বাংলার সোনালি ঐতিহ্যের আরেক নাম মসলিন
বাংলার বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। এক সময় বাংলার সূতিবস্ত্র রোম ও চীন সাম্রাজ্যে রপ্তানি করা হতো।মসলিন নামটাই রাজকীয়!
এই স্বচ্ছ কাপড়টির রয়েছে গৌরব উজ্জ্বল স্বর্ণ যুগ। মসলিন আমাদের সোনালি ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের প্রতীক।
মসলিন বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সূতা দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়বিশেষ। এটি ঢাকাই মসলিন নামেও সুবিদিত। ফুটি কার্পাস নামক তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে মসলিন তৈরি করা হত। চড়কা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হত যার ফলে মসলিন হত কাচের মত স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হত। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হয়ে থাকে।
মসলিন : বাংলা মসলিন শব্দটি আরবি, ফারসি কিংবা সংস্কৃতমূল শব্দ নয়। এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দজন ইংরেজ প্রকাশিত অভিধান হবসন জবসন এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে মসূল থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হলো মসূল। এই মসূলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হতো। এই মসূলএবং সূক্ষ্ম কাপড়-এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় মসলিন।অবশ্য বাংলার ইতিহাসে মসলিন বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তি অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একপ্রকার কাপড়কে।
মসলিনের উপকরণ :
মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা, ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে। একদম ভাল মানের কার্পাস উৎপন্ন হত মেঘনার পশ্চিম তীরে। শ্রীরামপুর, কেদারাপুর, বিক্রমপুর, রাজনগর ইত্যাদি স্থানগুলো ফুটি কার্পাসের জন্য বিখ্যাত ছিল। আজকের যে কাপাসিয়া নামটি আমরা জানি তা এসেছে এই কারপাস হতে। মেঘনা এমনিতেই খুব বড় নদী, তার উপর সমুদ্রের কাছাকাছি আবার বর্ষাকালে নদীর দুকূল ভেসে যেত। তার ফলে যে পলি জমতো তার কারনেই ফুটি কার্পাসের উৎপাদন খুব ভাল হতো এসব স্থানগুলোতে। কিন্তু একজন কার্পাস চাষী একবিঘা জমিতে ভালমানের মসলিন তৈরির জন্য মাত্র ছয় কেজির মতো তুলা পেত। তাই মসলিনের চাহিদা যখন খুব বেড়ে গেল, সেই সময় ভারতের গুজরাট হতেও তুলা আমদানি করা হতো- কিন্তু ওগুলো দিয়ে ভালমানের মসলিন তৈরি করা যেত না- যা হতো তা খুব সাধারন মানের হতো।
প্রাচীন কালে মসলিন:
মসলিন, ইউরোপীয় পোশাকের আদলে সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিনের নাম ছিল মলমল। বিদেশী পর্যটকরা এই মসলিনকে কখনও কখনও মলমল শাহী বা মলমল খাস নামে উল্লেখ করেছেন। এগুলি বেশ দামি এবং এরকম এক প্রস্থ বস্ত্র তৈরি করতে তাঁতিদের দীর্ঘদিন, এমনকি ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেত। এই বস্ত্র সম্রাট ও নওয়াবগণই ব্যবহার করতেন। সম্রাটদের জন্য সংগৃহীত বস্ত্রের নাম ছিল মলবুস খাস এবং নওয়াবদের জন্য সংগৃহীত বস্ত্রের নাম ছিল সরকার-ই-আলা। মুগল সরকার সম্রাট ও নওয়াবদের ব্যবহার্য মসলিন প্রস্ত্তত-কার্য তদারকির জন্য দারোগা বা দারোগা-ই-মলবুস খাস উপাধিধারী একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। দীউয়ান ও পদস্থ কর্মকর্তা এবং বিখ্যাত ব্যাঙ্কার জগৎ শেঠ এর জন্যও মলমল সংগ্রহ করা হতো। মলমল (বা মলবুস খাস ও সরকার-ই-আলা) ব্যতীত অন্যান্য মসলিন বস্ত্র ব্যবসায়ীরা রপ্তানি করত। স্থানীয় লোকেরাও কিছু কিছু মসলিন বস্ত্র ব্যবহার করত।
বৃহত্তর ঢাকা জেলার প্রায় সব গ্রামেই তাঁতশিল্প বিদ্যমান ছিল। তবে কয়েকটি স্থান ছিল উৎকৃষ্ট মানের মসলিন তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। এগুলি হচ্ছে: ঢাকা জেলার ঢাকা ও ধামরাই, গাজীপুর জেলার তিতাবদি, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও এবং কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ি ও বাজিতপুর।সোনারগাঁও এক সময় সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ও তাঁর পুত্রের (১৩৩৮-১৩৫৩) রাজধানী ছিল।
তবে মসলিন শিল্পের অবনতি ও চূড়ান্ত বিলুপ্তির সর্বপ্রধান কারণ ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এবং আধুনিক বাষ্পশক্তি ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার। এভাবে ইংল্যান্ডের শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত সস্তা দামের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যায় ঢাকার মসলিনের মতো দামি সূতিবস্ত্র।
তথ্য ও ছবি :উইকিপিডিয়া
Fouzia Jahan Mita
NITER 10th batch