১৯৮২ সালে বাজারে প্রচলিত পলিথিনের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হলে পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা চিন্তা করে পরিবেশ কর্মীরা এর বিরোধিতা করেন এবং ফলোশ্রুতিতে বিভিন্ন দেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশেও ২০০২ সালে প্রচলিত পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও বিপনন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।এই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে প্রথমত ন্যাচারাল ফাইবার কমপোজিট (NFC) নিয়ে গবেষণা ও পরিবেশ বান্ধব পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন নিয়ে জোড়ালোভাবে কাজ শুরু হয়। এক দশক ধরে পরিশ্রমের চেষ্টায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এর একজন বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খান বাংলাদেশের আরও কয়েকজন গবেষকের সহায়তায় বেশ কিছু (একটি পরিসরের) এনএফসি বা ন্যাচারাল ফাইবার কমপোজিট প্রস্তুত করতে সক্ষম হন।
পরবর্তিতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) মোবারক আহমদ খান এর দ্বারা তৈরিকৃত একটি পাট-ভিত্তিক এনএফসি ব্যবহার করে একটি ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পণ্যের নাম দেন সোনালী ব্যাগ। পাটকে “সোনালী আঁশ” বলা হয় বলে এর এইরকম নাম করা হয়। এক কথায় বলা যায় সোনালী ব্যাগ হলো পাট থেকে উদ্ভাবিত এক ধরনের পলিথিন ব্যাগ। এটি একটি সেলুলোজ-ভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক, যা প্লাস্টিক ব্যাগের একটি বিকল্প। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান আঁশ শস্য পাট থেকে এই সেলুলোজকে সংগ্রহ করা হয়।
পাট থেকে উদ্ভাবিত সোনালি ব্যাগের সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে সম্প্রতি বিনিয়োগের আগ্রহ জানিয়েছে জাপানের বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠী মারুবেনি। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ জুটমিল কর্পোরেশন(বিজেএমসি’র) সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করেছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইউরোপের দেশগুলোতে প্লাস্টিকের বিকল্প পাট খাতের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও টেকসই পরিকল্পনার অভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। নানা অপ্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বেসরকারি উদ্যোগে জাপানে ১০০ কেজি সোনালি ব্যাগ রপ্তানি হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ নৌবাহিনী নিয়েছে ১০ হাজার ব্যাগ। সোনালি ব্যাগের উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্লাস্টিকের বিকল্প পাট খাতের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও টেকসই পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ জন্য প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা য়ায়, কোনো রকম প্লাস্টিকের উপাদান ছাড়াই প্লাস্টিকের মতো পাটের তৈরি শতভাগ পরিবেশবান্ধব পাট থেকে উৎপাদিত এই পলিথিন ব্যাগ(সোনালী ব্যাগ)।ড. মোবারক খান বলেন, ‘পলিথিনের তুলনায় পাটের পলিমার দেড় গুণ বেশি ভার বহন করতে পারে। এটি পানি শোষণ না করলেও ফেলে দেওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।’
তিনি বলেন, ‘দেশে-বিদেশে অনেক উদ্যোক্তা এটি নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ইউরোপসহ বিশ্বের ৭২টি দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। এর পরও প্লাস্টিকের সহজ বিকল্প না থাকায় ইউরোপে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না।’ বায়োডিগ্রডেবল এই ব্যাগ ব্যবহারে পরিবেশদূষণ অনেকখানি হ্রাস পেতে পারে। যার ফলে প্রয়োজনও মিটবে পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হবে না।
দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তারা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি হস্তান্তরে তার কোনো বাধা নেই। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আরো অধিকতর গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা তহবিল করে দিয়েছে। সোনালি ব্যাগের দাম হবে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। তবে আটকে আছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে। ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলে বিশ্ববাজারে দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে নতুন মাত্রা যোগ করবে এই সোনালি ব্যাগ। প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টন পাটের ব্যাগ উৎপাদন হবে।’এই বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসতে দুই থেকে তিন বছরের বেশি সময় লাগবে না উল্লেখ করে ড. মোবারক বলেন, ছোট পরিসরে উৎপাদন করেও ১০ হাজার ব্যাগ বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিদিন এক টন করে ব্যাগ উৎপাদন হয়। প্রতি টনে এক লাখ ব্যাগ হয়। প্রতিটি ব্যাগে সাত থেকে আট টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ১০ টাকা।
এই বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসতে দুই থেকে তিন বছরের বেশি সময় লাগবে না উল্লেখ করে ড. মোবারক বলেন, ছোট পরিসরে উৎপাদন করেও ১০ হাজার ব্যাগ বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিদিন এক টন করে ব্যাগ উৎপাদন হয়। প্রতি টনে এক লাখ ব্যাগ হয়।প্রতিটি ব্যাগে সাত থেকে আট টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ১০ টাকা। রিসাইকল করা যায় বলে তিনটি ব্যাগ ফেরত দিলে একটি ব্যাগ বিনা মূল্যে দেওয়া যাবে। ১০ টাকার একটি ব্যাগ বিশ্ববাজারে মাত্র ১০ সেন্ট। অন্যদিকে ইউরোপের বাজারে একটি পলিব্যাগ কিনতে গেলেও ২০ সেন্ট লাগে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে শিগগিরই একটি শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ফলে অর্থনীতির পাশাপাশি বেকার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বাজার ও জিডিপি’র মতো এই শিল্পখাতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাণিজ্যিক উৎপাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির টেন্ডার করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো উচিত। এ জন্য বিজেএমসির থেকে ১০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নতুন যন্ত্রপাতির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেছিলেন, ‘একসময়ের গোল্ডেন ফাইবার (সোনালী আঁশ) হিসেবে পরিচিত এই পাট ভবিষ্যতে গোল্ডেন বার (সোনার বার) হিসেবে পরিচিত হবে। বাজারে সোনালী ব্যাগের চাহিদা ব্যাপক হবে। আমরা যদি প্রতিদিন ৫০০ টন সোনালী ব্যাগ উৎপাদন করতে পারি তাহলে ৫০০ টনই বাজারজাত করা সম্ভব।’
দেশের সোনালি ব্যাগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে ঢাকা চেম্বারের পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে চার হাজার ৮০০ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করে। চলতি বছর থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমার আশা সোনালি ব্যাগের বিনিয়োগ করা গেলে দেশের পাটশিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে।
বাঁধন মজুমদার
জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
১০ম ব্যাচ