পাট ছিলো এই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল,
অন্যকিছু ছিলো নাকো ইহার সমতুল”
স্বচ্ছ পানিতে ধোয়া পাটের আঁশ ভাদ্র মাসের দুপুরের রোদে হাসির ঝলক দিতো বলেই পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ।পাটের সিজনে গ্রামজুড়ে দেখা যেত উৎসবমুখর পরিবেশ, তবে বাতাস ভারী হয়ে যেত পাট জাগ দেয়ার তীব্র গন্ধে।তখন শৈশবে স্কুলে পড়া সেই রচনার লাইনগুলোর কথা মনে পড়ে যেতো,”এই পাটই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি” , এই পাট এবং পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। একসময় পাটের চাহিদা ছিলো আকাশচুম্বী যার দ্বারাই বাংলাদেশে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করে। তখনকার সময়ে পাট পঁচা গন্ধটাও মধুর লাগতো।।
সভ্যতায় কৃত্রিমতার আগমনঃ
মানুষ যতই সভ্যতার দিকে যাচ্ছে ততো-ই পরিবেশ-প্রকৃতি বির্পযয়ের দিকে যাচ্ছে,সেই সাথে জীবনযাত্রার মানে সবুজের ছাঁয়া সরে গিয়ে দেখা মিলছে কৃত্রিমতার। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস তার সর্বশেষ আঘাত। তাই পরিবেশবান্ধব পৃথিবী গড়ার কারিগর এবং বিশেষজ্ঞগণ প্রাণপণে খুঁজে ফিরছেন কি উপায়ে পরিবেশ-প্রকৃতিকে তার আপন প্রাণবন্ত,স্নিগ্ধ গতিতে ফিরিয়ে দেয়া যায়।
সোনালি আশেঁর বিজ্ঞানসম্মত পরিচতিঃ
পাট(Jute) Tiliaceae বর্গের Corchorus গণভুক্ত দ্বিবীজপত্রী আঁশযুক্ত উদ্ভিদ। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাট আঁশ প্রধানত দুটি প্রজাতির, সাদাপাট (Corchorus capsularis) ও তোষাপাট (Corchorus olitorius) থেকে উৎপন্ন হয়। সাদা ও তোষা পাটের উৎপত্তিস্থল যথাক্রমে দক্ষিণ চীনসহ ইন্দো-বার্মা এবং ভূমধ্যসাগরীয় আফ্রিকা। সম্ভবত উড়িয়া শব্দ jhuta বা jota থেকে jute শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।
পাট নিয়ে পূর্বের মতবাদঃ
একসময় ছিল যখন পাট মানেই ধরে নেওয়া হতো শুধু দড়ি আর বস্তা৷ কিন্তু সে চিত্র পাল্টে গেছে অনেক আগেই৷ জুতা, শাড়ি ছাড়াও নানা ধরনের পোশাক, এমনকি তৈরি হচ্ছে পাটের চা-ও৷কি হয় না পাটে!! শুনলে মনে হতেই পারে, পাটের তৈরি জুতা আর কতটাই বা টেকসই হবে! কিন্তু জুতার কারিগররা বলছেন, অন্য সব কাপড়ের জুতার মতোই সমান টেকসই হবে বাংলাদেশে তৈরি এই পাটের জুতা।
বাঙালি বরাবরই পাট রসিকঃ
সুরুচিসম্মত,কারিগরি নৈপণ্যতা,নান্দনিক—পাটের পণ্যে এ তিনটি শব্দ এখন যেন ভালোভাবেই ফুটে উঠছে। সে-ই সাথে স্টাইল, ঐতিহ্য,ফ্যাশনাবল —তিনটিই থাকায় পায়ে পায়ে সোনালি আঁশের জুতার যুগোপযোগী চাহিদা তো কমেনি, উল্টো বেড়েই চলছে। বিশেষ করে শীতে পাটের জুতা ব্যবহারে আরাম ও উষ্ণতা—দুটোই পাওয়া যায় বলে ক্রেতাদের চাহিদাও থাকে বেশি।
পায়ে পায়ে সোনালি আঁশের জুতাঃ-
পাটের নিজস্ব সৌন্দর্য ও চলতি ধারার ফ্যাশনের মিলে তৈরি জুতার জনপ্রিয়তা এখন অনেকটাই বেড়েছে।জেডিপিসি (Jute Diversification Promotion Centre) ঘুরে দেখা মিলে প্রায় ১৫টি নকশার জুতা। মেয়েদের জুতার মধ্যে রয়েছে হাই হিল, হাতে সেলাই ও ছাপা নকশার স্লিপার, পাম্প শু, ফিতা দেওয়া স্যান্ডেল, নাগরা। তবে শীতকালে পা আটকানো পাম্প শু এবং নাগরার চাহিদা থাকে বেশি।
এ ছাড়া ছেলেদের জন্য কনভার্স জুতা, ফরমাল শু, চপ্পল, স্যান্ডেল ও স্লিপার দেখা গেছে। রঙের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে লাল, গোলাপি, কালো, সাদা, আকাশি।তবে পাটের প্রাকৃতিক রং যা বেশি জন্যপ্রিয় ও নজরকাড়া। এছাড়াও রয়েছে ঘরে ব্যবহারের জন্য স্লিপার ও শিশুদের জুতা।পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিনন্দন পাটের জুতাগুলো নকশা করেন আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তারা।
যত্নে থাকুক সোনালি আঁশের জুতাঃ
যেহেতু একটু সেন্সিটিভ তাই এই জুতা গুলো ব্যবহারের সময় এবং ব্যবহারের পর একটু যত্নবান হওয়া প্রয়োজন যাতে করে এতে কোনো ধরনে ক্ষতি না হয়। আসুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে যত্নবান হওয়া সম্ভবঃ
v ব্যবহারের পর মৃদু রোদে শুকিয়ে রাখতে হবে।
v পানি দিয়ে পরিষ্কার না করাই উত্তম। তবে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে রোদে শুকিয়ে নেওয়া যাবে।
v পাটের জুতা বর্ষাকালে ব্যবহার না করে মূলত শীতকাল বা শুকনা মৌসুমে ব্যবহার করা উচিত।
v বেশি ধুলা–ময়লায় গেলে অল্প পানি ও ব্রাশ ব্যবহার করলে জুতা অনেক দিন টেকসই হবে।
কর্মসংস্থানের শোচনীয় অবস্থার প্রবর্তনঃ
বর্তমানে দেশে ৩০৭টি পাটকলের মধ্যে সরকারি ২৫টি ও বেসরকারি ২৮২টি।১৯৫১ সালে প্রথম বাংলাদেশে পৃথিবীর বৃহত্তম পাট কল ‘আদমজী পাটকল’ স্থাপিত হয়।পাটের নানামুখী ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশে চলছে নানা গবেষণা। তবে একের পর এক দেশের পাটকলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকেরা রয়েছে সংকটে। বেসরকারিগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে মুনাফা অর্জন করে সচল থাকলেও সরকারি পাটকলগুলোর অবস্থা শোচনীয়।
অর্থনীতিক স্বচ্ছতায় (Amass Footwear Ltd.):
বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান-কারখানার পাটজাত পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের পছন্দের তালিকায় ঠাঁই করে নিচ্ছে। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে,যেখানের পাটের জুতা বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে অত্যন্ত সুনামের সাথে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদা অর্জন করেন চলেছে। ২০১৭ সাল থেকে এখানকার উৎপাদিত পাটের জুতা দেশের বাইরে রপ্তানি করা হচ্ছে। দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। কালীগঞ্জের (Amass Footwear Ltd.) সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। পাটের জুতা তৈরীতে স্থানীয় ৪ শতাধিক নারী যুক্ত রয়েছেন। বেশীরভাগই গৃহিণী,বাড়ির কাজের পাশাপশি তারা হাতে হাতে এ জুতা তৈরী করে চলেছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীও এখন স্বাবলম্বী।
রপ্তানিমুখী বিশ্বে (AFL) ব্যাপক সাড়া ফেলেছেঃ
এলাকায় তৈরি হওয়া পাটের জুতা ব্যাপক সাড়া ফেলায় ফ্রান্স, প্যারিস, জার্মানি, ইতালি, স্পেনসহ চীন-জাপানেও রপ্তানি করা হচ্ছে। এই কারখানায় ৬টি ধাপে একটি জুতা তৈরি করা হয়। প্রথমে সোল্ড তৈরি হয় রাবার দিয়ে। জুতার বাকি অংশ তৈরি হয় পাট দিয়ে। আর এই কাজগুলো সম্পুর্ণ হাতের মাধ্যমে করা হয়। প্রতি মাসে তাদের কারখানা থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার জুতা রপ্তানি করা হচ্ছে।
(Amass Footwear Ltd.) এর তৈরি জুতার বিক্রয় মূল্য ২ থেকে ১৫ ডলার। ইতিমধ্যে এই কারখানায় উৎপাদিত পাটের জুতা দিয়ে প্যারিসে কয়েকটি ফ্যাশন শো হয়েছে।
ছবিঃকালীগঞ্জে তৈরি পাটের জুতার প্রদর্শনী
অর্থনিতীতে মিলেছে উন্নয়নের ছোয়াঃ
বর্তমানে পুরো পৃথিবীতে চলছে কোভিড-১৯ এর এক অদৃশ্য ধ্বংসযজ্ঞ।যার ফলে রপ্তানি আয়ে যখন ধস নেমেছে ঠিক তখনই আমাদের পাট রপ্তানিতে লাগে উন্নয়নের ছোঁয়া। । ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দুইমাসেই প্রায় ২ কোটি ৭ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পাটের বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে ১৯৫.৪ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে যা পূর্ববর্তী বছরের এই সময়ের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১ শতাংশ বেশি।
পাটের কৃষি জমি সংক্রান্ত তথ্যঃ
বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতে পাট উৎপন্ন হলেও ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরই প্রধান পাটচাষ অঞ্চল। পাটচাষাধীন মোট জমির পরিমাণ প্রায় ২,২৬,৬৫৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৪০,৩৪,৫৮৯ বেল।
এক হেক্টর জমিতে যে পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়, তা ১০০ দিনে প্রকৃতি থেকে ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দান করে। যা জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো কঠিন সময়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এক আশীর্বাদস্বরূপ।
সোনালি আশেঁর ব্যবহার: (কি হয় না পাটে!!)
“পাট এমন একটি পণ্য যার
কোন কিছুই ফেলনা নয়”।।
পাটের ব্যবহার এখন বহুমুখী। আড়াই’শর বেশি পণ্য তৈরি হয় আমাদের এই সোনালি আঁশ থেকে।পাটের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক কিছু বিস্ময়কর অত্যাধুনিক উদ্ভাবনী-
পাট এখন বিশ্বের অনেক দেশে গাড়ি নির্মাণে, কম্পিউটারের বডি, উড়োজাহাজের পার্টস তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।পাট থেকে তৈরি জুট জিওটেক্সটাইল বাঁধ নির্মাণে, ভূমিক্ষয় রোধে, পাহাড় ধস,তাছাড়া ইনস্যুলেশন, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পেও বহির্বিশ্বে বেশ পরিচিত।
পাটকাঠি থেকে তৈরি চারকোল খুবই উচ্চমূল্যের যা দিয়ে তৈরি আতশবাতি, কার্বন পেপার, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, ফটোকপিয়ার মেশিনের কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি তৈরি হয়।
নিত্য ব্যবহার্য প্রসাধনী, পুষ্টি ও ঔষধি গুণ, ভিসকস’ সুতা, ফ্যান্সি ড্রেস, পাটের শাক যার পাতাগুলি লোহা, ক্যালসিয়াম, বিটা-ক্যারোটিন এবং ভিটামিন সহ ভিটামিন সমৃদ্ধ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে খাদ্যশস্য মোড়কীকরণে পাটের থলে ও বস্তা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে(বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে),শুকনো পাট পাতা অর্গানিক চা, ফায়ার গার্ডের ক্লথ, ঔষধের বিয়ারিং ম্যাটরিয়াল(ক্যাপসুল শেল) ইত্যাদি।
পাটের তৈরি সকল দ্রব্যাদি সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব যা ব্যবহার শেষে মাটির সাথে মিশে যেতে সক্ষম (Biodigredable)। পাট জাত পণ্য সবই একেকটা সম্ভাবনার হাতছানি।
পাট জাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি আমাদের মূল লক্ষ্য নয়, নিজেদের উন্নতি অন্যদের হাতে তুলে না দিয়ে, কাঁচা পাট রপ্তানির পরিমাণ কমিয়ে এনে নিজেরা প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্যোগ নিতে হবে।তাহলে সরকারি-বেসরকারী পাটকলগুলোর পাশাপাশি দেশেই নতুন উদ্যোক্তাদের পাটের একটি বড় বাজার তৈরি হবে।সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ও পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় পাট দিবস’ পালনের সূত্রপাত ঘটে। জনসচেতনতা যেমন বাড়ছে, তেমনি দীর্ঘ হচ্ছে স্বপ্ন দেখার পরিসরটাও।
”আর নয় বন্ধ পাটকল , জয় করতে হবেই
এবার পাটশিল্পের প্রতিবন্ধকতা”।।
তথ্যসূত্রঃ news next .com,News24. com, Wikipedia,dbc news tv, প্রথম আলো, নয়াদিগন্ত, জেডিপিসি।
🖋️Writer information
Sharmin Maktum
Department of Fabric Engineering(1st batch)
Mst Afsana Aktar Urme
Dept. Of Wet Processing Engineering( 2nd batch)
Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College,pirganj, Rangpur