কুয়াশা ভরা শীতের সকাল , প্রেয়সীর হাত ধরে কোনো এক নির্জন রাস্তায় হাঁটা কিংবা রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ে শরীরে উষ্ণতা ধরে রাখা অথবা বন্ধুদের সাথে কোনো এক বিকেলে নদীর ধারের শীতল হাওয়ার খেলায় নিজেকে বিলিয়ে আড্ডায় মাতা এই সবকিছুর পূর্ণতা যেন অপেক্ষা করে থাকে কোনো এক মৃদু উষ্ণ অনুভুতির জন্যে। আর সেই অনুভূতি যেন লুকিয়ে থাক শাল বা চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নেওয়ার মাঝে। শীত নিবারণের জন্যে যত আধুনিক পোশাকই থাকুক না কেন অনুভুতির জায়গা জুড়ে শাল বা চাদরের গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। বর্তমান সময়ে শীতের আধুনিক এত সব পোশাক থাকতেও ,শীত নিবারণের পাশাপাশি সাজসজ্জাতে শাল বা চাদরকে এক বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর সেই শাল যদি হয় কাশ্মীরি শাল তাহলে তো কথাই নেই। বহু যুগ ধরে অভিজাত্যের প্রশংসার তালিকায় রয়েছে এ শাল।
“মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে,ডেকেছে রৌদ্রকে,
ডেকেছে তুষার উড়িয়ে দেওয়া বৈশাখী ঝড়কে,
পৃথিবীর নন্দন কানন কাশ্মীর।“
সেই কবে লিখেছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য ।প্রকৃতির বিস্ময় কাশ্মীরের সৌন্দর্য, তুষার,হিম শীতল হাওয়া, ডাল লেকে শিকারা-বিহার,চিনার গাছের সারি ছাড়াও কাশ্মীরের আর এক সম্পদ হল কাশ্মীরি শাল।
কাশ্মীরি শাল এর তিনটি ভাগ রয়েছে-১।শাহতুষ ২।পশমিনা ও৩।রাফল।
কাশ্মীরের বিখ্যাত শাল হচ্ছে পসমিনা। ভেড়া ও বকরির পশম দিয়ে তৈরি হয় এই শালের সুতা ।এক একটি শাল এতই মিহি যে তা আংটির ভেতর দিয়ে পার করা যেত। সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে পসমিনা শালের। শাহজাদা দ্বারা শিকো রানাদিলকে হিরের আংটি পরাতে গেলে তিনি নাকি তা ফিরিয়ে দেন। তখন এক যাদু দেখান শাহাজাদা। ঐ আংটির মধ্যদিয়েই অক্লেশে গলিয়ে দিলেন এক বহুমূল্য শাল। সেটিই ছিল পসমিনা শাল। কাশ্মীরি পশমিনারই বিশ্ব ভরা নাম। তার চয়ন ও বয়ন রীতিটিও বেশ আকর্ষক। হিমালয়ের উঁচুতে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রিতে তুরতুর করে ঘোরে ক্যাশমিয়ার ছাগল। চ্যাংপা যাযাবররা চিরুনি দিয়ে তাদের বাড়তি লোম ঝরিয়ে আনেন। রিফুকার চরকা কেটে তৈরি করেন পসমিনা উল যা সাধারণ সুতা থেকে ছয় গুণ পাতলা তিন গুণ উষ্ণ। যত ভাল পসমিনা , তত বেশি মিহি ও উষ্ণ।
প্রচলিত আছে , নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তার স্ত্রী সম্রাজ্ঞী জোসেফাইনকেও উপহার দিতেন কাশ্মীরি শাল। সম্রাজ্ঞী ওই শাল গায়ে জড়িয়ে ফ্যাশন শো’তে অংশ নিতেন। কাশ্মীরি শালের কদর কেবল যে বাংলায় ছিল তা নয়, ইউরোপেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। রাজা বাদশাদের দম্ভ করার মতো পোশাক ছিল এই কাশ্মীরি শাল কেননা এর অধিক মূল্যের কারণে এটি সহজলভ্য ছিল না। কাশ্মীরি শালের দীর্ঘ স্থায়িত্ব অনেক বেশি যত্ন করে রাখলে এর আয়ু ১০০ বছর পার করে।
মানে ও ঐতিহ্যে শেষ কথা এই কাশ্মীরি শালের বাজার আজ ছেয়ে যাচ্ছে মেশিনে বোনা নকল শালে। আমরা অনেকেই জানিনা এই শালে GI ট্যাগ থাকে, যার কারণে মানুষ ঠকে যাচ্ছেন নকল শাল কিনে। পশমিনা শাল বলে মেশিনে বোনা নকল শাল বিক্রি হচ্ছে চওড়া দামে। পশমিনা ভেড়ার লোম ছেঁটে কাস্মীরের শাল শিল্পীরা দীর্ঘ পরিশ্রমে একটি শাল তৈরি করেন। কিন্তু মেশিন ও নকল কাশ্মীরি শালে বাজার ছেয়ে যাওয়ায় খারাপ অবস্থা পশমিনা শাল শিল্পীদের। অনেকদিন আগে থেকেই অবস্থাটা শোচনীয়। অনেক লড়াই করে পশমিনা শালে GI ট্যাগ পেয়েছে পশমিনা শাল।
অতীতের মতো বর্তমানেও কাশ্মীরি শাল আভিযাত্যের প্রতীক। একটি শাল তৈরির পেছনে থাকে একজন শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম , ব্যয় করা অনেকটা সময়। যার দরুন এই শালের দাম বাজারের অন্য যেকোন শালের তুলনায় বেশি। তবে এই শাল অন্য যেকোন শালের তুলনায় টেকসই ও আরামদায়ক।
তবে যাই হোক হিমধরা কনকনে শীতের মাঝে একটি কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার ব্যাপারটাই অন্যরকম। এক দিকে যুগের সাথে তাল মেলানো আভিজাত্যে পরিপূর্ণ পোশাকও পড়া হয় অন্যদিকে কনকনে শীতেও সমস্ত শরীরকে উষ্ণতার ছোঁয়া পাওয়ানো সম্ভব হয়।
Writer:Abida Ferdousi
Department of Textile Engineering
BGMEA University of Fashion & Technology (BUFT)