টেক্সটাইল ফাইবার মূলত দুই ধরনের।১.প্রাকৃতিক ফাইবার ও ২.সিন্থেটিক ফাইবার বা কৃত্রিম ফাইবার।লোটাস ফাইবার প্রাকৃতিক ফাইবারের অন্তর্ভুক্ত।লোটাস বা পদ্মফুল সাধারণত নোংরা কর্দমাক্ত পানির মধ্যে জন্মায়।লোটাস ফুলের মধ্যে ক্ষয়পূরণকারী গুণাবলি থাকে যা পরবর্তীতে এর ফাইবার থেকে তৈরি ফেব্রিকেও দেখা যায়।লোটাস ফাইবার থেকে তৈরি ফেব্রিক অনেকটা সিল্কের গুণাবলি বহন করে।মায়ানমার ও কম্বোডিয়ার লেকে প্রাপ্ত লোটাস থেকে যে ফাইবার আলাদা করা হয় তা কোন মেশিন ছাড়াই হাতে স্পিন করা হয়।পরবর্তীতে হাতের উইভিং প্রক্রিয়া দ্বারাই ২৪ ঘন্টার মধ্যে সিল্কের ন্যায় কাপড় প্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া যায়।
লোটাস ফাইবার এক ধরনের প্রাকৃতিক ফাইবার যা লোটাসের বৃন্ত থেকে সংগ্রহ করা হয়।উদ্ভিদবিজ্ঞানমতে, লোটাস ফাইবার জাইলেম ট্রাকিয়ার উপাদানসমূহের মধ্যে অবস্থিত একটি সেকেন্ডারি প্রাচীর।এর মূল গঠন উপাদান হল সেলুলোজ।এছাড়াও এটি হেমিসেলুলোজ,ওয়াক্স,লিগনিন,পেকটিন,হাইড্রোট্রপ,অ্যামিনো এসিড ইত্যাদি নিয়ে গঠিত।এর গঠনাকৃতি চক্রাকার ও উলম্বভাবে সর্পিলাকার।এটি অনেকগুলো মনোফিলের সমন্বয়ে গঠিত একটি বান্ডল ফাইবার।লোটাস ফাইবার একটি টিপিকাল ফাইবার যার কেলাসধর্ম ৪৮% ও বিন্যাসধর্ম ৬০%।এটি উচ্চ দৃঢ়তা সম্পন্ন ও নিম্ন প্রসারণ সম্পন্ন ফাইবার যার ইনিশিয়াল মডুলাস ১৪৬.৮১ cN/dtex(centi-Newton per decitex), মাত্রা বিকৃতি ৩.৪৪ CN/dtex এবং সম্প্রসারণ হার ২.৭৫%।এই ফাইবারের ঘনত্ব ১.১৮৪৮ g/cm3(gram per centimeter-cube) ও আর্দ্রতা বজায় রাখার হার ১২.৩%।গবেষণা হতে প্রাপ্ত,লোটাস ফাইবারের অসমতল ভূসংস্থান ও অন্তর্বর্তী গঠন অন্যান্য সাধারণ প্লান্ট ফাইবার অপেক্ষা ভিন্ন।গড় সংসক্তি বিকৃতি ও ইয়ং এর মডুলাস বিবেচনা করলে এ ফাইবার অনেকটা তুলার ন্যায়।
লোটাস ফাইবার থেকে তৈরি বিশুদ্ধ লোটাস ফেব্রিককে সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক মাইক্রোফাইবার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।এর কতকগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।যেমন- এর ওজন খুবই কম,সিল্কের ন্যায় নমনীয়,অত্যন্ত সূক্ষ্ম,স্থিতিস্থাপক,অতি আরামদায়ক,জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি,ভাঁজ মুক্ত,সহজে আর্দ্রতা শুষে নিয়ে শুষ্ক হতে পারে এবং দীর্ঘদিন টিকে থাকতে সক্ষম।এছাড়াও লোটাস ফেব্রিককে সর্বোত্তম পরিবেশবান্ধব ফেব্রিক বলা হয়।কারণ এটি লোটাসের কান্ড তথা শাখা থেকে তৈরি করা হয়।উক্ত প্রক্রিয়া দ্বারা একটি বর্জ্যকে মানসম্পন্ন টেক্সটাইল প্রোডাক্টে পরিণত করা হয়।উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন রকম রাসায়নিক বা বিষাক্ত উপাদান ব্যবহৃত হয় না।ঐতিহ্যবাহী বার্মিজ ও থাই মেথড অনুযায়ী সম্পূর্ণ হাতের কাজ দ্বারা স্পিনিং ও উইভিং প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়।
💢লোটাস ফাইবারের ইতিহাস :
লোটাসের শাখা থেকে ফাইবার সংগ্রহের প্রক্রিয়া সেই ১৯১০ সাল থেকে দৃশ্যমান।সর্বপ্রথম মায়ানমার,থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াতে এ ফাইবার উৎপাদন শুরু হয়।মায়ানমারের কেন্দ্রে ইনলে লেকের উপর অবস্থিত একটি গ্রামের নাম পাউ খন।সেখানে হাতের কাজ দ্বারা লোটাস ফাইবার ও ফেব্রিক উৎপাদন করতে দেখা যায়।এই প্রক্রিয়াটি প্রায় এক শতক ধরে উক্ত অন্ঞ্চলে দেখা যাচ্ছে।তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধধর্মের উচ্চপদস্থ সাধুরা পরিধানের জন্য এ ফেব্রিক ব্যবহার করত।তাই পরবর্তীতে এর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।এটি পরিধানের মাধ্যমে শান্তি ও আরাম অনুভব করা যায়। এটি ১০০% জৈব বিধায় পরিবেশবান্ধব এবং পরিধানকারীকে মাথা ব্যথা,অ্যাজমা,ফুসফুসের সমস্যা ও হৃদসংক্রান্ত জটিলতা থেকে রক্ষা করে।এসব গুণাবলি বিবেচনা করে পরবর্তীতে ৯০ এর দশকে জাপানের ডিজাইনাররা একটি ওয়ার্কশপ সেট করে সেখানে লোটাস ফেব্রিক উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।কিন্তু জাপানে তখন চাহিদা কম থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না।
💢ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস :
🏴ফাইবার সংগ্রহ :
★অনেকগুলো লোটাসের শাখা একত্র করা হয়।
★৫-৬ টি শাখা একসাথে নিয়ে কর্তন করা হয়।
★টুইস্টিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০-৩০ টি পরিষ্কার ফিলামেন্ট আলাদা করা হয়।
★অতঃপর ড্রাফটিং ও রোলিং করে একটি সুতায় পরিণত করা হয়।
🏴ইয়ার্ন প্রস্তুতি :
★সুতা তৈরির পর সুতার জটকে বাঁশের তৈরি স্পিনিং ফ্রেমের ওপর রাখা হয়।
★ওয়ার্পিং প্রসেসের জন্য সুতাকে উইন্ডারে(সুতার জট কুন্ডলী পাকিয়ে সংরক্ষণ করা)পরিণত করা হয়।
★সুতার অধিক জট পাকা প্রতিহত করার জন্য ৪০ মিটার সুতা তৈরির পর আলাদা করে প্লাস্টিক ব্যাগে সংরক্ষণ করা হয়।
★ওয়েফ্ট প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত ইয়ার্নকে কুন্ডলী পাকিয়ে গোলাকার আকৃতি প্রদান করা হয়।
🏴উইভিং :
★ঐতিহ্যবাহী কম্বোডিয়ান লুমে ফেব্রিক গঠন করা হয়।
★জট থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া অতিরিক্ত সুতা সংরক্ষণ করা হয় ও পরবর্তীতে উইভিং প্রক্রিয়ার সময় ছাটাই করা হয়।
★উইভিং প্রক্রিয়ার সময় ফাইবারগুলো শীতল রাখার জন্য সুতাকে ধারাবাহিকভাবে পানি দিয়ে ভেজানো হয়।
★তৈরিকৃত ফেব্রিকের প্রশস্ততা হয় প্রায় ২৪ ইন্ঞ্চি।
★প্রাকৃতিক ডাইং প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়।
একটি পরিপূর্ণ পোশাক তৈরিতে প্রয়োজনীয় ফেব্রিক উৎপাদন করতে আনুমানিক ১,২০,০০০ লোটাস শাখার দরকার হয়।ফাইবার সংগ্রহের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই ফেব্রিক উৎপাদন শেষ করতে হয়।অন্যথায় ফাইবারের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি হাতে করা হয় বলে অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ এবং উৎপাদনের পরিমানও স্বল্প।
💢বর্তমান ফ্যাশন দুনিয়ায় এর প্রভাব :
পূর্বে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মের সাধুরা লোটাস ফেব্রিক থেকে তৈরি পোশাক পরিধান করত।সেই ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনও অনেক সাধু ও ধার্মিক ব্যক্তিবর্গ এই ফেব্রিকের পোশাক ব্যবহার করে থাকেন।এর খরচ বেশি হওয়ায় শুধুমাত্র সচ্ছল ব্যক্তিরাই এটি ব্যবহার করেন।
২০১২ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় “ইউনেস্কো হস্তশিল্প প্রোগ্রাম” আয়োজিত হয়।সেখানে লোটাস ফেব্রিক থেকে তৈরি পোশাকের নমুনা “সিল অফ এক্সিলেন্স” পুরষ্কার পায়।এর ফলে কারিগররা ঐতিহ্যবাহী দক্ষতা ও প্যাটার্ন ব্যবহার করে নতুন উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় উৎপাদন বাড়ানোর উৎসাহ পায়।পদক প্রাপ্তির পর লোটাস ফেব্রিক সমস্ত বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
লোটাস ফেব্রিক দেখতে লিনেন ও সিল্ক কাপড়ের ন্যায়।ইতালিয়ান লাক্সারি ব্র্যান্ড “লোরো পিয়ানা” এর মালিক মি. পিয়ের লুইজি লোরো পিয়ানার নজরে এই ফেব্রিক আসে।এর বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতায় অভিভূত হয়ে তিনি এ ফেব্রিক সম্পর্কে আরো জানার জন্য মায়ানমার ভ্রমণ করেন।এরপর সব পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার কোম্পানির জন্য এক মাসে ৫৫ গজ ফেব্রিকের অর্ডার করেন।বর্তমানে “লোরো পিয়ানা”তে লোটাস ফেব্রিকের তৈরি জ্যাকেট বিক্রি করা হয় যার দাম ৫,৬০০ ডলার এবং জাপান ও ইউরোপের বড় বড় দেশগুলোতে এর খুব ভালো বাজারদর বিদ্যমান।
মায়ানমারের পাউ খান এলাকায় এখনও প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রথা অনুসরণ করে লোটাস ফেব্রিক উৎপাদন করা হয়।তবে সময়ের সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন এসেছে।বিশুদ্ধ লোটাস ফাইবার থেকে ফেব্রিক তৈরি অনেক বেশি ব্যয়বহুল হওয়ায় ফাইবারের সাথে প্রায়শই তুলা অথবা সিল্ক মিশিয়ে ফেব্রিক প্রস্তুত করা হয়।উল্লেখ্য যে, লোটাস ফাইবার ১০০% সিল্কের সাথে মিশে যেতে সক্ষম।অপরদিকে ১৫% লোটাস ফাইবার ও ৮৫% তুলা মিশ্রিত হয়ে নতুন ফাইবার উৎপাদনে সক্ষম।পাউ খন এলাকার মহিলারা ফ্লাইং শাটল লুম ব্যবহারের মাধ্যমে পরিষ্কার সিল্ক ও লোটাস ফাইবারকে একত্রিত করে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙ ও নকশার মাফলার তৈরি করে থাকেন।এসব মাফলার তারা নিজেদের এলাকায় ট্যুরিস্ট দের নিকট বিক্রি করেন।এছাড়াও লোটাস ফেব্রিকের অন্যান্য উৎপাদনের একটা বড় অংশ জাপানে রপ্তানি করা হয়।
এছাড়াও বর্তমানে অনেক কোম্পানি ঐতিহ্য অনুসরণের পাশাপাশি লোটাস ফেব্রিকে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি সংযোজন করছে।যেমন- কম্বোডিয়ার “সামাতোয়া লোটাস টেক্সটাইলস” কোম্পানিতে গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন ম্যানুফ্যাকচারিং পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়।এখানে অ্যাপারেল মেকাররা নিজস্ব উপায়ে লোটাস ফেব্রিক ব্যবহার করেন এবং নতুন নতুন ইকোফাইবার দ্বারা তা তৈরি করেন।আবার ভারতের “হিরোজ ফ্যাশন প্রাইভেট লিমিটেড” নামক কোম্পানি লোটাস ফেব্রিকের সাথে হাইড্রোফোবিক ন্যানোপ্রযুক্তি সংযুক্ত করে একটি সাদা শার্ট তৈরি করে।অন্যান্য ধর্ম ব্যতীত উক্ত শার্টের আরেকটি বিশেষত্ব হল এর উপর কফি,কালি,রেড ওয়াইন বা অন্য কোন তরল পড়লে এটি অন্যান্য পোশাকের ন্যায় নোংরা হবে না।বরং শার্টের উপর দিয়ে তরল গড়িয়ে যাবে কিন্তু তা আগের মতোই পরিষ্কার থাকবে।শার্টটির মোট প্রোডাকশন খরচ ছিল ৫৮.৫০ ইউরো।এর প্রচারের জন্য তখন বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পেইন করা হয় এবং ৮৫ ইউরো বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়।সেইসাথে ফ্রি শিপিং এর ব্যবস্থাও করা হয়।
💢লোটাস ফেব্রিকের যত্ন নেয়ার উপায় :
★হাত দিয়ে ধোয়া।
★ব্লিচ না করা।
★ইস্ত্রি করার দরকার নেই।
★ড্রাই ওয়াশের জন্য শুধুমাত্র পেট্রোলিয়াম দ্রাবক ব্যবহার করা।
⭕সোর্স : গুগোল, উইকিপিডিয়া।
সাদমান সাকিব
বস্ত্রকৌশল বিভাগ
২ক১৯
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।