটা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তাছাড়া অপরদিকে রয়েছে কাপড় তৈরিকরণ কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি।
কুমিল্লার স্বনামধন্য খাদিশিল্প কে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের সহযোগীতা প্রয়োজন। তাঁতশিল্পীদের কে স্বল্প সুদে ঋণ ও খদ্দর কাপড় তৈরির কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
বর্তমানে কুমিল্লার খাদি পোশাকের মধ্যে পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, বিছানার চাদর, গায়ের চাদরসহ ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীতে নজরকাড়া ডিজাইন আনা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাদির সবধরনের পোশাকে আধুনিকতা এলেও খদ্দরের সেই মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি এখনো আগের জৌলুস ধরে রেখেছে। খাদির পোশাক যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি পরতে আরামদায়ক।
কুমিল্লা মহানগরীর মনোহরপুর ও লাকসাম রোডে খাদিপণ্য বিক্রির পুরনো দোকানগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য নতুন দোকান গড়ে উঠেছে। অন্যান্য জেলার লোকজন কুমিল্লায় বেড়াতে এলে স্মারক হিসেবে নিয়ে যান কুমিল্লার খাদি। কুমিল্লার খাদিপণ্য বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর চেতনাকে লালন করছে শতবর্ষ ধরে।
খাদি ব্যবসায়ীদের সূত্র জানায়, খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলন ও বাঙালির ঐতিহ্য। এ কাপড় খাদে (গর্তে) বসে তৈরি করা হয় বলে এর নাম দেওয়া হয় ‘খাদি’। শতবর্ষের ঐতিহ্যের খাদি আলোচনায় আসে ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সারা ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সে সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য ডাক ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সেই মোটা কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। কুমিল্লার খাদি এখন শৈল্পিকতার পরশে দেশ-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। খাদির কাপড় যাচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এ সুনাম অর্জিত হয়েছে বহু বছর ধরে অনেক কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমে।
খাদি কাপড়ের সঙ্গে এখন কয়েকটি দিক জড়িত রয়েছে। তা হচ্ছে তাঁতি, সুতা কাটুনি, ব্লক কাটার ও রঙের কারিগর। সবাই মিলে তৈরি করেন নান্দনিক খাদি কাপড়। বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় দেড় হাজার পরিবার এই পেশায় জড়িত। মহানগরে খাদি কাপড়ের দোকান রয়েছে দুই শতাধিক।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা শাখা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে খাদি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদি শিল্পের এ বিপর্যয় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নূনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
কুমিল্লা মহানগরের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘অভয় আশ্রম’-এর কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার আশ-পাশের গ্রামগুলোতে হাতে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া। দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, সাইতলা, বাখরাবাদ, বেলাশ্বর, ভানী, হারং, গুনঞ্জর। দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর। মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, ময়নামতি, জালালপুর, মইনপুর এলাকায় হস্তচালিত তাঁত শিল্পের প্রসার ঘটে। এ তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে বাড়েরা, রামচন্দ্রপুর, জাফরাবাজ, সাইকট, বাবিরচড়, কুটুম্বপুর, কলাগাঁও, সোনাপুর, সাইতলা, ভানী, ফুলতলী, দোবাইরা, গনিপুর প্রভৃতি গ্রামের মানুষ হাতে সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
খাদি শিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন কুমিল্লা মহানগরের খাদি ঘরের তরুণী মোহন রাহা, খাদি কুটির শিল্পের শংকর সাহা, খাদি ভবনের দীনেশ দাশ, বিশু খদ্দরের মনমোহন দত্ত, রাম নারায়ণ স্টোরের কৃষ্ণ সাহা। তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা গ্রামের গ্রামীণ খদ্দর ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী রঞ্জিত দেবনাথ বলেন, বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেশা হিসেবে এখনো কাপড় বুনছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা ক্রেতা এইচ এম সিরাজ বলেন, খাদির পণ্য আরামদায়ক এবং দামও কম। কুমিল্লায় এলে খাদির জামা না কিনে ফিরি না। পরিবারের জন্যও খাদির কাপড় কিনে নিই।
কুমিল্লা মহানগরীর প্রবীণ খাদি কাপড়ের ব্যবসায়ী খাদিঘরের স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা বলেন, একসময় খাদি কাপড় অনেক ভারী ছিল। এখন ওই কাপড় প্রতিনিয়ত মিহি করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম এখন খদ্দর নিয়ে ভাবছে, গবেষণা করছে। এদের হাত ধরেই খাদি কাপড় এবং এ কাপড়ের পাঞ্জাবি ও ফতুয়ার নকশায় বৈচিত্র্য আসছে। প্রদীপ রাহা আরও বলেন, বর্তমানে সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খদ্দরের কাপড়ের চাহিদা থাকায় বর্তমানে খাদি শিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে। কারণ ১৯২১ সালের প্রেক্ষাপট ও চাহিদা এক নয়। কুমিল্লা খাদি শিল্পের একটা শক্ত ভিত আছে। শতবর্ষের খাদিপণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে। খাদির পোশাক যেমন দৃষ্টিনন্দন, পরতে আরামদায়ক এবং দামে সাশ্রয়ী। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি কমিউনিটি আছে সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় খাদি শিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। এর পরপরই আসে সংকটকাল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বস্ত্রকলগুলো তখন বন্ধ। বস্ত্র চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভর দেশে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের ওপর প্রচুর চাপ পড়ে। দেশের বা মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদির উৎপাদন ব্যাপক না হলেও চান্দিনা বাজারকে কেন্দ্র করে আশপাশের গ্রামগুলোতে তাঁতীরা চাদর, পর্দার কাপড়, পরার কাপড় তৈরি করতে শুরু করে।
কুমিল্লা জেলার সাথে খাদিশিল্প আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। একসময় এই খাদির খুব প্রচলন ছিল। কুমিল্লায় আগে গান্ধী অভয়াশ্রমে এ খাদি তৈরি হতো। কুমিল্লা শহরের চান্দিনা উপজেলায় এখনও গান্ধীজীর স্মৃতিবিজড়িত তাঁত রয়েছে। বর্তমানে কুমিল্লার খাদিপণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ‘খাদি কটেজ’, ‘পূর্বাশা গিফট এন্ড খাদি, ‘খাদি হাউজ, ‘খাদি আড়ং, ‘গ্রামীণ খাদি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
খাদি কাপড় এখন বিভিন্ন কোয়ালিটির তৈরি হয়। মোটা, পাতলা, চেক, স্ট্রাইপ এবং বিভিন্ন রঙের গজ কাপড় পাওয়া যায়। দাম প্রতি গজ ৮০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। এছাড়া রয়েছে খাদি শাল, রুমাল, বেড কভার, ওড়না, থ্রি-পিস এমনকি হাল ফ্যাশনের খাদি শাড়িও পাওয়া যায়।
বর্তমানে আমাদের দেশে খাদির পূর্বের মতো বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্য নেই। সেখানে খাদ ঢুকেছে। বর্তমানে যে খাদি কাপড় তৈরি হয়ে থাকে সেই কাপড়ে রয়েছে মিল এবং হাতে কাটা সুতার সমন্বয়। এখানে টানাতে ব্যবহৃত হয় মিলের সুতা।
পরিতাপের বিষয়, এত বছর পরও এ পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কারণ কাপড়ে খাদি সুতার পরিমাণ আরও কমেছে, মিলের সুতার পরিমাণ বেড়েছে। উপরন্তু মিলেরই এক ধরনের সুতা তৈরি হচ্ছে। ওই সুতা দিয়ে তৈরি কাপড় একেবারে খাদি কাপড়ের টেক্সচারের মতো। একে বলা হচ্ছে ‘নিব’। ফলে বাজারে এটাকেই খাদি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যা সাধারন ক্রেতার জন্য বুঝা কঠিন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে খাদি নিয়ে কাজ হচ্ছে না।
খাদি শিল্পে পরিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়া
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাদির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও এসেছে পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে আসার আগে খাদি বা খদ্দরের মৌলিক কিছু বিষয়ের ওপর আলো ফেলা যেতে পারে। এই বুনন কেবল সুতি সুতায় নয়। হতে পারে এবং হয়ও রেশম, অ্যান্ডি, মুগা, তসর, উল প্রভৃতিতে। খাদি কাপড়ের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য হলো হাতে কাটা সুতা দিয়ে হাতে বোনা কাপড়। পরিভাষায় আমরা বলতে পারি, হ্যান্ড স্পান অ্যান্ড হ্যান্ড ওভেন কাপড়। অবশ্য হ্যান্ড স্পান সুতাই কেবল নয়, থাই স্পান সুতাও হতে পারে খদ্দরের উপকরণ। পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন বা এদিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও আছে খাদি। সেখানে মিলবে উল খাদি, সিল্ক খাদি, সুতি খাদি।
আবার আমাদের এ অঞ্চলের খাদি সুতি ও রেশমি। আমাদের এখানে খাদি সিল্ক বলতে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এন্ডিকে বলা হয় খাদি সিল্ক। আসলে তা নয়। সিল্কের একটি ধরন এন্ডি। মুগা ও তসরের মতো। এটি নির্ভর করে মথের বিভিন্নতার ওপর। খাদি যে কোনো প্রাকৃতিক তন্তু থেকেই হতে পারে। এর বিশুদ্ধতা বজায় থাকবে একাধিক পৃথক তন্তুর মিশেলে কাপড় বোনা হলেও। যেমন সুতির সঙ্গে রেশম অথচ উল কিংবা এন্ডি সুতা দিয়ে কাপড় বোনা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আরও একটি পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে। যেটাকে বলা হচ্ছে ব্লেন্ডিং। অবশ্য আগে বিভিন্ন সুতা দিয়ে তৈরির কথা বলেছি; সেটাও এক ধরনের ব্লেন্ডিং। অবশ্য এই ব্লেন্ডিংটা অন্য রকম। এখানে এক বা একাধিক তন্তুকে মিশ্রিত করে একেবারে নতুন তুলায় পরিণত করে সেই তুলা থেকে পুনরায় সুতা কাটা হচ্ছে। আর সেই ব্লেন্ডেড সুতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে খাদি মেটেরিয়াল। তাতে বৈচিত্র্য বাড়ছে।
ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এখন বেশ আধুনিক ডিজাইনে খাদু কাপড় বানানো হচ্ছে। খাদি শিল্পে লেগেছে আধুনিকতা ও পরিবর্তনের ছোঁয়া। সাদামাটা রঙের খাদি কাপড় এখন বিভিন্ন রঙে ছাপা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলোতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে আছে খাদি কাপড়ের পোশাক। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে খাদি কাপড়ের তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে।
খাদি শিল্পে সমস্যা ও তা উত্তরনের উপায় :
বর্তমানে খাদির কাপড়ের যথেষ্ট চাহিদা না থাকলেও দেশে এবং বিদেশে ছোট-ছোট লটে খাদি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ফ্রান্স, স্পেন, ডেনমার্ক, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই পণ্য রপ্তানি হয়। বর্তমানে এই শিল্প টিকে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।
১) তুলার অপর্যাপ্ততা। খাদি কাপড় বুনতে ন্যাচারাল ফাইবার প্রয়োজন হয় যা আমাদের দেশে বিদেশ হতে আমদানি করতে হয়। অর্থাৎ আমাদের দেশে যারা খাদি কাপড় বানায় তারা সহজে সুতা পাচ্ছে না। এটা সহজলভ্য করতে হবে।
২) বর্তমানে হরেক রকমের বাহারী ডিজাইনের ভিড়ে খাদির চাহিদার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বর্তমানে মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে হস্তচালিত তাঁত দ্বারা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে বছরে অন্তত একটি করে হলেও খাদি বা খদ্দরের জামা সকলের কেনা প্রয়োজন। এতে করে খাদি কাপড়ের চাহিদাও বাড়বে সাথে যোগান ও বাড়বে।
৩) খাদি কাপড় আমাদের দেশীয় শিল্প। অথচ পরিতাপের বিষয়, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এটা সম্পর্কে নূন্যতম ধারনাটুকুও নেই। তাই, এই খাদি কাপড়ের ব্যাবহার বাড়াতে এটাকে তরুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে।
৪) আমাদের দেশের এই শিল্পকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হবে। বছরে অন্তত দুইটি প্রদর্শনী বা মেলার আয়োজন করতে হবে যা হবে পুরোটা খাদি শিল্প কেন্দ্রিক। এতে করে এর প্রচার ও প্রসার ঘটবে।
৫) দেশীয় বাজারে বিদেশী কাপড় বিশেষ করে ভারতীয় কাপড়ের অবাধ ব্যাবসা রোধ করতে হবে। এতে যেমন আমাদের দেশীয় কুটির পোশাক শিল্প এগিয়ে যাবে তেমনি খাদি শিল্পেরও প্রসার ঘটবে। কর্মসংস্থান এর সুযোগ ও তৈরি হবে।
৬) বর্তমানে খাদি কাপড় বানানোর কারিগরের সংকট পরিলক্ষিত। স্বল্প পরিসরে হলেও সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে খাদি কাপড় বানানোর প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করতে
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোর মধ্য একটি হলো খাদি। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে সেই ১৯২০ সালের মত ২০২০ সালেও আমাদেরই স্বদেশী পণ্য ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে।
Source : উইকিপিডিয়া, গুগুল, প্রথম আলো,
ঢাকা টাইমস নিউজ।
Writer Information:
Israt Jahan Nadia
Department Of Clothing & Textile, Batch:35, 1st Year
Government College Of Applied Human Science