“দূর্বল মস্তিষ্ক কিছু করিতে পারেনা। আমাদিগকে উহা বদলাইয়া সবল মস্তিষ্ক হইতে হইবে। তোমরা সবল হও,গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের সমীপবর্তী হইবে।“-স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণীটি এতক্ষণ পূষণকে শোনাচ্ছিলেন তার মামা। যিনি সম্প্রতি বাংলায় মাস্টার্স করে চাকরির প্রস্তুতির জন্য ঢাকায় এসেছেন পূষণদের বাসায়।
আর পূষণ? সেতো তার বাবা-মায়ের কাছে খুবই অশান্ত আর বাকপটু একটা ছেলে!! এক মুহূর্তের জন্যও তার মুখ বন্ধ থাকেনা.! প্রতিটা বিষয়েই তার অনেক কৌতুহল আর খুঁতখুঁতে ভাব। সবসময় সারা বাড়ি এদিক ওদিক শুধু ছুটোছুটি করে বেড়ায়। বাচ্চামীর গন্ধ এখোনো যায় ই নি.!
আর এজন্যইতো কিছুক্ষণ আগে তার মামার কাছে খেলা নিয়ে বিখ্যাত কোনো মনীষীর বাণী জানতে চেয়েছিলো। মামাও তার জ্ঞানভাণ্ডার ঘেঁটেঘুটে ভাগ্নের কৌতুহল মেটালেন।
হঠাৎ করে কি যেন মনে হলো পূষণের.! মামার অনেক ডাকাডাকির পরেও একমুহূর্তের জন্যও পেছন ফিরে তাকালো না। এক দৌড়ে চলে গেলো তার দাদীর রুমটায়। তার দাদী দু’মাস হয় তার ফুপি বাড়িতে গেছেন,তাই এদিকটায় তেমন কেউ আর আসেনা। আর এই সুযোগে মায়ের বকা খাওয়ার ভয়ে তার বানানো সব জিনিসগুলোর বাসস্থান এখন এই রুমটা।
দাদীর বিছানার নিচে একটা বল রেখেছিলো পূষণ। কিন্তু,এখন খুঁজে পাচ্ছেনা। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় এই বলটার কথাই তার বাবাকে বলেছিলো। তার বাবার রিসার্চ রুমে নতুন একটা বল দেখেই বুঝে গিয়েছিলো যে নিশ্চয়ই তার বাবার পরবর্তী এক্সপেরিমেন্ট এই বলকে নিয়েই.!তাই স্কুলে যাওয়ার সময় সে নিজ থেকেই তার বানানো বলটার কথা বলছিলো।এতেই তার বাবা বুঝে গিয়েছিলেন যে পূষণ তার বাবার এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কিছু শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু অফিসের তাড়া থাকায় কিছুই বলেননি। রাতে বাসায় ফিরে তার বানানো বল দেখতে চেয়েছেন। পূষণ মহাখুশি হয়ে আর কোনো প্রশ্ন না করেই বাধ্য ছেলের মতো স্কুলে ঢুকেই আজ আর কোনোদিকে না যেয়ে সোজা ক্লাশরুমে চলে গেছে।
সারাটা দিন আজ ভীষণ নিরামিষ ভাবে কেটেছে তার। ক্লাসে ঠিকমতো মনোযোগই দিতে পারেনি।কখন বাসায় ফিরবে,কখন রাত হবে,কখন বাবা ফিরবেন,বলটা কখন বাবাকে দেখাতে পারবে সেই চিন্তায় মগ্ন ছিলো। গতকাল বিকেলে খেলতে গিয়ে বল হারিয়ে যাওয়ার পর সে খবরের কাগজ দিয়ে এটা বানিয়েছিলো। সেই বলটিই পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন পেলোনা,তখন সোজা চলে গেলো রান্নাঘরে। গিয়েই ফুলিকে জিজ্ঞেস করলো,’’ এই ফুলি আপা,দাদীমার বিছানার নিচে যে একটা বল রেখেছিলাম দেখেছিস?’’ফুলি পুষণদের বাসায় তিনবছর হয় এসেছে,কিন্তু একবারের জন্য হলেও তাকে পরিবারের বাইরের কেউ বলে মনেই হয় না। ফুলি,’’ওইযে কাগজের পুটলির মতো কি যেন একটা ছিলো,ওইটা..!!’’ পূষণ অনেক গর্বের সাথে বললো,”ওইটা পুটলি নারে ,ওইটা বল,আমি বানিয়েছি! বাবাকে দেখাবো বলে মায়ের ভয়ে লুকায় রাখছিলাম।‘’
পূষণের কাজই এটা।সবসময় তার বাবার এক্সপেরিমেন্টকে নকল করার চেষ্টা করে।সারাবাড়ির আনাচে কানাচে তার বানানো জিনিস পড়ে থাকে।আর ফুলি প্রায় সময়ই সেটা ফেলনা জিনিস মনে করে ফেলে দেয়। আজকেও তাই হয়েছে।ফুলি রান্না বাদ দিয়ে কোনো কথা না বলে সোজা গিয়ে ময়লা রাখা ঝুড়িতে খুঁজতে লাগলো।ভাগ্যিস পেয়ে গেলো।নাহলে,পূষণ পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো।
রাত আটটা.! কাঙ্ক্ষিত জিনিস হাতে পেয়ে কোনো দেড়ি করলো না পূষণ। সোজা চলে গেলো বাবার রিসার্চ রুমটায়। তার বাবা একজন টেক্সটাইল রিসার্চার,মা ডাক্তার।দুজনেরই ফিরতে আরো দেড়-দুই ঘন্টার মতো আছে। সচরাচর নয়টা থেকে দশটার মধ্যেই ফেরেন পূষণের বাবা-মা।
প্রতিদিনকার মতো আজকেও তারই বানানো ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে অনায়াসেই ঢুকে পড়লো। যদিও তার বাবা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন,কিন্তু কিছু বলেন না। পূষণ একটু অশান্ত হলেও আজ পর্যন্ত রিসার্চ রুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি,তার বাবা বরং তার এই কৌতুহলী আর খুঁতখুঁতে স্বভাবটাকেই পছন্দ করেন,কিন্তু প্রকাশ করেন না।এমন হয় যে পূষণের থেকেই মাঝে মাঝে এমন সব তথ্য আর ইউনিক আইডিয়া পান যেটা তার এক্সপেরিমেন্ট এর অনেক কাজে লাগে। মাঝে মাঝে তো তিনি এইটুকুনি ছেলের মাথায় এমন বুদ্ধি দেখে হতভম্ব হয়ে যান।
পূষণ রিসার্চ রুমে ঢুকলেই এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখে।কিন্তু,আজ আর তা করলো না। সোজা বাবার এক্সপেরিমেন্ট টেবিলটার দিকে চলে গেলো।তার বানানো বল আর তার বাবার বলটার দিকে ভালোভাবে দেখতে লাগলো। দুইটা বল দিয়েই একটু খেলে দেখলো। তার বলটা খবরের কাগজ কয়েক টুকরা করে ছিঁড়ে বেশ কয়েকটা প্যাচ দিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা। আর তার বাবার বলটায় ভালো করে গুণে গুণে দেখলো ৮২টি সেলাই দেয়া,আর একটু হালকা তবে শক্ত। আর পূষণ ক্রিকেট খেলার সময় যে বলটা সচরাচর ব্যবহার করে সেটা আরো হালকা। একদিন মেপেও দেখেছিলো সে, ১৩৩গ্রামের মতো ছিলো বলটার ওজন। সামনে ডিজিটাল পাল্লাটা দেখে তার বাবার বলটাও মেপে একবার পরখ করে দেখলো ১৫৯.৫ গ্রামের মতো হবে। এর আগেও সে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অনেকবার বোলিং করেছে,বলটা অনেক বার হাতে নিয়ে দেখেছেও! কিন্তু এখনকার মতো অতো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি।
হঠাৎ তার চোখ পড়লো হোয়াইট বোর্ডের দিকে..!!!!
(টু বি কন্টিনিউড…..)
লেখক –
মল্লিকা রাণী
ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং (১ম ব্যাচ)
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।