সেই রবীন্দ্রনাথের হারিয়ে যাওয়া প্রেমের মেয়েটা হোক অথবা বাঙালির কোনো উৎসবে নারী- বাঙালি মেয়েদের জীবনের কোনো আয়োজনই কি পূর্ণতা পায় শাড়ি ছাড়া? বিয়ে, বরণ বা বিদায়- কোথায় নেই শাড়ির ছোঁয়া? আসুন আজ জানি কিভাবে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে শাড়িকে জড়িয়ে গড়ে উঠলো ভারতীয় উপমহাদেশের এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই রমণীয় এলাকা বিভাজনের অনুপাত শারীর রচয়িতারা কি জেনে না না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
শাড়ি নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম পোষাকগুলোর একটি ও বোধহয় একমাত্র জোড়া না লাগা পোষাক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটা কেবল আবেদনময়ী, জমকালো নৈমিত্তিক পোষাকই নয়, বরং হয়ে উঠেছে পোষাকশিল্পীদের অনবদ্য ক্যানভাস যেখানে তাঁতি, বুননশিল্পী ও নকশাকার সুতা, রং, নকশা ও চুমকি-পাথরের অনন্য খেলায় মেতে ওঠে।
বলা হয়ে থাকে যে, সুতা এবং কাপড় বোনার শিল্প ভারতবর্ষে এসেছিল মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা থেকে। সিন্ধু উপত্যকার নারী-পুরুষ উভয়ের কাছেই সুতা বুনন বেশ পরিচিত ছিল। ভারতে সুতা প্রথম চাষ ও বুনন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে। ঐ সময় সুতায় যে রঙ ব্যবহার হতো, তা এখনো ব্যবহার করা হয়; যেমন- নীল গাছ বা হলুদ থেকে পাওয়া রং। আর রেশমী কাপড় বোনা শুরু হয় ২৪৫০-২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে।
শাড়ির সর্বপ্রথম চিত্রায়ন পাওয়া যায় সিন্ধু প্রদেশের এক পুরোহিতের প্রস্তর মূর্তিতে। সিন্ধু উপত্যকার লোকেরা দীর্ঘ কাপড়ের টুকরা কোমরবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করতো। সভ্যতার শুরুর ইতিহাস বলে কাপড় পরিধানের পদ্ধতি শুধু সিন্ধু সভ্যতা নয়, মিশর, সুমের ও আসিরিয়াতেও প্রচলিত ছিল। ঐসব শহরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে মুদ্রা ও প্রস্তরমূর্তি পাওয়া গেছে, তা এই তথ্যই প্রমাণ করে।
আর্যরা যখন প্রথম দক্ষিণ ভারতের নদী অববাহিকায় আসে, তখন তারা তাদের সাথে এই ‘বস্ত্র’ বা ‘Vastra’ শব্দটা নিয়ে আসে। যদিও সংস্কৃত মতে এর অর্থ হলো কাপড় বা পোষাক, কিন্তু তারা তখন এই শব্দ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পরিধান উপযোগী আচ্ছাদনই বোঝাতো। এখানে আসার পর স্থানীয় অধিবাসীদের থেকে তারা প্রথম সুতায় বোনা লম্বা কাপড় পরিধানের অভ্যাস শুরু করে।
পনের শতকের প্রথম দিকে পর্তুগালের এক পর্যটকের বর্ণনা থেকে জানা যায় তখন মেয়েদের সারা শরীরে রেশম বা সুতির কাপড় জড়ানো দেখা যেতো। প্রথম শ্রেণীর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে, বিশেষ করে বিভিন্ন মহাকাব্যে, নারীদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সোনা ও বিভিন্ন মণি-মুক্তা খচিত শাড়িতে।
পরবর্তীতে কাব্য-সাহিত্যের ক্রমোন্নয়নের শুরু থেকে অপার সুন্দর ভঙ্গিমায় শাড়ি পরিহিত নারীরা সাহিত্যের মূল উপাদেয় হওয়া শুরু করলো। ফলে তারা নিজেদের পোষাকেও সুতা ও নকশার, ধনীরা বিভিন্ন মূল্যবান পাথরের ব্যবহার চালু করে। তখন তারা অলংকার পরাও শুরু করে। এই সময় থেকেই শাড়ির আঁচল সৌন্দর্যের জন্য প্রাধান্য পাওয়া শুরু করে এবং সিল্ক আলাদা করে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে যেন এই কারুকাজ ও নকশার উন্নতি এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যই এই সেলাইবিহীন কাপড়ের দীর্ঘ পোষাক তিন খন্ডে বিভক্ত হয়- নীভি কোমর ও নিম্নাংশ জড়িয়ে থাকতো, কাচুকি উপরের অংশে থাকতো এবং শালের মতো দীর্ঘ কাপড়টাকে বলা হত উত্তরীয়, যা পরবর্তীতে ঘুরিয়ে সামনে আনার চল হয়। কারণ সবচেয়ে বেশি কারুকাজ এই অংশেই থাকতো। তখন মেয়েরা সামাজিক মর্যাদা অনুসারে নিজেদের শাড়িতে পাথর বা সুতার নকশায় ভরিয়ে তুলতো।
সাহিত্যের যুগ এবং পুরাণের যুগে মেয়েদের মধ্যে শাড়ির একটা অংশ মাথায় তোলার কোনো প্রচলন ছিলনা, বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক কোনো নিয়মানুযায়ী তো নয়ই। তারা যদি কেউ তা করতো, তবে তা হতো পোষাকের কারুকাজ ফুটিয়ে তুলতে।
মোঘলদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনপদ্ধতি সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব রাখে। সেই সময় রাজপরিবারে ও বাইরে সালোয়ার কামিজের প্রচলন ঘটে, বিশেষ করে মোঘলদের আভিজাত্য এ দেশীয় ছেলেদের পোষাকে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। তবুও শাড়ি ভারতবর্ষের নারী-হৃদয়ে আপন আসনে নিজ গর্বে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকে। বর্তমানের শাড়ি আসলে প্রাচীনকালের ভারতের সেলাইবিহীন তিন কাপড়ের শাড়ি আর মোঘলদের আনা সেলাইকৃত কাপড়ের মিশ্রণ।
এভাবে শাড়ি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বর্তমানের মেয়েদের কাছে এসেছে। আর বর্তমানের শাড়ি পরার এই পদ্ধতিতে মূলত গ্রীক, ফরাসি ও মধ্য এশীয়দের প্রভাব জড়িয়ে আছে, রয়েছে শাড়ি তৈরীর পদ্ধতি, সুতার আর বুননের ধরনের মধ্যে ভিন্নতা। আর এই ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে বহু সময় আগে থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা বিভিন্ন ধরনের শাড়ির উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত; যেমন ঢাকাই জামদানী, কাশ্মিরী রেশমী সিল্ক, টাংগাইলের তাঁত বা মধ্য প্রদেশের মহেশ্বর শাড়ী। এই নামগুলো কেবল এগুলো উৎপাদনের মূল শহরের নাম থেকে আসেনি, বরং এসেছে বোনার কৌশল বা নকশার ভিন্নতা থেকেও। আর নতুন নতুন বোনার কৌশল, সুতার ভিন্নতা বা নকশার হরেক ধরনের সাথে তারা পরিচিত হয়েছে বিভিন্ন জাতির এদেশে আগমনের মাধ্যমে; যেমন- গুজরাট ও রাজস্থানের শাড়ি তৈরীর ধরনটা মূলত আসে মধ্য এশীয়দের হাত ধরে।
রূপ-বৈচিত্র্যে বাংলা যেমন মনোলোভা ও অনন্য তেমনি শিল্পে-ঐতিহ্যেও কিছুমাত্র কম যায়না। বাংলার শিল্প, ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি কারিগরি সূচারুতার মেলবন্ধন বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। বাংলাদেশী কাপড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে যেমন ঐতিহ্যের ইতিবৃত্ত তেমনি ঠাস বুনটের জালে আটকে গেছে যেনো বাঙ্গালিয়ানার নিপুণ আবেগ ও স্বপ্নের মিশেল।
ঢাকাই মসলিন, জামদানী; টাঙ্গাইলের তাঁত; রাজশাহী সিল্ক কিংবা মিরপুরের বেনারসী শৈল্পিক আভিজাত্যে যেরূপ অনুপম, গুণাগুণ ও মানে ততোধিক আকর্ষণীয়ও বটে! এগুলোর সমাদর বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে, আর এসবের ছোঁয়ায় সর্বত্র প্রস্ফুটিত বাংলার জয়ধ্বনি। এই লেখনীর সম্পূর্ণ নির্যাস তাই ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশী বস্ত্রের রং-সুতোর গল্পেরই প্রতিচ্ছবি।
মসলিন-
বাংলাদেশের ইতিহাসে আদি ও অকৃত্রিম ঐতিহ্যের এক অনন্য নাম মসলিন তথা ঢাকাই মসলিন। মসলিন অত্যন্ত সূক্ষ, মিহি, বিশুদ্ধ, উজ্বল এবং মোলায়েম একপ্রকার বস্ত্রবিশেষ যা মুঘল আমলের প্রাচীন বাংলার এক অপূর্ব সম্পদ ছিলো। অনেকের মতে ইরাকের বাণিজ্যনগরী মসুল থেকে মসলিন নামটি এসেছে। মসলিন মুঘল আমলের বাদশাহী ও খানদানী নারী-পুরুষ এবং উচ্চপদধারী বিত্তবানদের পোশাক ছিলো।
মসলিন প্রস্তুত করা হতো বর্তমান বাংলাদেশের সোনারগাঁও অঞ্চলে, এছাড়াও ধামরাই, তিতবাড়ি এবং জঙ্গলবাড়িতেও মসলিন বয়ন করা হতো। চিত্তাকর্ষক অপরূপ এ কাপড়টি বোনা হতো হাতে। চড়কায় সুতো কেটে হাতে বোনা এই মিহি কাপড় তৈরিতে প্রয়োজন হতো সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের এর সুতো। কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ মসলিন বয়নে ব্যবহৃত অতি চিকন সুতো ফুটি কারপাস নামক তুলো থেকেই তৈরি হতো। কোনরূপ প্যাটার্ন ছাড়াই দক্ষ হাতের কারিগরী দক্ষতায় তৈরি মসলিন এতটাই সূক্ষ ছিল যে একটি আংটির ভেতর দিয়ে প্রায় কয়েক গজ কাপড় প্রবেশ করানো যেত। কথিত আছে যে, মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সুক্ষ্ম ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।
সূক্ষতা, বৈচিত্র্য ও নকশাগত পার্থক্যের মাপকাঠিতে প্রায় আঠাশ প্রকার মসলিন ছিলো যার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছিলো ‘মলমল খাস’ এবং ‘মলবুস খাস’। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এগুলো তৈরি হতো খাস বা বিশেষ মানুষের জন্য। মলবুস খাস অর্থ খাস বা আসল কাপড় যা তৈরি হতো সম্রাটদের জন্য। মলমল খাস রপ্তানীও করা হতো। এছাড়াও, সরকার-ই-আলা, ঝুনা, আব-ই-রওয়ান, রঙ, তানজীব, চারকোনা, খাসসা, শবনম, সরবুটি, নয়ন সুখ, বদন খাস, সর-বন্ধ, ডোরিয়া, জামদানী প্রভৃতি রকম মসলিনের চল ছিলো যার প্রতিটিই ছিলো নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে অনন্য।
পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পতনের পর মসলিনের পৃষ্ঠপোষকতা কমতে থাকে এবং মসলিন ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে চলে যায়। এর পেছনে ব্রিটিশ কর্তৃক মসলিনের প্রতি অতিরিক্ত আরোপিত কর ও তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুলী কেটে নেয়াকে দায়ী করা হয়। আবার অনেকের মতে, তাঁতিরা নিজেরাই এই কাজ ছাড়ার জন্য আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলো। বর্তমানে ‘মসলিন’ নামক আধুনিক মিহি কাপড় বাজার দখল করলেও সেই আদি ও খাঁটি মসলিন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ক্বদাচিৎ কোন সংরক্ষণশালা, তৈলচিত্র কিংবা জাদুঘরেই আজ এর দেখা মেলে।
মসলিনের সোনালী দিন-
বাংলার মসলিন শিল্প তার সোনালী সময়ে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, কার্পাস উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি- পুরো চক্রটা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকার আশেপাশে চাষ হতো ফুটি কার্পাস। এই ফুটি কার্পাসকে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ পৃথিবীর সেরা জাতের কার্পাস বলে ধারণা করেন। এই কার্পাস চাষাবাদেও ছিল নানা ধরনের নিয়মকানুন। কার্পাসের বীজ বছরে দুইবার বপন করা হতো, শরত এবং বসন্তকালে। বসন্তকালের কার্পাস থেকে উৎপাদিত তুলাকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মনে করা হতো। সাধারণত মসলিন তাঁতিদের কেউ কেউ নিজের জমিতে কার্পাসের চাষ করতেন, অনেকেই চুক্তি ভিত্তিতে নিজের জমিতে কার্পাস চাষ করে মসলিন তাঁতিদের কাছ থেকে দাম বুঝে নিতেন। ভালো ফসল হলে বিঘাপ্রতি দুই মণ কার্পাসের ফলন পাওয়া যেত।
এরপর কার্পাস থেকে তুলা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া, বীজসহ কার্পাসকে বোয়াল মাছের চোয়ালের দাঁত দিয়ে বানানো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে তুলা থেকে অপদ্রব্য আলাদা করে নেওয়া হয়। এই কাজে দরকার দক্ষতা আর ভীষণ ধৈর্য। খুব ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে তাঁতিদের সন্তানদের হাতেখড়ি হতো এসব কাজে, ফলে পরিণত বয়সে এসে তারা খুবই দক্ষ হয়ে ওঠে।
এরপর তুলা থেকে সুতা কাটার কাজ শুরু হয়, এই কাজটি সাধারণত পরিবারের নারী সদস্যরা করে থাকতেন। শুকনো বাতাস বইতে থাকলে সুতা কাটা সম্ভব নয়, সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য বাতাসে আর্দ্রতা দরকার। তাই খুব ভোর থেকে শুরু করে সকালের রোদ উঠার আগে এবং বিকালে সূর্যাস্তের আগের সময়ে সুতা কাটার কাজটি করা হতো, এমন জনশ্রুতিও আছে আর্দ্র বাতাসের জন্য নদীতে ভাসমান নৌকায় সুতা কাটার কাজ করা হতো। সুতা কাটায় সূক্ষ্মতার জন্য দুটি গুণের দরকার ছিল, একটি প্রখর দৃষ্টিশক্তি, অন্যটি হাতের আঙ্গুলের প্রখর চেতনা শক্তি।
ঢাকায় নিযুক্ত ইংরেজ বাণিজ্য বিষয়ক কর্মচারী জন টেলরের ১৮০০ সালে মন্তব্য থেকে জানা যায় ঢাকায় উৎপাদিত কার্পাসের পাশাপাশি দক্ষ তাঁতি আর সুতা কাটুনীদের কারণেই মসলিনের সূক্ষ্মতার সুনাম ছিল বিশ্বজোড়া। ১৮১১ সালে এক ইংরেজ কর্মচারী আমেরিকা থেকে কার্পাস আমদানি করে ঢাকার তাঁতিদের কাছে দিয়েছিলেন, তার আশা ছিল সেই কার্পাস থেকেও অনুরূপ সুতা তৈরি সম্ভব। তবে অনেক চেষ্টা করেও তা করা যায়নি। অর্থাৎ ভৌগলিকভাবেই মেঘনা নদীর দুই কূলে পলি পড়া জমিতে ব্যাপকভাবে কার্পাসের চাষ করা হতো। আর সেই কার্পাস থেকে তুলা আর সুতা সংগ্রহে অনন্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল তাঁতিরা।
সুতার তৈরি হয়ে যাবার পর যাচাই করে হতো এর সূক্ষ্মতা, এই যাচাইয়ের প্রধান মাপকাঠি ছিলো অভিজ্ঞতা। বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা তাঁতিরা চোখে দেখে, হাত দিয়ে স্পর্শ করেই মসলিনের জন্য প্রস্তুত সুতার সুক্ষ্মতা যাচাই করতে পারতেন। সুতাকে প্রথমে ওজন নিয়ে তারপর মাটিতে ছড়িয়ে তা কতটুকু দীর্ঘ তা যাচাই করা হতো। দৈর্ঘ্য মাপার জন্য হাতের হিসেব ব্যবহার করা হতো অনেকক্ষেত্রে লাঠিও ব্যবহার করা হতো, ফিতার ব্যবহার অনেক পরে শুরু হয়। সুতাকে ওজন করা হতো ‘রতি’তে। এক রতি ওজনের সুতার দৈর্ঘ্য দাঁড়াত প্রায় ১৫০ থেকে ১৬০ হাত। যে সুতা লম্বায় যত বেশি কিন্তু ওজন কম তার সূক্ষ্মতাও তত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সুতা কাটার পর সেই সুতা থেকে কাপড় তৈরি শুরু হয়। হাতে চালানো তাঁতেই তৈরি হতো মসলিন। তাই একেকটি মসলিন তৈরিতে দীর্ঘ সময় লাগতো। সাধারণভাবে এক টুকরো ভালো মানের মসলিন তৈরিতে একজন তাঁতি ও তার সহকারীর ছয় মাস সময়ের প্রয়োজন হতো। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী তাতে নকশা, ফুল কিংবা অন্যান্য অনুষঙ্গ জুড়ে দিতে আরো বেশি সময়ের দরকার ছিল। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের ফলে ম্যানচেস্টারের কলে দিনে শয়ে শয়ে বস্ত্র তৈরি করা সম্ভব ছিল। তবে সূক্ষ্মতা আর সৌন্দর্যে মসলিনের ধারেকাছে ঘেষবার সাধ্য ছিল না কলের কাপড়ের। তবে বাজার দখলের দৌড়ে এগিয়ে যায় কলের কাপড়।
মসলিন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, বিশেষ করে মোগল সম্রাট এবং তার পরিবার পরিজনদের বিশেষভাবে মসলিন তৈরি করার রেওয়াজ ছিল। এদেরকে ভাগও করা হয় নানানভাবে। রঙ আর বুননের গাঁথুনির উপর ভিত্তি করে মসলিনকে ডোরাকাটা, মসৃণ, চারকোণা বিশিষ্ট ছককাটা আর রঙ করা এই কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। ‘আব-ই-রওয়ান’, ‘শবনম’, ‘সরবন্দ’ ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল একেকটি অভিজাত মসলিন। মোগল সম্রাট এবং তার পরিবার পরিজনের জন্য বিশেষভাবে তৈরিকৃত মসলিনের নাম ছিল ‘মলবুল খাস’। বাংলার সুবাদারদের জন্য তৈরি করা হতো ‘সরকার-ই-আলা’।
মুর্শিদকুলী খানের আমলে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ টাকার ‘মলবুল খাস’ মোগল সম্রাটের দরবারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকা আর সোনারগাঁয়ের তালিকাবদ্ধ তাঁতিদের হাতে তৈরি করা হতো এই বিশেষ মসলিন। এইধরনের মসলিন বাইরে রপ্তানি করার উপর বিধিনিষেধ ছিল।
জামদানী-
জামদানী প্রাচীন মসলিনের উত্তরাধিকারী যার জাম অর্থ ফুল এবং দানী অর্থ ধারণকারী পাত্র। প্রাচীনকালে নকশাদার মসলিন কেই জামদানী বলা হতো। জামদানী তার বাহারি নকশা ও চমৎকার কারুশৈলীর জন্য বিখ্যাত। হালে জামদানী নানা স্থানে তৈরী করা হলেও ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। জামদানী বয়নের অতুলনীয় পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি অনন্যসাধারণ ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বনেদি ও আভিজাত্যের প্রতীক জামদানী সর্বদাই বাঙ্গালী নারীর নিকট আদরণীয়। জামদানী বলতে আমরা মূলত শাড়ি বুঝলেও এটি দিয়ে কুর্তি, পাগড়ী, রুমাল প্রভৃতি এবং ১৭০০ শতকে শেরওয়ানি তৈরির চল ছিলো। কারপাস তুলা থেকে বানানো সুতার নানান রঙের বুননে গড়ে ওঠা নকশাবাহী জামদানী শুধু আভিজাত্যই নির্দেশ করেনা বরং এটি বিয়ের কনের ক্ষেত্রেও পছন্দসই পোশাক বটে।
জামদানীর নকশাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক মূল্যবান হলো ‘পান্না হাজারী’ নকশা যেখানে সোনালী-রুপোলী সুতোর দক্ষ চালনা ও সূচারু কারুকাজে কাপড়ে ফুটিয়ে তোলা হয় অনিন্দ্য সৌন্দর্য। শিল্পমন্ডিত নান্দনিক ঢাকাই জামদানীর নকশায় ফুটে ওঠে কলকি, ফুল, লতা কিংবা জ্যামিতিক কোন ধাঁচ যার অপূর্ব পরিস্ফুটন জামদানীকে করেছে বিপুল জনপ্রিয় ও স্বতন্ত্র। অন্যতম বয়নরীতি, বিন্যাস এবং সৌন্দর্যের জন্যই পুরো বিশ্বে জামদানী এক সমাদৃত নাম।
রাজশাহী সিল্ক-
বাংলাদেশী বস্ত্রশিল্পের জগতে রাজশাহী সিল্ক একটি বিখ্যাত ও অন্যতম নাম। সেরিসিন নামক প্রোটিনে আবৃত রেশম পোকার কোকুন বা গুটি থেকে তৈরি এ কাপড় অত্যন্ত নরম ও মোলায়েম। রাজশাহীতে তৈরি হয় বলে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। সিল্ক তিন প্রকার যেমন- মালবেরি সিল্ক বা পাট সিল্ক, এরি বা এন্ডি সিল্ক এবং তসর সিল্ক। মালবেরি সিল্ক ফকফকে সাদা কিংবা ফিকে সাদা হতে পারে, এটি অত্যন্ত উন্নত এবং ভেজা কাপড় ছায়ায় শুকিয়ে ফেলা যায়। উন্নত মান ও সৌন্দর্যের জন্য রাজশাহী সিল্ক বহন করে চলেছে আভিজাত্য ও আকর্ষণের এক অপরূপ উপাখ্যান।
বেনারসী সিল্ক-
১৯৫০ এর দিকে ঢাকায় এর বুনন শুরু হয়। বর্তমানে রাজশাহী সিল্ক, কৃত্রিম চাইনিজ রেশম প্রভৃতি দিয়ে বিভিন্ন রকম বেনারসী তৈরি হয়। রাজধানীর মিরপুরের বেনারসী পল্লী এই সকল শাড়ির অবাধ প্রাপ্তিস্থল। হাত ও পায়ের সাহায্যে চালিত তাঁতযন্ত্রে এই সকল শাড়ি বোনা হয়। বিভিন্ন রকম বেনারসীর মধ্যে কাতান, সার্টিন বেনারসী, কার্পেট বেনারসী, হানিকোট বেনারসী, রাজকোট কাতান, বালুচরী বেনারসী, চুন্দ্রী, সিল্ক কাতান, ফুল সিল্ক জামদানি, জামদানি কাতান, কন্টেস্ট কাতান অন্যতম। নানান উৎসব ও পার্বণে, আনন্দমেলা ও বিয়েতে কিংবা বাঙ্গালির বিশেষ অনুষ্ঠানে বেনারসী সিল্ক বাঙ্গালি নারীর একটি অন্যতম প্রিয় পরিধেয়।
টাঙ্গাইলের তাঁত-
বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক এই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী, নাগরপুর, সখীপুর এর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য তাঁতিপল্লী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক তাঁতিরাই তন্তুবায় গোত্রের যারা কিনা টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি। জগদ্বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ইবনে বতুতার কাহিনীতেও টাঙ্গাইলের তাঁতবস্ত্র শিল্পের উল্লেখ আছে। তাঁতপল্লীতে পুরুষেরা তাঁত বোনে। মেয়েরা করে চরকা কাটা, রং করা আর জরির কাজ।
তাঁতে তৈরি হয় নানান রঙ, নকশার নানাবিধ শাড়ি যেমন- জামদানী, হাফ সিল্ক, টাঙ্গাইল বি.টি, বালুচরি, জরিপাড়, হাজারবুটি, সূতিপাড়, কটকি, স্বর্ণচুড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, সানন্দা, নীলাম্বরী, ময়ুরকন্ঠী এবং সাধারণ মানের শাড়ি।
তাঁতের শাড়ি-
বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। ষাট ও সত্তরের দশকে, স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে ও পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিশেষভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। এর সূত্র ধরে বাংলাদেশে তাঁতের শাড়ি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণি—এই শহুরে নাগরিক পরিসরে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে ওঠে। ঢাকায় আশির দশকের গোড়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির এবং পরবর্তীকালে আরও অনেক বুটিক হাউস বা ফ্যাশন হাউসের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। শহরের মানুষের রুচি ও নান্দনিকবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁতের শাড়ি তৈরি ও বিপণনে এই সব ফ্যাশন হাউসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। উৎসবে-পার্বণে, বিশেষ কোনো উপলক্ষে বাঙালি নারীরা এখনো তাঁতের শাড়ি পছন্দ করেন। তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
খাদি-
বাঘা বাঘা কাপড়ের তুলনায় কুমিল্লার বিখ্যাত খাদিও শিল্পবৈচিত্র্যে মোটেও পিছুপা নয়। খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক স্বদেশী আন্দোলনের নাম। মহত্মা গান্ধী সে সময়ে সবাইকে চরকায় সুতো কেটে তা দিয়ে তৈরি মোটা কাপড় পরিধান করতে বলেছিলেন। কালপরিক্রমায় সেই আদি খাদি আজ যেমন পাতলা ও ফ্যাশনেবল হয়ে উঠেছে, তেমনি নিজের স্বতন্ত্র সাদা বা সাদাটে রঙের খোলস ছেড়ে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে নতুন সব রঙে। পাশাপাশি এতে শোভা পাচ্ছে বিশেষায়িত প্যাটার্ন বা চেক। খাদি দিয়ে পোশাকের পাশাপাশি পরদা, চাদর প্রভৃতিও তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে কুমিল্লা সদর, চান্দিনা, দেবীদ্বার এবং মুরাদনগরের তাঁতিগণ খাদি উৎপাদন করে যাচ্ছেন। বাংলার কৃষ্টি, ইতিহাস, বাজার ও ঐতিহ্যে খাদি একটি শক্ত স্থান দখল করে আছে।
পাট-
বাংলাদেশের সোনালি আঁশ নামে পরিচিত এই পাট থেকেও বহুকাল যাবত কাপড় তৈরি হয়। পাটের তৈরি কাপড় পরিবেশবান্ধব ও পচনশীল। পাটের তৈরি কাপড় নরম ও আরামদায়ক এবং কোন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া নেই বলে এর চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কটন-
তুলা থেকে তৈরি তাঁতে বোনা এই কাপড় গুলি খুবই আরামদায়ক এবং যুগোপযোগী।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই সকল কাপড় যেমন কালের নানান অধ্যায়ের সাক্ষী তেমনি বর্তমান ফ্যাশন ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলারও উপযোগী। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও দিকনির্দেশনাই পারে বাংলার এই অমূল্য সম্পদ কে এক অনন্য উচ্চতা ও যথাযথ মর্যাদা।
Source: roar.media
Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador-TES
NITER (10th Batch)