Traditional Textile Series (পর্ব-০৪)
রেশম তৈরি প্রক্রিয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছিল বহু শতক আগেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তেরো শতকে সুদূর ইতালিতে এই রেশম গাঙ্গেয় সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। বাংলায় রেশম উৎপাদনের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে দেখা যায়, গ্রামের গৃহস্থরা রেশম উৎপাদনের প্রথম তিনটি পর্যায় সম্পন্ন করে: মালবেরি বা তুঁত চাষ, রেশমগুটি লালনপালন এবং সুতা কাটা। তারপর সেই সুতা নিকটবর্তী গ্রাম বা শহরের দক্ষ তাঁতিদের কাছে বিক্রয় করা হয় বিভিন্ন প্রকার রেশম বস্ত্র তৈরির জন্য। বাংলায় এত বেশি রেশম উৎপাদিত হতো যে তা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পর প্রচুর পরিমাণে বাইরে রপ্তানি হতো। এই সিল্কের বাজারই প্রথম ইউরোপীয় বণিকদের বাংলায় আসতে আকৃষ্ট করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর পূর্বে চীন দেশে সর্ব প্রথম রেশমকীট থেকে গুটি এবং গুটি থেকে সুতা উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। রেশম চাষের জন্য কলাকৌশল চীনারা প্রথম দিকে গোপন রাখলেও শেষ পর্যন্ত তা অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেশমকীটের সাহায্যে উৎকৃষ্ট মানের মিহি সুতা প্রাপ্তির কাজ চলে আসছে।
১৭ শতকের মধ্যভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুগল সরকার থেকে বাংলায় কয়েকটি ফ্যাক্টরি খোলার অনুমতি পায়। তারা মালদহ জেলায় কাসিমবাজারে চাষ করা রেশম এবং মিশ্রবস্ত্র, ময়ূরভঞ্জ তথা মেদিনীপুরের রেশম এবং সুতি মিশ্রণ ও সুতি কাপড়, ঢাকা এবং শান্তিপুরের সূক্ষ্ম মসলিন, এছাড়া শুধু ঢাকায় উৎপন্ন সূক্ষ্ম সুচিকর্ম (সাদা কাজ করা মসলিন বা চিকন নামে পরিচিত ছিল) নিয়ে কাজ করে। প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যের গতি মাঝারি রকমের ছিল কিন্তু হঠাৎ ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সাথে বিলাস দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর পরিমাণে বাংলার থান কাপড় ব্রিটেনে রপ্তানি হয়। ১৭ শতকের শেষ দিক থেকে ১৯ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত এ অবস্থা চলে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার তাঁত শিল্পের একচেটিয়া বাণিজ্য দখল করে নেয়। তবে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপন্ন প্রথমে সস্তা কাপড় এবং পরবর্তীকালে সুতা (ইংলিশ টুইস্ট) বাংলার তাঁত শিল্পে প্রতিযোগী হয়ে ওঠে। এছাড়া মুগল ও নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এ শিল্পে ধ্বস নামে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
রেশম পোকা (Silk Insects):
প্রাণিজগতের আর্থ্রোপোডা পর্বের Bombyx গণের এক প্রকার পতঙ্গ। এই পতঙ্গের শূককীট দশার শেষ পর্যায়ে, এদের শরীরের লালা গ্রন্থি নিঃসৃত রস বাতাসের সংস্পর্শে এলে তা বিশেষ ধরনের আঁশে পরিণত হয়। এই আঁশকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুতায় পরিণত করা হয়। এই সূতাই রেশমসুতা নামে পরিচিত। এই কারণে রেশম উৎপাদনকারী পতঙ্গ বা পোকাকে ‘রেশম পোকা’ বলা হয়।
অনেকেই রেশম সুতা উৎপাদনের লক্ষে এই রেশম পোকা প্রতিপালন করে থাকেন। যাকে আমরা বলি রেশম চাষ। এটি ফলিত প্রাণিবিজ্ঞান এর অন্যতম একটি শাখা। রেশম চাষের ইংরেজি শব্দ সেরিকালচার (Sericulture) এবং এর আভিধানিক অর্থ Culture of Sericine বা সেরিসিন নামক এক ধরনের প্রোটিন এর লালন। এই সেরিসিন হলো রেশমের মূল গাঠনিক পদার্থ। অর্থাৎ যে জীব সেরিসিন নামক প্রোটিন বস্তু প্রস্তুত করে তার লালন-পালন ই হচ্ছে সেরিকালচার বা রেশম চাষ।
রেশম সূতার ইতিহাসঃ
চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশম সুতা আবিস্কৃত হয়। এর সর্বপ্রাচীন নমুনা পাওয়া গেছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের। কথিত আছে‒খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ শতাব্দীতে লেইজু (Leizu) নামের এক সম্রাজ্ঞী বাগানে বসে সহচরীদের নিয়ে চা পান করছিলেন, এমন সময় একটি রেশমগুটি তার চায়ের পাত্রে এসে পড়ে, তার এক বালিকা সহচরী দ্রুত পাত্র থেকে গুটিটি তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, গুটি থেকে এক ধরনের মিহি সুতো বের হচ্ছে। সম্রাজ্ঞী বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, এই সুতা থেকে উন্নত মানের কাপড় বোনা সম্ভব। এরপর সম্রাজ্ঞীর আদেশে রেশমগুটি সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করা হয় এবং পরে সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরি করা হয়। পরে সম্রাজ্ঞীর আদেশে প্রাসাদের ভিতরে মেয়েরা প্রথম রেশম কাপড় তৈরি করা শুরু করে। সে সময় প্রাসাদ রমণীদের একটি বড় বিনোদনের বিষয় ছিল রেশম বুনন। তারপর হাজার বছর ধরে রেশমি কাপড় কিভাবে তৈরি করা হয়, তা চীনারা গোপন রাখে। রেশম আবিষ্কারের ফলে চিত্রশিল্পের ক্ষেত্র এক বিশাল অগ্রগতি হয়। চীনে রেশমি কাপড়ের উপর ওপর ছবি এঁকে এক স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হয়েছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টেনিয়ানের আদেশে দুজন ইউরোপীয় পাদ্রী গোপনে রেশম উৎপাদনের কৌশল শিখে নেন। ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, ইউরোপে রেশম চাষ শুরু হয়। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো ছিল ইউরোপের সর্বাধিক রেশম উৎপাদন শহরে পরিণত হয়েছিল।
রেশম কীট বা রেশম পোকার জীবন চক্র চারটি পর্যায়ে ঘটে থাকে। এগুলো হলোঃ
▪ ডিম
▪ শূককীট
▪ মুক-কীট
▪ পূর্ণাঙ্গ পোকা।
প্রথম পর্যায়ঃ স্ত্রী পোকা পাতা বা কাগজের উপর ডিম পাড়ে। এরা একসাথে প্রায় ৪০০-৫০০ ডিম পাড়ে। ডিম গুলো দেখতে ফ্যাকাসে হলুদের মত। ডিমগুলো দেখতে অনেকটা ইংরেজি C এর মত। ডিমগুলো ৭৮ – ৮৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হতে খাকে। ১০-১৪ দিন পর ডিম থেকে শূককীট উৎপন্ন হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ শূককীট বড় হলে বাদামী লাল রঙের দেখায়। শূককীট চতুর্থবার খোলস বদলানোর পর মূককীটে পরিণত হতে শুরু করে। এ সময় এদের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শূককীট, মূককীটকে যে বাঁশের ডালায় গালা হয় তার নাম চন্দ্রকী। চন্দ্রকীতে অনেক গুলি কুঠুরি থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ঃ শূককীট দেহের ভিতরে একটি লম্বা রেশম গ্রন্থি থাকে। গ্রন্থিতে থাকে এক প্রকার রস। নালী দিয়ে এ রস মুখের বাইরে আসে। নালীর নাম স্পিনারেট (Spinneret)। বাতাসের সংস্পর্শে রস শক্ত হয়ে যায়। মূককীট মিনিটে ৬৫ বার মুখ ঘুরিয়ে রস দিয়ে দেহের চারপাশে আবরণ তৈরি করে। এই রসকে সাধারণ কথায় মুখের লালা বলে। আবরণসহ মূককীটকে গুটি বলে। গুটির ইংরেজি নাম কুকুন (Cocoon)। গুটির মধ্যে মুককীটের অদ্ভুত রূপান্তর ঘটে। এই পরিবর্তনকে মেটামরফসিস (Metamorphosis) বলে। মূককীট পরিবর্তিত হয়ে সুন্দর মথের রূপ ধারণ করে। মথই রেশম পোকার পূর্ণাঙ্গ অবস্থা।
চতুর্থ পর্যায়ঃ মথ হবার আগেই গুটিকে বাষ্প বা গরম জলে রাখতে হয়। না হলে মথ গুটি কেটে বেরিয়ে যায়। গুটি কেটে গেলে সুতা নষ্ট হয়ে যায়। গুটি গরম পানিতে পড়লে এর সুতোর জট খুলে যায়। একটি গুটিতে ৪০০–৫০০ গজ সুতা থাকে।
রেশমগুটি থেকে রেশম সুতা সংগ্রহঃ
রেশম উৎপাদন একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। রেশমগুটি থেকে রেশম তৈরি করা হয়। রেশমগুটি আসলে রেশম মথের শুঁয়াপোকা; এদের একমাত্র খাদ্য তুঁতপাতা। রেশমকীট ডিম থেকে জন্মায় এবং গুটিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর্যায় শেষ করে তারা রেশম মথ হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্ত্রী মথ তখন কালচক্র পুনরায় শুরু করার জন্য ডিম পাড়ে। গুটিবদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলিকে মেরে ফেলে সেগুলিকে সেদ্ধ করে সুতা ছাড়ানো হয় এবং পরে তা গোটানো হয়। এর এই সুতা বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তৈরির জন্য নানাভাবে প্রস্তুত করা হয়। শূককীট দশা শেষ করে রেশম পোকা তার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, দেহ নিঃসৃত লালা দিয়ে দেহকে আবৃত করে ফেলে এবং একটি ডিম্বাকৃতির গুটিতে পরিণত হয়। রেশম চাষীরা এই গুটি গরম পানিতে চুবিয়ে রেশমপোকা মেরে ফেলে। একই সাথে গরম পানির সংস্পর্শে গুটি নরম হয়ে আলগা হয়ে যায়। এই সময় চাষীরা যত্নের সাথে কাঠি দিয়ে রেশম সুতার একটি প্রান্ত বের করে আনে। এই প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে টেনে টেনে দীর্ঘ সুতা বের করে আনা হয়। এই সুতাকেই রেশম সুতা বলা হয়।
রেশম সংরক্ষণঃ পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী ও পুরুষ মথ কোকুন থেকে বের হওয়ার পর পরই এরা প্রজনন করে। একটি পুরুষ মথ একদিনে ২-৩টি স্ত্রী মথের সাথে প্রজনন করে। প্রজননের পর স্ত্রী মথকে ছেড়ে দেয়ার অল্প সময় পরেই স্ত্রী মথ ডিম পাড়ে। একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মথ ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৬৫০টি ডিম পাড়ে। এই ডিম ফুটিয়ে আবার রেশম চাষ করা যায়।
রেশমের রোগ ও পোকাঃ রেশমে কটারোগ, কালোশিরা, রসা, চুনা কাঠি ও স্বল্পরোগ হয়। উজি মাছি খুব ক্ষতিকর। এই পোকা ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে মেরে ফেলতে হবে। রোগ ও পোকা দমনের জন্য সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা এবং সবকিছু শোধন করে কাজ করা।
বাংলাদেশে রেশম চাষঃ
রেশম চাষের সাথে আমাদের দেশের মানুষ অনেক কাল ধরেই পরিচিত। অল্প পরিমাণ জমিতে তুঁত চাষ করে পশুপালনের মাধ্যমে রেশম গুটি উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের যেসব উঁচু স্থানে তুঁত গাছ জন্মানো যায় সেসব স্থানে রেশমকীট জন্মানো যাবে। এদেশের প্রায় যে কোন আবহাওয়া ও তাপমাত্রায় রেশমকীট পালন করা যায়। তবে ২১০-২৯০ তাপমাত্রা এবং ৯০% বায়ুর আর্দ্রতা রেশম চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। আবহাওয়া ও উর্বর মাটির জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি রেশম চাষ হয়। এছাড়া নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর ও সিলেটে রেশম পোকার চাষ করা হয়। তুঁত গাছ বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে এবং নাম ভিন্ন। বাংলাদেশের রেশম পোকারা যে তুঁত গাছের পাতা খায় তার নাম মোরাস অ্যালভা ( Morus alba)।
Writer:
Sajjadul Islam Rakib
Dept. of Textile Engineering
National Institute of Textile Engineering and Research-NITER (10th Batch)