গত পর্বের পর… চোখ খুললো। আসার সময় ড্রিমিং ক্লথ নিয়ে আসছিলাম, সেটা পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টের পাইনি। কিন্তু বেড ড্রিম দেখবো সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। যাইহোক সবকিছু স্বাভাবিক দেখে ভালো লাগছে। স্পেকটোকোরাল গ্যালাকটিকে পৌঁছাতে এখনো ৭ দিন লাগবে। কয়েক ধরনের পোশাকের স্যাম্পল নেয়া হয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাপমাত্রা সংবেদনশীল পোশাক (এই পোশাকের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো এটি শরীরকে উষ্ণ ও শীতল রাখে), বায়োলজিক্যাল প্রোটেকশন ফেব্রিক (যেটা মানুষকে মহাকাশে ভিনগ্রহের জীবন ক্ষতিগ্রস্থ করা থেকে বিরত রাখে), ইন্টিমেসি ২.০ (একটি বিশেষ ধরনের পোশাক যা বিশেষ মুহূর্তে ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ হয়ে যেতে সক্ষম) এরকম প্রায় ১০০+ পোশাকের স্যাম্পল নিয়ে স্পেকটোকোরাল গ্যালাকটিকের দিকে ছুটে চলছে আমাদের নভোযানটি। এভাবে দেখতে দেখতে আবার আমারা সেই স্পেকটোকোরাল গ্যালাকটিকে ফিরে আসলাম। মিঃ জুকের নিকট পোশাকের স্যাম্পল গুলো আমি আর আরশিল বুঝিয়ে দিলাম। মিঃ জুক আমাদের সাথে কথা বলতে লাগলো–সত্যিই আপনাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে হয়। কি কি ধরনের পোশাকের স্যাম্পল এনেছি জানতে চাইলে আরশিল প্রথম থেকে সব বলতে শুরু করলো। আর এইদিকে মিঃজুক পোশাকের স্যাম্পল গুলোকে বিজ্ঞানাগারে পাঠানোর ব্যাবস্থা করলেন। হঠাৎ কানের মধ্যে শব্দ ভেসে উঠলো। আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদ থেকে সভার আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের উপস্থিত থাকার জন্য ডাক দেয়া হয়েছে। আমরা মিঃজুক থেকে বিদায় নিয়ে বিজ্ঞান পরিষদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদের সভাকক্ষ। মাঝারি আকারের সভাকক্ষের মাঝখানে গোলটেবিলের চারদিকে অনেকগুলো রিভলবিং চেয়ার। একপাশের একটি চেয়ার অন্য চেয়ারগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। দেখেই মনে হয় এটি বিশেষ কারো জন্য নির্ধারিত। সাধারণ চেয়ারগুলোতে বসে আছেন ১৩-১৪ জন লোক। সবার মুখ গম্ভীর, সামনে রাখা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পর্দায় চোখ। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। বিশেষ চেয়ারটি খালি। কতক্ষণ পর বিপ শব্দে বিশেষ চেয়ারটির পেছনের দেয়ালের একটি জায়গা একপাশে সরে গেল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সেদিকে। কয়েক সেকেন্ড পর সেই দরজা দিয়ে এলেন একজন। সাদা পোশাক, হাতে একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস। তার চেহারায় গাম্ভীর্য থাকলেও নির্ভার একটি ভাব রয়েছে। যেন অনেকক্ষণ বিশ্রামের পর উঠে এসেছেন। সভাকক্ষের সবাই উঠে বিশেষ একটি ভঙ্গিতে সম্মান জানালেন আগন্তুককে। তিনি হাত তুলে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বসে পড়লেন নিজের আসনটিতে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন একে একে সবাইকে। তারপর ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলেন, সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ, আমরা সভার কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। সবাই ওপর-নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন।আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদের বিশেষ সভা এটি। সাধারণত প্রতি মাসে একবার এই অডিটোরিয়ামে মিলিত হয় পরিষদের প্রতিনিধিরা; কিন্তু এটি বিশেষ মিটিং, নির্ধারিত মিটিংয়ের এক সপ্তাহ আগেই এই মিটিং ডাকা হয়েছে। মিটিংয়ের জন্য যারা উপস্থিত হয়েছেন তারা বিভিন্ন গ্রহে বিজ্ঞান পরিষদের মনোনীত প্রতিনিধি। বিশাল এই সৌরজগতের সমস্ত মানব সম্প্রদায়ের জীবনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক এই আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদ। আগের দিনে যাদের শাসক বা সরকার বলা হতো অনেকটা তেমনই এই বিজ্ঞান পরিষদের কাজ। সৌরজগতের ১১টি গ্রহে মানববসতি রয়েছে। সব গ্রহের শাসনব্যবস্থা এখন একযোগে পরিচালিত হয় একটি কেন্দ্র থেকে। আর এর নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞান পরিষদ। অর্থাৎ পুরো সৌরজগতের শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ফোরাম এই বিজ্ঞান পরিষদ। পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতি গ্রহে এক দশকের জন্য দুইজন করে প্রতিনিধি মনোনয়ন করা হয়। তারাই ওই গ্রহের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শাসন পরিচালনা ও এর জন্য বিজ্ঞান পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সেই প্রতিনিধিদেরকে। আসলে তাদের করার খুব বেশি কিছু নেই। জ্ঞান- বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে সব কিছুই এখন একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে। মানুষের করার খুব বেশি কিছু নেই। কাজ বলতে যা বোঝায় সেগুলো করে কম্পিউটার আর রোবট। পৃথিবীতে প্রথম কাতারে থাকা পোশাক শিল্পের দেশগুলো এমন এমন পোশাক আবিষ্কার করেছে যার সাহায্যে প্রায় সব ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ, ফলে হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। মৃত্যু ছাড়া মানুষের কষ্টের আর কোন উপাদান নেই বললেই চলে। অপরাধ কমে গেছে, ফলে আদালত, জেলখানা, পুলিশ কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রয়োজনীয়তা অনেক বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে যে জনবল দরকার তাতে দশম প্রজাতির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই প্রতিটি গ্রহে বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিনিধিদের খুব বেশি কিছু করার নেই। কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টারে বসেই তারা গ্রহের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি স্থান থেকে সব কিছুর রিপোর্ট চলে আসে কমান্ড সেন্টারে। প্রত্যেক মানুষের রয়েছে চলাচল ও কর্মকাণ্ডের অবাধ স্বাধীনতা। যে গ্রহেই জন্ম নিক না কেন, সৌরজগতের যে কোন স্থানে বসবাস করার অধিকার রয়েছে তার। প্রতিটি গ্রহের নাগরিক ও সমাজব্যবস্থার মধ্যেও দারুণ সুসম্পর্ক।
বিজ্ঞান পরিষদের সবগুলো পদেই মানব ও এলিয়েন সম্প্রদায়ের সেরা বিজ্ঞানীরা বসে আছেন। বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে এমন করেছে যে, বিজ্ঞানে যে যত দক্ষ সে ততটা যোগ্য হিসেবে বিবেচিত। তাই পুরো সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণই এখন বিজ্ঞানীদের হাতে। ৩০ বছর আগে সব গ্রহের বিজ্ঞানীরা মিলে গঠন করেছেন আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদ। পরিষদের বর্তমান প্রধান বিজ্ঞানী জেন হিউক। প্লুটোতে জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞানীই মূলত সর্বাধুনিক এই শাসনব্যবস্থার রূপকার। তরুণ বয়সেই তিনি প্রাণী সম্প্রদায়ের সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান সভ্যতার যত যুগান্তকারী আবিষ্কার তাতে তারই অবদান বেশি। তিন দশক আগে তার নেতৃত্বেই গঠিত হয় বিজ্ঞান পরিষদ, তার প্রস্তাবিত এই এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী এত প্রশংসিত হয় যে, সব নাগরিক এক বাক্যে এটি মেনে নেয়। বিজ্ঞানী জেন হিউক বললেন, ‘সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ আপনাদের আহ্বানেই আজকের এই সভা। তাই আমি চাই আপনাদের পক্ষ থেকেই আলোচনা শুরু হোক।’হাত তুলে কিছু বলার অনুমতি চাইলেন বৃহস্পতি গ্রহের প্রতিনিধ থম নু। জেন হিউক সম্মতি দিলেন।থম নু বললেন, ‘মহামান্য প্রধান, আপনি জানেন এলিয়েন সম্প্রদায় একটি দুর্যোগের মুখোমুখি। বেশ কিছুদিন ধরেই একযোগে প্রায় সবগুলো গ্রহে পোশাক নিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ সেই আদিম যুগ থেকেই এই বিষয়ে অন্য গ্রহের তুলনায় এগিয়ে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা প্রায় সব সমস্যাই দূর করেছি; কিন্তু পৃথিবীর মানুষের সাহায্যের অভাবে পোশাক নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। পৃথিবীর প্রতিনিধিও আমাদের সাথে আছেন। প্রথম দিকে বিষয়টিকে তাই আমরা গুরুত্ব দেইনি; কিন্তু সম্ভাব্য সব উপায়ে চেষ্টা করেও আমরা এবারের সমস্যাটি মোকাবেলা করতে পারছি না। এ বিষয়ে আলোচনার জন্যই আজকের বৈঠকের অনুরোধ করেছি আমরা’।একটানা কথা বলে থামলেন থম নু। জেন হিউক বললেন, ‘আর কেউ কিছু বলবেন?’
চলবে….