নকশি কাথা পরতে কার না ভালো লাগে।ঠিক নকশি কাথার মতো বুননের মাধ্যমে বিভিন্ন নকশা দিয়ে তৈরি করা এক ধরনের কার্পেট জাতিয় হস্তশিল্প হলো শতরঞ্জি।
আমাদের আধুনিক জীবন যাত্রায় মানানসই ও কার্যকরী উপকরণ শতরঞ্জি। বসার ঘর, পারিবারিক ঘর কিংবা শিশুর ঘর সব জায়গাতেই মানানসই শতরঞ্জি। কার্পেটের বিকল্প হিসেবে মেঝেতে তো বটেই,আরামদায়ক ও দৃষ্টিনন্দন আসন হিসেবেও শতরঞ্জির ব্যাপক ব্যবহার।
শতরঞ্জি শব্দের উৎপত্তি
শতরঞ্জি নামের অনেকগুলো ব্যাখ্যা আছে। একটা হচ্ছে যে ওই সময় আকবরের দরবারে শতরঞ্জি বা পাশা খেলা হতো । শতরঞ্জি খেলার সময় যে কাপড় বিছিয়ে খেলা হতো সেটাকে বলা হতো শতরঞ্জি । এছাড়াও প্রচলিত আছে যে এখান থেকেই শতরঞ্জি নামটা এসেছে । ফরাসি শব্দ শতরঞ্জ থেকে শতরঞ্জি শব্দটি এসেছে। বলা হয় শতরঞ্জি মানে শত রঙের বাহার। তবে এ শতরঞ্জি শব্দটার উৎপত্তি ঠিক কোথায় তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে।শতরঞ্জি মানে শত রঙের বাহার, অবশ্য নামের সঙ্গে মিল রেখে শত রং ব্যবহার হয় না, কয়েকটি রং দিয়েই তৈরি করা হয় শতরঞ্জি।
ইতিহাস
বর্তমান বিশ্বে বুনন শিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি বুনন সবচেয়ে প্রচীনতম শিল্প। মজার ব্যাপার হল এ শিল্পে কোন যন্ত্রের ব্যবহার হয়না। কেবলমাত্র বাঁশ ও রশি দিয়ে মাটির উপর সুতো টানা দিয়ে হাতে বুনে তৈরী করা হত এখন অবশ্য কাঠের ফ্রেম করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। রংপুর জেলার প্রাচীনতম শিল্প ও গৌরবময় ঐতিহ্য শতরঞ্জি। এমনকি মোঘল সম্রাট আকবরের সময়কালে আসন,শয্যা, বিছানা,সভা, মজলিশ বা জলসায় বসার জন্য শতরঞ্জি ব্যবহার করা হত।ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাজা বাদশাহ,বিত্তবানদের গৃহে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে শতরঞ্জির ব্যাপক কদর ছিল।বৃটিশ শাসনামলে এখানকার তৈরি শতরঞ্জি সমগ্র ভারতবর্ষ, বার্মা,সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হত।
রংপুরে শতরঞ্জি পল্লী নিসবেতগঞ্জ এ অবস্থিত। এছাড়া কারুপণ্যসহ রংপুর ও ঢাকা শহরের অনেক দোকানে পাওয়া যায়। শিল্পীর নিপুনতায় শতরঞ্জির নকশা হিসেবে এসেছে নারীর মুখ, পশু পাখি, রাখাল বালক, কলসি নিয়ে নারী, রাজা রানী, দেব দেবী, পৌরানিক চরিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্য। এছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী এসব ডিজাইনে ভিন্নতা দেখা যায়। এসব ডিজাইনে লাল, নীল, কালো রঙের প্রাধান্য বেশি দেখা যায়।
উপকরণ
শতরঞ্জি তৈরির মূল উপকরণ হলো সুতলি, স্থানীয় বাজার থেকে কটন সুতা, পাট, শ্যানালসহ বিভিন্নরকম ফাইবার কিনে নিজেদের পছন্দমত রং করে নেয় তাঁতিরা। সুতা টানা দেয়া হয় বাঁশের ফ্রেমে, এসব টানার দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ৩৫ ফুটা হয়ে থাকে। সুতার বান্ডিল তৈরি করে শতরঞ্জি তাতে বা মেঝেতে বিছিয়ে হাতে বোনা হয়।
ব্যবহার
◾বসার ঘর বা খাবার ঘরে ফ্লোরম্যাট বা কার্পেটের বিকল্প হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহার করা যায়। বসার ঘরে সেন্ট্রাল টেবিলের সামনে কিংবা দুই পাশ থেকে লম্বাটে, আয়তাকার শতরঞ্জি বিছিয়ে দিতে পারেন।
◾দেওয়ালে মাদুর হিসেবেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় এই শতরঞ্জি।
◾শোবার ঘরে ব্যবহৃত ম্যাটের বিকল্প হতে পারে শতরঞ্জি।
◾একই ঘরে রাখা যায় একাধিক শতরঞ্জিও। ঘরের বিভিন্ন ফাঁকা জায়গার জন্য সুবিধা অনুযায়ী বিছিয়ে নিন পছন্দের শতরঞ্জি।
◾ বসার ঘরের এক কোণে কিংবা পারিবারিক ঘরে বসার আয়োজন হতে পারে শতরঞ্জিতেই। শতরঞ্জি বিছিয়ে তার সঙ্গে রেখে দিন মানানসই কয়েকটি কুশন। আরামসে বসতে পারবেন।
◾শতরঞ্জি বিছিয়ে খাবার পরিবেশনও করা যেতে পারে। টেবিলম্যাট বা রানার হিসেবে শতরঞ্জি দৃষ্টিনন্দন।
◾দেয়াল সাজাতেও কাজে লাগাতে পারেন শতরঞ্জি। দেয়ালসজ্জার জন্য বাঁধাই করে নেওয়া যেতে পারে।
◾ইদানীং ব্যাগ, ছোট কয়েন পার্স, টেবিল ম্যাট এবং উপহার সামগ্রীসহ কিছু কিছু সৃজনশীল পণ্যে শতরঞ্জির ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
কতশত সুবিধা
কৃত্রিম তন্তুর কার্পেট পরিষ্কার রাখতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। এ ছাড়া ভারী বলে এদিক–সেদিক সরাতে হলেও মুশকিলে পড়তে হয়। অন্যদিকে শতরঞ্জি পরিষ্কার করা যায় সহজেই, প্রয়োজনে এদিক-সেদিক সরিয়েও নানান কাজে লাগানো যায়। ২০ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে শতরঞ্জির আকার। জ্যামিতিক মোটিফ, জামদানি মোটিফ বেশি ব্যবহার করা হয় শতরঞ্জিতে। নানা রঙের, আকারের এবং সুন্দর নকশার শতরঞ্জি ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে মানিয়ে যায়। ঘরের পর্দা, কুশন কভার, বিছানার চাদর প্রভৃতির সঙ্গে রঙের সামঞ্জস্য থাকলে ভালো দেখাবে।
কালের বিবর্তনে বাংলার মসলিন শিল্প হারিয়ে গেলেও রংপুরের শতরঞ্জি মাথা উচু করে এখনও দাড়িয়ে আছে। রংপুর শহরে শতরঞ্জি পাড়া নামে পরিচিত এলাকায় ঘরে বসেই কাজ হয়ে থাকে। এর মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান যেমন সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি বেগবান হচ্ছে এলাকার অর্থনীতির চাকা।বর্তমানে রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা সহ এশিয়ার প্রায় ৩৬ টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতি তিন বছরে শতরঞ্জি রপ্তানি করে গড়ে প্রায় ৪০ লাখ ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হচ্ছে।উদ্যোগক্তাদের জন্য এ শিল্প দেখাচ্ছ নতুন আশা।সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে দেশের কাঁচামাল দিয়ে এই শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে দেশীয় শিল্পের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক আয় এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখবে শতরঞ্জি শিল্প।
Source:
http://www.rangpur. gov.bd, www.ittefaq.com.bd, samakal.com
Writer:
Israt Jahan
Department of Textile Engineering
Jashore University of Science and Technology