বম্বিক্স মোরি নামের রেশম পোকার লার্ভার গুটি থেকে থেকে রেশম তন্তু সংগ্রহ করা হয়। রেশম হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক প্রোটিন তন্তু।যার কয়েকটি বস্ত্র শিল্পে বয়নের কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় রেশম পোকা চাষের মাধ্যোমে বাণিজ্যিক ভাবে এই সুতা প্রস্তুত করা হয়। রেশম পোকা চাষের পদ্ধতিকে ‘সেরিকালচার’ বলে।
ইতিহাস
প্রাচীন কালে সর্বপ্রথম চীনে রেশমগুটির চাষ শুরু হয়। এর পিছনে চিনের তৎকালিন সম্রাজ্ঞী লেই চু এর ভূমিকা রয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩,৫০০ আগে থেকেই সম্ভবত চীনারা রেশম ব্যবহার জানত। প্রথম দিকে রেশমের জামা চীনের সম্রাট দের জন্য সংরক্ষণ করা হতো।
এটির হালকা গুনগত মানের জন্য এটি চীনা ব্যাবসায়ি দের দৃষ্টি আকর্ষন করে। রেশমের ব্যাবহার বাড়ার সাথে সাথে এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায় পরিণত হয়।পরবর্তীতে এটি বাণিজ্যিক ভাবে চাষ শুরু হয়।
রোমান সাম্রাজ্য রেশমের চাষ জানতো এবং সমাদর করতো, কিন্তু শুধু খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০, বাইজেন্টাইন সাম্রাজের সময় রেশমগুটির চাষ শুরু হয়েছে। উপকথা থেকে জানা যায় যে, সন্ন্যাসীরা আদেশে সম্রাট জাস্টেনিয়ান প্রথম কন্সটান্টিনোপলতে রেশম পোকা ডিমগুলো আনে। ১২০০ খ্রিস্টাব্দে ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো ছিল ইউরোপের সর্বাধিক রেশম উৎপাদন শহর।
ঐতিহ্য
রাজশাহীর সিল্ক নামটি দেয়া হয়েছে কারণ রাজশাহী,বাংলাদেশ এর রেশম তন্তু দিয়ে এটি উৎপন্ন । এটি জনপ্রিয় একটি নাম , বিশেষ করে শাড়িতে ।
রাজশাহীর সিল্ক অনেক সুক্ষ এবং নরম মোলায়েম আঁশ। আঁশের উপাদান পিউপা আসে তুঁত রেশম থেকে এবং এটি প্রোটিন এর আবরন যা সারসিনা নামে ডাকা হয়। সাধারনত তিন ধরনের সিল্ক হয়:
তুঁত সিল্ক
ইরি(অথবা ইন্ডি) সিল্ক এবং
তসর সিল্ক
এসকল বিভিন্ন পণ্যগুলো , তুঁত রেশম সুক্ষ এবং সেইজন্য সবচেয়ে মূল্যবান।
রাজশাহীর সিল্ক দিয়ে তৈরি শাড়ি এবং অন্যন্য পণ্যগুলি গ্রাহকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এবং দেশ ও দেশের বাইরেও এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। রাজশাহীর সিল্কের তৈরি শাড়ি রঙিন এবং রকমারি নকসা ও ডিজাইনে পাওয়া যায় । সিল্ক তন্তু বস্ত্র এবং এ সম্পর্কিত অন্যন্য পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
রাজশাহী রেশম শিল্পের জন্য একটি সিল্ক কারখানা এবং একটি সিল্ক গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছে।এ অঞ্চলের রেশম চাষ সমগ্র বাংলাদেশের সিল্কের যোগানদাতা হিসাবে গ্রাহ্য করা হয়। প্রায় ১০০,০০ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের নিযুক্ত রয়েছে।
আরানি সিল্ক শাড়ী একপ্রকারের সিল্কজাত হাতে বোনা শাড়ী, যা তামিলনাড়ু রাজ্যের আরানি অঞ্চলে পাওয়া যায়। আরানি সিল্ক শাড়ির বৈশিষ্ট্য হল এই শাড়ির জমির ভিন্নভাবে দুদিকেই আঁচল থাকে যার ফলে শাড়িটিকে দুটো আলাদা শাড়ির মতো ব্যবহার করা যায়। এই হস্তশিল্প ভারতের ভৌগোলিক অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়।
আরানি সিল্ক তার ঐতিহ্যপূর্ন, সিল্ক তন্তুর বুননের গণ্য সুবিদিত। আরানি সিল্ক শাড়ির নক্সা অর্ধেক এক রঙের এবং বাকী অর্ধেক অংশ অন্য রঙের। এই শাড়ির দুদিকে দুটি ভিন্ন ধর্মী আঁচল থাকে। যার ফলে একই আরানি শাড়িকে দুবার এবং দু’ভাবে ব্যবহার করা যায়।
এই শাড়ির পাড়ের সীমানায় ফুলের নক্সা দেখা যায় এবং তা সুন্দর ভাবে সুসজ্জিত থাকে। আরানি সিল্ক শাড়ির আঁচল জরি অথবা বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়ে বোনা হয়। আরানি সিল্ক কম ওজন বিশিষ্ট হয়।
এই চান্দেরী শাড়ীগুলি মূলত তিনটি ধরনের কাপড়ের দ্বারা তৈরি হত পিওর সিল্ক/রেশম তন্তু,চান্দেরী সুতী ও সিল্ক/রেশম তন্তু সুতী। বিভিন্ন চান্দেরী নমুনার মধ্যে সনাতন মুদ্রা, ফুলের নকশা, ময়ূর ও জ্যামিতিক নকশা বোনা হত। কিন্তু তাঁতশিল্প সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য ১৩ শতাব্দী থেকে উপলব্ধ ছিল। শুরুতে তন্তুবায়গণ মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের হতেন এবং পরে ১৩৫০ সালে কোষ্টি তন্তুবায়গণ ঝাঁসী থেকে চান্দেরী চলে আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। মুগল আমলে চান্দেরী কাপড়ের ব্যবসা প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়।
মুঘল পোশাক বলতে ষোড়শ, সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত সাম্রাজ্যে মুঘলদের তৈরিকৃত পোশাককে বোঝানো হয়। এগুলো ছিল মসলিন, সিল্ক, মখমল এবং জরি দিয়ে তৈরি রাজকীয় নকশার পোশাক। রং এবং রজক, লোহার সালফেট, তামার সালফেট এবং এন্টিমনির সালফেটের ছাঁচ ডট, চেক এবং ঢেউ খেলানো নকশা তৈরি করতে ব্যাবহার করা হতো।
পুরুষেরা লম্বা হাতা বিশিষ্ট কোট ছোগা সহ বিভিন্ন লম্বা এবং খাটো আলখাল্লা পড়তেন। তারা মাথায় “পাগড়ি” এবং “পাটকার” সাথে কোমরে অলংকৃত উত্তরীয় পরিধান করতেন। তারা “পায়জামার” মতো প্যান্ট (সম্পূর্ণ পা ঢাকা পোশাক জেক ইংরেজিতে পাজামা বলে) পিরধান করতেন। অন্যান্য পোশাকের মধ্যে রয়েছে: “পেশবা” শৈলীর কোট এবং “য়ালেক” কোট। মহিলারা “সেলোয়ার”, “চুড়িদার”, “দিলজা”, “ঘাগড়া” এবং “ফার্সি” পরিধান করতেন। তারা কানের দুল, নাকের ফুল, গলার হার, চুরি এবং নুপুর সহ প্রচুর পরিমাণে অলংকার ব্যবহার করতেন।
পাগড়ির মধ্যে ছিল: চার্ স্তর বিশিষ্ট “ছাও-গসিয়া”, গম্বুজ আকৃতির “কুব্বেদার”, “কাশিতি”, “দুপাল্লি”, সুতার কাজ করা “নুক্কদার” এবং সুতার কাজ এবং মখমলের “মানদিল”। জুতার মধ্যে ছিল: সামনের অংশে উপরের দিকে বাঁকানো “ঝুতি”, “কাফাশ”, “চারভান”, “সালিম শাহী” এবং “খুর্দ নাও”। সেই সময়ে লখনৌ জুতা এবং সোনা রুপার সুতার কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। মুঘল সম্রাটরা সাধারণত তাদের পাগড়িতে সুসজ্জিত পাগড়ির অলংকার ব্যবহার করতেন। এগুলো তৈরী হতো স্বর্ণ এবং রুবি, হীরা, পান্না এবং নীলকান্তমণির মতো বহুমূল্য রত্ন দিয়ে।
মোঃ তানভীর হোসেন সরকার
ডিপার্টমেন্ট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রিসার্চ। (নিটার)