বিস্তীর্ণ একটি খোলা জায়গায় থামলো আমাদের স্পেসশিপ। অনেকখানি খোলা জায়গা, একটু দূরে কয়েকটি ছোট টিলারমত উঁচু জায়গা। টিলাগুলোর পাদদেশে কিছু পাথর পড়ে রয়েছে। কাঁকড় আর বালু মিশ্রিত মাটি পায়ের তলায়, মাথার উপরে হালকা গোলাপি আকাশ। বেশ দূরে কিছু বড় পাহাড়ও দেখা যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন এডাম হিক আমাদের আবারও বুঝিয়ে দিলেন মিশনের সকল বিষয়। কখন কী করতে হবে, কোথায় থাকতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন যত্ন সহকারে। ছোটখাটো কিছু কাজও দিলেন আমাদের দু’জনেক।
দু’জন বলতে আমি আর জ্যাক। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এই মিশনে আমরা যুক্ত হয়েছি শিক্ষানবিস হিসেবে। সারা পৃথিবী থেকে নাসা মাত্র দু’জন ছাত্রকে সুযোগ দিয়েছে তাদের এই মঙ্গল অভিযানে অংশ নেয়ার। আমি আর জ্যাক সেই ভাগ্যবান দুই কিশোর। মিশনের মূল দায়িত্বে রয়েছেন তিনজন মার্কিন মহাকাশচারী। আমাদের কাজ শুধু তাদেরকে দেখে দেখে মহাকাশবিষয়ক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন। আমরাই পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ অভিযাত্রী কিশোর।
প্রথমবারের মতো অন্য কোন গ্রহে মানুষের অভিযান এটি। এর আগে রোবট দিয়ে অনেক অভিযান পরিচালনা হয়েছে। কিন্তু এবার নাসার বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মঙ্গলের পরিবেশটা স্বচক্ষে দেখার। তাই প্রখ্যাত মহাকাশচারী এডাম হিকের নেতৃত্বে এই অভিযান। অভিযানের উদ্দেশ্য মঙ্গলের পরিবেশে আসলেই মানুষের পক্ষে বসবাস করা সম্ভব কিনা তা যাচাই করা। বেশ কয়েক বছর আগেই মঙ্গলের মাটিতে ক্ষুদ্র কিছু প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা চাচ্ছেন এই অভিযানের পর যাতে মঙ্গলের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়। কারণ মঙ্গল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা করে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
দল বেঁধে নেমে এলাম আমরা মঙ্গলের মাটিতে। বুকের ভেতর অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। এতদিন বইয়ের পাতায় কত লেখা পড়েছি মঙ্গল গ্রহ নিয়ে। আজ সেই মঙ্গলের মাটিতে হাঁটছি আমি! পরিবেশের সাথে পুরোপুরি মিল রাখার জন্য পৃথিবীর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশটি আমাদের স্পেসস্যুট তৈরি করে দিয়েছিল। এই পোশাকে এমন এমন প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মঙ্গলে অবতরণ করেও আমরা পৃথিবীর স্বাদ পাচ্ছি। আমাদের দলের তিন মহাকাশ বিজ্ঞানী মঙ্গলের মাটিসহ সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। টিমের দ্বিতীয় ব্যক্তি ফ্রেলান ট্রান্সমিটারের সাহায্যে প্রতি মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীতে নাসার কন্ট্রোল টাওয়ারে। আমি আর জ্যাক দেখতে লাগলাম জায়গাটাকে ভালোভাবে। তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নভোচারীর চেয়ে পর্যটক ভাবটাই বেশি। মনে হতে লাগলো যেন অপরিচিত কোন জায়গায় পিকনিক করতে এসেছি।
কতক্ষণ পর ফ্রেলান দলনেতা হিককে সঙ্কেত দিলেন, তার ট্রান্সমিশন রেডিওতে অচেনা কোনো সিগন্যাল ধরা পড়ছে, তবে তিনি বুঝতে পারছেন না সিগন্যালটি কিসের। সবাইকে যার যার স্পেসস্যুটে যুক্ত করা ট্রান্সমিশন রেডিও অন করতে বললেন তিনি। এরপর শব্দটা শুনতে পেলাম আমরাও। খুবই হালকা একটি শব্দ আসছে কোথাও থেকে। থেমে থেমে হচ্ছে শব্দটা। কেউই ধরতে পারলাম না আওয়াজটা কিসের হতে পারে। ক্যাপ্টেন হিকের গলা পেলাম রেডিওতে। বললেন-
‘প্রিয় নভোচারীরা, মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অচেনা একটি ভয়েজ ট্রান্সমিশনের সিগন্যাল পাচ্ছি আমরা এই মুহূর্তে। এখনও বুঝতে পারছি না আওয়াজটা কিসের। তবে মনে হচ্ছে খুব উচ্চমাত্রার ট্রান্সমিশন রেডিও দিয়ে কোথাও ডাটা আদান প্রদান করা হচ্ছে।’
‘কিন্তু স্যার!’ জ্যাক কথা বলে উঠলো ‘এখানে এই মঙ্গলের রুক্ষ প্রান্তরে তো আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। এখানে কে কার সাথে যোগাযোগ করবে? তেমন কেউ কি আছে এখানে?’ জ্যাক সব সময়ই একটু চঞ্চল আর চটপটে স্বভাবের। প্রচন্ড কৌতূহল ওর মাঝে।
‘সেটাইতো রহস্য আমাদের কাছে। কিন্তু যে ভয়েজটি আমরা শুনলাম সেটি তো মিথ্যা নয়। কিছু একটা নিশ্চয়ই হচ্ছে এখানে। তাই ভালোভাবে সবকিছু খেয়াল রাখতে হবে। সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।’
হাঁটতে হাঁটতে একটি টিলার পাদদেশে এসে পৌঁছলাম আমরা। এবার সেই অচেনা সঙ্কেতটি আরও জোরালো হলো। আমাদের বিজ্ঞানীরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। ক্রমেই বাড়তে থাকলো শব্দের পরিমাণ। বুঝলাম আশপাশেই কোথাও আছে সেই অচেনা শব্দের উৎস। খুব সাবধানে চারপাশে নজর বুলাতে লাগলাম সবাই। একটু দূরে একটি পাথর খন্ডের আড়ালে ফ্রিলান আবিষ্কার করলেন সেই শব্দের উৎসটিকে। মাটিতে পোঁতা স্ট্যান্ডের মাথায় তিন ফুট উঁচুতে একটি কালো যন্ত্র। আয়তনে দেয়ালঘড়ির মতো হবে। এক পাশ দিয়ে হালকা আলোক রশ্মি ঠিকরে বেরোচ্ছে। সবাই খুব অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম এই প্রাণহীন জায়গায় কে স্থাপন করলো ট্রান্সমিশন রেডিও। এমন সময় কিছু শব্দ শুনে সেদিকে তাকালাম সবাই। আমাদের অবাক করে দিয়ে টিলার আড়াল থেকে বের হয়ে এলো একদল লোক। গুনে দেখলাম সংখ্যায় আটজন তারা। তবে লোকগুলো দেখতে অদ্ভুত চেহারার। স্বাভাবিক মানুষের শরীরের চেয়ে বেশ চিকন। স্পেসস্যুট পরার কারণে আমরা একেক জন যেখানে তিনজনের সমান মোটা হয়ে গেছি সেখানে এই লোকগুলো এত চিকন থাকে কিভাবে! তাহলে কি ওরা স্পেসস্যুট পরেনি! তা কিভাবে সম্ভব, এই পরিবেশে যেখানে এখনও মানুষ টেকা সম্ভব নয়। এ সময় ট্রান্সমিশন যন্ত্রে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। আমাদের দলের কারও নয় গলাটা। এক মুহূর্ত পরে বুঝতে পারলাম কণ্ঠটা সেই অচেনা লোকদের। ‘স্বাগতম হে পৃথিবীবাসী’ এটুকু বলে থেমে গেল কণ্ঠটা। ‘কারা তোমরা? এখানে কোথা থেকে এলে?’ ক্যাপ্টেন এডাম হিক প্রশ্ন করলেন।
অদ্ভুত লোকগুলোর দল থেকে একজন কয়েক পা সামনে বাড়লো। তারপর বললো, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীরা আমাদের না চিনলেও আমরা তোমাদের বেশ ভালোভাবেই চিনি।’ বুঝলাম সেই নেতা ওই দলের। কথা বলার সময় লোকটির মাথা ডানে বামে ঝুলতে থাকলো। দেখে মনে হয় শুকনো শরীরের উপরে মাথার ভার বহন করতে সমস্যা হচ্ছে।‘কিন্তু কারা তোমরা? এখানেই বা এলে কী করে?’ বললেন হিক।‘আমরাও তোমাদের মতো মঙ্গলের মাটিতে গবেষণা করতে এসেছি। এই গ্রহটাতে আমাদের বসতি স্থাপন করবো আমরা। অনেক দূর থেকে এসেছি, তোমাদের সৌরজগতের বাইরের একটি গ্রহ থেকে।’ বললো তাদের দলনেতা।‘কী নাম তোমাদের গ্রহের?’‘সে রকম কোন নাম নেই, কারণ তোমাদের মত আমরা সবকিছুকে নাম দিয়ে পরিচয় দেই না। আমরা কোন কিছু চেনাতে সঙ্কেত ব্যবহার করি। তাই তোমাকে কিভাবে বলবো আমাদের গ্রহের নাম।’‘কবে এসেছো তোমরা এখানে, মানে কতদিন আগে?’‘আমাদের গ্রহের হিসেবে ৭ বছর আগে এসেছি আমরা এখানে। অবশ্য তোমাদের পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী তা ছয় মাসের একটু বেশি হবে। কারণ আমাদের গ্রহের দিন ও বছরের হিসেব তোমাদের থেকে অনেক ছোট।’একটু থেমে আবার কথা বললো তাদের দলনেতা। ‘তোমরা চলে যাও এখান থেকে, মঙ্গলের মাটিতে আমরা বসতি স্থাপন করবো।’ক্যাপ্টেন হিক বললেন, ‘তোমরা এত দূরে এসে বসতি স্থাপন করতে চাও কেন? আর কোথাও যাও, মঙ্গল তো আমাদের পৃথিবীর প্রতিবেশী গ্রহ।’‘আমাদের গ্যালক্সিতে আর কোন গ্রহে এখনও প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আমাদের ছোট্ট গ্রহের জনসংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আয়তনে খুবই ছোট্ট গ্রহটি। মঙ্গলের মতো বিশাল গ্রহে বসতি গড়তে পারলে আগামী কয়েক হাজার বছরে আমাদের আর জনসংখ্যা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমাদের একটাই চিন্তা, আমরা এখনো তোমাদের মতো প্রযুক্তি নির্ভর পোশাক তৈরিতে সক্ষম হইনি। আমরা শুনেছি পৃথিবীর বুকে পোশাক শিল্পে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ। আমাদের গ্রহ থেকে লোক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি পৃথিবীতে। আমরা সেই দেশটির সাথে চুক্তিবদ্ধ হবো। মঙ্গলে বসবাস করার জন্য আমাদের উচ্চ প্রযুক্তির পোশাক বানাতে হবে। নাহলে এখানে টিকে থাকা অসম্ভব’
লোকটির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তার দলের সবাই অদ্ভুত একটা অস্ত্র বের করে আমাদের দিকে তাক করলো। সবাই মিলে ঘিরে ধরলো আমাদের। ক্যাপ্টেন হিক কী করবেন তাই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। একে তো আমরা নিরস্ত্র, তা ছাড়া সংখ্যায় ওদের চেয়ে কম। ভয় পেয়ে জ্যাক এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। দলনেতার দিকে চেয়ে আছি তিনি কিছু একটা করবেন এই অপেক্ষায়। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, কিছুই বললো না হিক।
‘সাকিব, এই সাকিব ওঠ, এখন কি ঘুমানোর সময়! দেখ তোর বন্ধুরা এসেছে সবাই। ওরা তোর সাথে এয়ারপোর্টে যাবে। তোকে বিদায় জানাতে। তোদের স্যার ফোন করেছিলেন তিনি বিজ্ঞানমন্ত্রীর সাথে এয়ারপোর্টে যাবেন। আর তুই কিনা ঘুমাচ্ছিস।
’
মায়ের মৃদু ধমক কানে যেতেই চোখ কচলে উঠে বসলো সাকিব। স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই হাসি পেল। সন্ধ্যা ছয়টায় ওর আমেরিকা যাওয়ার ফ্লাইট। নাসার মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে তিন মাস শিক্ষানবিস হিসেবে কাজ করার জন্য মনোনীত হয়েছে ও। বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম কেউ এই সুযোগ পেয়েছে।
Writer : Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador-TES
NITER (10th Batch)