ভূমিকা:
আমরা সবাই, নাসার বিজ্ঞানীদের মহাকাশে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে শুনে আসতেছি। কিন্তু এটা আমরা অনেকে জানি না যে, এক্ষেত্রেও প্রয়োজন কিছু দক্ষ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের গবেষণায় তৈরীকৃত পোশাক যেটাকে বলা হয়ে থাকে স্পেসস্যুট। এছাড়াও ন্যানোফাইবার, কার্বনফাইবারের শিল্ড। যা মহাকাশে ক্ষতিকারক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়। এই স্পেসস্যুটগুলি প্রতিরক্ষামূলক এবং নিরাপত্তামূলক পোশাক হিসেবে কাজ করে।স্পেসস্যুট ব্যবহার করে নভোচারী মহাকাশযানের বাইরে বেরিয়ে এসে মহাশূন্যে ভেসে থাকতে পারে। এছাড়াও স্পেস স্টেশনের বাইরের এুটি বিচ্যুতি মেরামতের জন্য বাইরে এসে ভেসে ভেসে কাজ করতে পারে। মহাকাশের পরিবেশ আমাদের পরিবেশের মত বসবাসযোগ্য নয়।মহাকাশে পরিবেশের সাথে টিকিয়ে থাকার জন্য মহাকাশচারীকে অবশ্যই স্পেসস্যুট পরিধান করতে হবে।
স্পেসস্যুট মানবদেহকে যেভাবে রক্ষা করে:
১) অক্সিজেন প্রধান এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে থাকে।
২) সহকারী এবং পৃথিবীর সাথে কথপোকথন করতে সাহায্য করে।
৩) সূর্য থেকে আগত বিভিন্ন প্রকারের বিকিরণ, কসমিক রশ্মি ইত্যাদি থেকে মানবদেহকে রক্ষা করে।৪) তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৫) ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পাথর এবং বস্তু ইত্যাদি থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
৬) ভালভাবে চলাফেরা করতে এবং পরিষ্কার দেখতে সাহায্য করে।
৭) নভোচারীর শরীরের বাহ্যিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
স্পেসস্যুট তৈরির কাঁচামাল: স্পেসস্যুট তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কাঁচামাল গুলো হলো:
১) নাইলন ট্রাইকোট
২) স্প্যানডেক্স
৩) ইউরেথনে লেপ নাইলন
৪) নিওপ্রিণ
৫) গর্টেক্স
৬) নোমেক্স
৭) এলুমিনাইজড মায়ালার
৮) কেভলার
৯) ডেক্রন।
স্পেসস্যুটের ভিতরের স্তরটি নাইলন ট্রাইকোট উপাদান দিয়ে গঠিত। আরেকটি স্তর স্প্যানডেক্সের সমন্বয়ে গঠিত। এছাড়াও ইউরেথনে লেপ নাইলনের একটি স্তর রয়েছে। চাপ নিয়ন্ত্রণ স্তরে ডেক্রন নামক একটি পলিস্টার ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পোশাকের মধ্যে কেভলার যা তাপরোধক, ঘর্ষণ প্রতিরোধক এবং উচ্চ শক্তিসম্পন্ন, নোমেক্স, গর্টেক্স, এলুমিনাইজড মায়ালার, নিওপ্রিণ (স্পন্জ রাবার) ব্যবহার করা হয়। সিন্থেটিক ফাইবারের বাইরেও অন্যান্য কাঁচামালগুলির মধ্যে রয়েছে -পলিকার্বানেটের উপাদান যা হেলমেটের শেল তৈরি করে।লিথিয়াম হাইড্রক্সাইড ফিল্টার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় যা কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প সরাতে সাহায্য করে। এছাড়াও গ্লাসফাইবারের মিশ্রণও থাকে।
স্পেসস্যুটের প্রধান অংশগুলির কার্যকারিতা:
১) Communication Carrier Assembly(CCA): সহকারী এবং পৃথিবীর সাথে কথপোকথন এর পূণ্য ব্যবস্থা হলো CCA। হেলমেটের ভিতরে নাইলন এবং টেফলন ফেব্রিক্সের তৈরী কমিউনিকেশন ক্যাপ থাকে। যেখানে যোগাযোগ এরজন্য এয়ারফোণ,মাইক্রোফোন এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ ব্যবস্থা থাকে।
২) Liquid Cooling &Ventilation Garment(LCVC): তাপ নিয়ন্ত্রণ এর পূণ্য ব্যবস্থাই হল LCVC। এ ব্যবস্থায় সাধারণত ভেতরের তাপ বাইরে এবং বাইরের তাপ ভিতরে যেতে পারে না।এছাড়াও পানি ও বাতাসের প্রবাহ বজায় রাখে।
৩) Maximum Absorbency Garment: এটি আন্ডারওয়্যার বলা চলে এবং এর প্রধান কাজ হচ্ছে নভোচারীর মূএ সংরক্ষণ করে যথাসময়ে বাইরে বের করে দেওয়া।
৪) In suit Drink Bag(IDB): এটি বিশেষ ধরণের পানির ব্যাগ যার একটা পাইপ নভোচারীর মুখের কাছে থাকে যথাসময়ে পানি পান করতে পারে।
৫) Extravehicular Visor & Helmet Assembly :এখানে Extravehicular Visor Assembly পালি-কার্বনেট পদার্থ দিয়ে গঠিত যা হেলমেটের বাইরের স্তরে সংযুক্ত থাকে। যেটা শক্ত আবরণ হওয়ার কারণে নভোচারীকে বাইরের আঘাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোক এবং রেডিয়েশন থেকে রক্ষা করে। Helmet Assemble একটি স্বচ্ছা হেলমেট। এর নিচের দিকে Neck Ring সংযুক্ত থাকে।
৬) Hard Upper Torso With Arm Assembly(HUT): এটি বিশেষ ফাইবার গ্লাসের তৈরি যা স্পেসস্যুটের বুক ও হাতের একাংশ নিয়ে গঠিত। বুকের দিকে সংযুক্ত থাকে অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতির কন্ট্রোল সেকশন,সুইচ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত Display and Control Module(DCM)। এছাড়াও HUT এর পিছনের দিকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ব্যাকপ্যাক থাকে। HUT এর সাথেই পরস্পর সংযুক্ত থাকে Arm Assembly যার ফলে হাত সহজে নাড়াচাড়া করা এবং হাতেরনিচের অংশ ঘুরানো সম্ভব হয়। Arm Assembly এর শেষ অংশ যুক্ত থাকে Glove Assembly এর সাথে।যা হাতের কব্জি ঢেকে রাখা, আঙ্গুল এবং বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। ভিতরে Hot pad থাকে যা অতিরিক্ত গরম এবং ঠান্ডা থেকে নভোচারীর হাতকে রক্ষা করে। এছাড়াও ফিঙ্গার টিপ হিটার আঙ্গুলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
৭) Portable Life Support System (PLSS): স্পেসস্যুটের ভেতরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ এবং মহাশূন্যে মাটিতে নভোচারী বেঁচে থাকার জন্য একটি পূণাঙ্গ সিস্টেম HUT এর পিছনে ব্যাকপ্যাকে থাকে। সেই
ব্যবস্থাকে PLSS বলে যা HUT এর পিছনে থাকে। পাঁচটি সাব সিস্টেম নিয়ে PLSS গঠিত:
1) Primary oxygen supply
2) Oxygen ventilating circuit
3) Water transport loop
4) Feed water loop
5) Space suit communication system
এছাড়াও জীবন রক্ষার জন্য অতিরিক্ত দুটি স্পেসস্যুট রাখা হয়:
1) Oxygen purge system
2) Buddy Secondary life support system (BSLSS)
৮) Lower Torso Assembly (LTA): HUT এর নিচে স্পেসস্যুটের পুরো অংশ হলো LTA। Body Seal Closer অংশের সাহায্য LTA এবং HUT পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে। নভোচারী ভালভাবে কোমর ও পা নাড়াচাড়া করে চলাফেরা এর জন্য Waist Bearing থাকে। সবশেষে থাকে বিশেষ ধরনের বুট।
স্পেসস্যুট না ব্যবহার করে মহাকাশে গেলে যা ঘটতে পারে:
১) স্পেসস্যুট ব্যবহার না করলে মানবদেহের শরীরে থাকা অক্সিজেন ১৫ সেকেন্ডের মধ্যেই খরচ হয়ে যায় ফলে আস্তে আস্তে অন্ধত্ব ভাব এবং জ্ঞান হারাতে শুরু করে।
২) মহাকাশ চাপবিহীন হওয়ার কারণে মানবদেহের ফুসফুস এবং পরিপাকতন্রের মধ্যে বাতাসের আয়তন বৃদ্ধি পেতে থাকে ফলে বাতাসের আকার বৃদ্ধি পেয়ে ফুসফুস পেটে যাবে এবং বাতাস রক্তপ্রবাহের মধ্যে চলে যাবে এবং মৃত্যু অনিবার্য।
৩) চাপহীন পরিবেশ হওয়ার কারণে পানি দ্রুত বাষ্পে পরিণত হয় ফলে চোখ,নাক এবং মুখের ভিতরটা শুকিয়ে যেতে শুরু করে।
৪) সূর্য থেকে বিভিন্ন বিকিরণ,কসমিক রশ্মি, ইত্যাদি সরাসরি ত্বকে আঘাত করবে।
৫) অনেক গতিতে আসা ছোট-ছোট পাথর,বস্তু এবং ধুলো এর সম্মুখীন হতে হবে। এছাড়াও আরও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় স্পেসস্যুট ব্যবহার না করলে। এককথায় স্পেসস্যুট ছাড়া মহাকাশে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। আর এই স্পেসস্যুট তৈরির জন্য প্রয়োজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের অবদান।
বাংলাদেশ মহাকাশে যাওয়া নিয়ে কিছু কথা:
নতুন একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পাঠানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মহাকাশ যুগে প্রবেশ করেছে। সেই যাত্রার ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো মহাকাশে বাংলাদেশি নভোচারী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে (সোর্স: প্রথম আলো)। নাসার বিজ্ঞানিরা যারা দীর্ঘদিন যাবত মহাকাশে মানুষ পাঠাতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা অসংখ্য টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের গবেষনায় নিযুক্ত করে থাকে স্পেস স্যুট এবং ন্যানোফাইবার, কার্বন ফাইবারের শিল্ড তৈরীর জন্য। আমাদের দেশের টেক্সটাইল সেক্টর বিশ্বের দরবারে পৌঁছানোর জন্য এই টেকনিক্যাল সেক্টরটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
Writer information:
Name: Raisul Islam Sanjid
Institute: Southeast University